জেলা প্রশাসনের সঙ্গে এক নারীর অন্যরকম প্রতারণা

সুনামগঞ্জে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে অন্যরকম এক প্রতারণা করেছেন এক নারী। ওই নারীর সাহায্যের নামে টাকা আদায়ের ফাঁদে পড়েছেন জেলা প্রশাসকসহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকার্তাও।

কর্মকাণ্ড ফাঁস হওয়ার পর পান্না বেগম নামের অন্যরকম প্রতারক ওই নারীকে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে গতকাল শুক্রবার কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি সদর উপজেলার অচিন্তপুর গ্রামের জুয়েল মিয়ার স্ত্রী ও পৌর শহরের ওয়েজখালীর বাসিন্দা। ওই মহিলার কাহিনী শুনে এলাকাবাসীসহ সকলের চক্ষু চড়ক গাছ।

জানা গেছে, সদর উপজেলার পান্না বেগম প্রায় দুমাস পূর্বে নিজের এক সন্তান আগুনে পুড়ে গেছে জানিয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারতার কাছ থেকে চিকিৎসার নামে ১০ হাজার টাকা নেয়ার পর ওই দিন বিকালেই শিশুটি মারা গেছে বলে ওই নারী ইউএনওকে অবগত করে।

পরদিন পান্না তার দ্বিতীয় সন্তানের খাদ্য নালিতে মারবেল আটকে গেছে জানিয়ে চিকিৎসার সহায়তার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, এর আগের দিন ওই নারী তার শিশু সন্তান অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে- এমন করুণ অবস্থায় জেলা প্রশাসক মর্মাহত হয়ে সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা বলে শিশুটিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেট এমএমজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর জন্য অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দেন।

কিন্তু ওই নারী অ্যাম্বুলেন্সে না গিয়ে অন্য গাড়িতে যাবেন বলে আরও ২ হাজার টাকা নেন ইউএনওর কাছ থেকে। ওই দিন বিকাল ৪টার দিকে ওই নারী মোবাইল ফোনে জেলা প্রশাসক ও ইউএনওকে জানায় গাড়িতে সিলেট যাওয়ার পথেই তার দ্বিতীয় শিশুটিও মারা গেছে।

এ দুই ঘটনার আরও দুদিন পর ফের ওই নারী জেলা প্রশাসকের কাছে উপস্থিত হয়ে জানায়, তার তৃতীয় শিশু সন্তানটি নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্টে ভুগছে। সদর হাসপাতালে ভর্তিকৃত সন্তানটি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।

জেলা প্রশাসক সদর হাসপাতালে ভর্তিকৃত ওই শিশুর চিকিৎসার বিষয়ে খোঁজ নিতে ও তার দেখভাল করতে সিভিল সার্জনকে ফোন দিয়ে অনুরোধ করেন। পরে ওই নারী মোবাইলফোনে জেলা প্রশাসককে জানান, এ সন্তানকেও সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় হাসপাতাল গেটেই শিশুটি মারা গেছে।

পরপর তিন তিনটি শিশু সন্তানের মৃত্যুর বিষয়টি জেনে জেলা প্রশাসক ওই নারীর প্রতি আরও সদয় হন। তৃতীয় সন্তানের বিষয়ে ওই নারী জেলা প্রশাসককে ঘটনার দিন দুপুরে মোবাইলে ফোন দিলেও তিনি একটি আলোচনায় সভায় অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখছিলেন বলে ফোন রিসিভ করতে পারেননি। শিশুটির মৃত্যুর খবর শুনে জেলা প্রশাসকের ধারণা হয়, তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করতে না পারার কারণে হয়ত শিশুটি বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে।

এমন হৃদয় বিদারক ঘটনায় জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলামের নির্দেশে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওই নারীকে আবারও ঘর নির্মাণের জন্য ৪ বান্ডিল ঢেউটিন ও নগদ ৬ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। এদিকে টানা তিনবার সহায়তা পেয়েও থামেননি পান্না।

বৃহস্পতিবার ফের বন্ধকি জমি ছাড়ানোর কথা বলে ৪র্থ বারের মতো সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পুনঃরায় ১০ হাজার টাকা সাহায্য চান। এতেই বিপত্তি ও সন্দেহ দেখা দিলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাকে নিজের গাড়িতে করে পান্নার বসত বাড়িতে যান এবং জমি দেখাতে বলেন।

শহরের ওয়েজখালি এলাকায় বসবাসকারী ওই নারীর বসতবাড়ি গিয়ে ইউএনও দেখেন আদৌ তার তিন সন্তান মারা যায়নি তার ৫ সন্তানই জীবিত, এমনকি স্বামীও রয়েছে। প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে তাৎক্ষণিকভাবে সদর মডেল থানা পুলিশকে খবর দিয়ে পান্না বেগমকে আটক করিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে প্রতারণার দায়ে বৃহস্পতিবার রাতে পান্না বেগমকে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করলে সদর মডেল থানা পুলিশ শুক্রবার সকালে তাকে জেলা কারাগারে প্রেরণ করে।

পান্নার স্বামী জুয়েল মিয়া জানান, তার স্ত্রীর প্রশাসনের সঙ্গে এমন প্রতারণার বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাত জাহান বলেন, 'প্রথমবারের মতো এমন প্রতারণা আমি দেখলাম। প্রশাসন পর্যায়ে এ ধরণের প্রতারণা করার মতো সাহস করতে পারে বলে আমার জানাই ছিল না।'