‘তুই চলে যা, পেছনে ফিরে তাকালে মাইর‌্যা ফালামু’

নিখোঁজের ৪৫ দিন পর বাসায় ফিরেছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সহকারী অধ্যাপক ড. মোবাশ্বার হাসান সিজার। বৃহস্পতিবার এয়ারপোর্ট এলাকায় তাকে ফেলে রেখে যাওয়া হয়। পরে সিএনজিতে করে গভীর রাতে তিনি একাই বাসায় ফেরেন।

মোবাশ্বারের বোন তামান্না তাসমিন শুক্রবার সকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিষয়টি জানানোর পর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম তার বাসায় ভিড় করে। ড. মোবাশ্বার হাসান তার গুম হয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন ধরণের বিষয় সাংবাদিকদের কাছে জানান। কথা বলার সময় তার মুখে জড়তা লক্ষ্য করা গেছে। বর্তমানে তিনি সুস্থ, তবে মানসিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত দেখা গেছে। 

গুমের বর্ণনা: ড. মোবাশ্বার হাসান বলেন, ‘এতদিন একটি বদ্ধ ঘরে (আমাকে) আটকে রাখা হয়েছিল। একটা ময়লা তোশক। জানালা আছে, জানালা বাইরে থেকে সিল (বন্ধ) করা। আর ওই (বিপরীত) সাইডে আরেকটা রুম আছে। ৪-৫ জন কথা বলতেছে। এরপর থেকে এখানেই ছিলাম।’

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ওই দুঃসময়ের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘কিডন্যাপ না হলে (এর ভয়াবহতা) রিয়েলাইজ করা যাবে না। অনেক দিন পর আজকে সূর্যের আলো দেখলাম। আমার চোখে গামছা বেঁধে রাখা হয়েছিল।’

যেভাবে ছাড়া পেলেন: ‘গত রাত ১টার দিকে আমাকে তাদের গাড়িতে বসাইছে। তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা একটা কিছু হইছে। এক ঘণ্টাও হতে পারে, বেশিও হতে পারে। আমাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় একজনের কোলের মধ্যে শোয়ায়ে রেখেছিল। পরে তারা বলছে, তুই চলে যা, পেছনে ফিরে তাকালে মাইর‌্যা ফালামু।’-বলেন ড. সিজার।’

তিনি বলেন, ‘আমার কাছে টাকা-পয়সা ছিল না। একটা সিএনজি হাতে ইশারা করে থামিয়েছি। পরে ড্রাইভারের কাছে থাকা মোবাইল ফোন দিয়ে আব্বাকে কল দিয়েছি। পরে আব্বা অথবা তামান্না (বোন) এসে বাসার গেইটে ৫০০ টাকা দিয়েছে ওই ড্রাইভারকে।’

দুঃসময়ের বর্ণনা: ড. সিজার বলেন, ‘যতটুকু মনে আছে, হোটেল থেকে মনে হয় ঠাণ্ডা খাবার দিতো। ভাত খাবার হিসেবে দেয়া হতো। আর অপহরণের সময় (আমার) সঙ্গে ২৭ হাজার টাকা ছিল। ওগুলো তারা (অপহরণকারীরা) নিয়ে যায়।’

ড. সিজার বলেন, ‘(অপহরণের) মূল উদ্দেশ্য কী ছিল সেটা আমি বুঝতে পারছি না। শেষের দিকে (আমাকে) মেরে ফেলা হবে কি না সেটা নিয়েও অপহরণকারীদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়।’

যেভাবে নিখোঁজ হন মোবাশ্বার: গত ৭ নভেম্বর বিকালে কর্মস্থল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বনশ্রীর বাসার উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় নিখোঁজ হন ড. মোবাশ্বার হাসান সিজার।

এ ঘটনার পর ড. মোবাশ্বার হাসান সিজারের বাবা মোতাহার হোসেন খিলগাঁও থানায় একটি জিডি করেন।

২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করে তিনি বছরখানেক ঢাকায় সাংবাদিকতা করেন। এরপর তিনি ব্রিটেনের ডান্ডি ইউনির্ভাসিটি থেকে রাজনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কয়েক বছর ব্রিটেনে অবস্থানের পর সিজার ঢাকায় ফিরে আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফামে যোগদান করেন।

কে এই মোবাশ্বার: গত এক বছর ধরে দেশের অন্যতম খ্যাতনামা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করছিলেন ড. সিজার।

প্রসঙ্গত, অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনকারী ড. সিজারের পিএইচডি গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামের প্রভাব কতটা ভূমিকা রাখছে’।

ইসলাম, রাজনীতি ও জঙ্গিবাদ বিষয়ে সম্প্রতি তিনি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও জার্নালে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন।

সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে দিল্লিভিত্তিক একটি জার্নালে তার প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। বিশ্বায়নের ছায়ায় বাংলাদেশের ভেতরে কীভাবে ইসলামের নামে উগ্রবাদীরা সহিংসতা ছড়াচ্ছে, সে বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন তিনি তার সর্বশেষ লেখায়।