বেড়েই চলেছে যৌতুকের সহিংসতা

যৌতুক প্রথা এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন সহিংসতা থেকে নারীদের মুক্তির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও দেশে এখনো এর ভয়াবহতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই সহিংসতা ছাপিয়ে যাচ্ছে নারীর ক্ষমতায়নকে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পরিসংখ্যানে চোখ বুলালে দেখা যায়, দেশে এখনো যৌতুক সংক্রান্ত সহিংসতা উদ্বেগজনক হারে রয়েছে। আরো উদ্বেগের বিষয় হলো- এ সংক্রান্ত ঘটনায় যেসব মামলা দায়ের হয় তা প্রকৃত ঘটনার চেয়েও অনেক কম।

মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৫ হাজার ৬৯৯ জন নারী যৌতুক সংক্রান্ত সহিংসতার শিকার হয়েছে। আর যৌতুকের কারণে হত্যাকাণ্ড ও আত্মহত্যার হারও অনেক বেশি।

অধিকারের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ২৫৬ জন নারী যৌতুক সংক্রান্ত সহিংসতার শিকার এবং ১২৯ জন নারী হত্যা অথবা আত্মহত্যা করেছেন। যৌতুকবিরোধী প্রচারণা এবং এ সংক্রান্ত আইন সংশোধন করার পরও বছরের পর বছর যৌতুক সংক্রান্ত সহিংসতার ঘটনা বেড়েই চলেছে।

সরকার ১৯৮০ সালের আইনের জায়গায় যৌতুক প্রতিরোধ আইন ২০১৭ প্রবর্তন করলেও সহিংসতার সাথে তুলনা করলে যৌতুকের মামলা অনেক কম। আইন ও সালিশ কেন্দ্র’র (আসক) তথ্যমতে, গত বছর ১৮৮টি যৌতুক সংক্রান্ত মামলা হয়েছে। যেখানে যৌতুক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৩০৩টি। দেশে নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়নে তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি হলেও যৌতুক সহিসংতা বেড়েই চলেছে।

যৌতুক প্রতিরোধ আইন ২০১৭ অনুযায়ী, কনেকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অপরাধে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানার মতো কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। তাছাড়া যৌতুকের দাবিতে বর পক্ষ কনেকে মারাত্মক জখম করলে আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অনধিক ১২ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার পাশাপাশি অর্থ দণ্ড করা হবে। কিন্তু পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যারা যৌতুকের সহিংসতার শিকার তারা আদালতের দ্বারস্থ হন না।

এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল ইউএনবিকে বলেন, এই ঘটনাগুলি সমাজে নারীর অবস্থা তুলে ধরে। কারণ এখানে নারীকে দায়বদ্ধতা হিসেবে গণ্য করা হয় এবং অনেকে তাদের সমানভাবে সম্মান করে না। তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ পরিবারই মনে করে যে সমাজে মেয়েদের গুরুত্ব কম যা জীবনের প্রতিটি ধাপে তাদের দুর্ভাগ্য নিয়ে আসে।’

সুলতানা কামাল উল্লেখ করেন যে, নারীদের সম্পত্তি মালিকানা নেই এবং তাদের অনেককে সমাজের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার বিষয়য়ে পুরুষের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই নির্ভরশীলতাই সমাজের তাদের নিষ্ক্রিয় করে তোলে এবং নির্যাতনের শিকার করে।

তিনি বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে এবং যৌতুক প্রথা প্রতিরোধে নানা আইন থাকলেও এখনো এই প্রথা রয়েই গেছে। কেননা বাংলাদেশে এটি ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিষ্ঠিত।

সুলতানা কামাল বলেন, ‘নারীরা অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা এবং সম অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে না পারা পর্যন্ত এই চর্চা অব্যাহত থাকবে।’

তিনি বলেন, পুরো সমাজ ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো উচিৎ এবং সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ইউনিটকে লিঙ্গ সমতা বিষয়ে সচেতন হতে হবে। শুধু আইন কানুন এবং প্রচারাভিযানের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাজ থেকে দূর করা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম ইউএনবিকে বলেন, সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বৈষম্যমূলক। তাদেরকে পুরোপুরি মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে পরিচালনা করছেন নারী, ক্রিকেটে নারীরা বিজয় অর্জন করেছে, এভারেস্ট চূড়ায় আরোহন করেছে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছে। তবুও তারা যৌতুকের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।’

আয়েশা বলেন, যৌতুক প্রতিরোধ আইন পাস হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হওয়া দরকার। যৌতুক প্রথা পুরোপুরি বিলুপ্ত করতে সামাজিক সচেতনতা এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে এর বিন্যাস প্রত্যাহার করা প্রয়োজন।