৬ অক্টোবর সেরিব্রাল পলসি ডে: প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার গল্প

কাউকে ছোট করতে নেই, সবাই সমান -এ ধরণের নীতিবাক্য বইয়ের ভিতরেই সীমাবদ্ধ। ব্যক্তিজীবনে যখন প্রতিবন্ধকতা আসে বা কোন প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হয়, তখন পরিবার থেকেই শুরু হয়ে যায় সেই শিশু বা ব্যক্তিকে বোঝা হিসেবে দেখা। প্রতিবন্ধী সেই ব্যক্তি বা শিশুকে লক্ষ্য করে সহানুভূতি, ব্যঙ্গাত্মক কথাবার্তার ফলে তাদের সামনের দিকে এগিয়ে চলার কর্মস্পৃহাই নষ্ট হয়ে যায়।

সেরিব্রাল পলসি (cerebral palsy) এমন একটি সমস্যা যা ব্যক্তিমস্তিষ্কে কোন প্রকার আঘাত বা ক্ষয়-ক্ষতির জন্য হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে শরীরে প্রতিবন্ধকতা যেমন- চলাফেরা, শারীরিক ভারসাম্য বজায় রাখা, কথা বলা, খাবার খাওয়া ও বুদ্ধি বিকাশে সমস্যা দেখা দেয়।

মোঃ ইফতি হচ্ছেন একজন সেবিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত একজন ব্যক্তি। তার বয়স ২৫ বছর। জন্মের পর থেকেই তার বাবার অনেক আশা ছেলেকে নিয়ে। কিন্তু শৈশবে যখন ইফতির প্রথম সেরিব্রাল পলসি ধরা পড়ল, তার বাবা নিজের আশাকে হতাশায় পরিণত হতে দেননি।

ইফতি কলমটা ঠিকভাবে ধরতে পারছিলেন না। তবুও ইফতির বাবা নিজের পরিবার ও আত্মীয়দের সামনে ইফতির হাতে কলম ধরিয়ে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত ইফতির সাথে থাকবেন।

ইফতি পড়াশুনা করবে সে মানুষের মত মানুষ হবেই। তার বাবা নিজে স্বপ্ন দেখেন, ইফতিকে স্বপ্ন দেখতে শেখান, তার এই সমস্যা যেন তার জীবনের সফলতার কাঁটা যেন না হয়ে দাঁড়ায়।

পরিবার থেকে অনেক সমর্থন থাকলেও ইফতিকে বাহিরের পরিবেশে খাপ খাওয়াতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তাকে সহ্য করতে হয়েছে সহপাঠীদের কটূকথা আর ঠাট্টা-রসিকতা। প্রতিবেশীরাও তাকে নিয়ে মন্দ কথা বলত, তিনি ছিলেন তাদের কাছে হাসি-তামাশার পাত্র। সেই কষ্টগুলো ইফতিকে আজও কষ্ট দেয়। এ সময়টাতে তার বাবা ছায়ার মত পাশে ছিল।

ইফতি আজ সফলতার চরম শিখরে। আজ সে অত্যন্ত সফল একজন ব্যক্তি। তিনি তার আজকের সফলতার পিছনে দুটি কারণ তুলে ধরেন, প্রথমটি হল তার বাবা, আর দ্বিতীয়টি হল সি.আর.পি. থেকে পাওয়া সেবা এবং ভালোবাসা।

ইফতি উল্লেখ করেন যে, সাভার সি.আর.পি তে আসার আগে, শরীরিক সমস্যা ছাড়াও তার কথা বলায় বিভিন্ন সমস্যা ছিল। বিশেষ করে তিনি বলেন যে, তার মুখের সমস্যাগুলোর জন্য তিনি সবার সামনে বিভিন্নভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে লজ্জাবোধ করতেন। তার কথা অস্পষ্ট ছিল, তার কণ্ঠস্বরজনিত সমস্যা আর উচ্চারনের সমস্যা ছিল।

তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি ডিপার্টমেন্টের প্রতি। স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি নিয়ে তার ভাষাগত সমস্যা অনেকটা কমে এসেছে। যে ইফতি কোন প্রকার কথোপকথনে অংশগ্রহন করতে ভয় পেতেন, লোকালয়ে মুখ তুলে দাঁড়াতে দ্বিধা করত, আজ সে ইংরেজী বিষয়ে বিএ শেষ করে মাস্টার্স করার জন্য ভর্তি হয়েছেন। ইফতি আজ সেই হাজারো সেরিব্রাল পলসি আক্রান্তদের জন্য এক জ্বলন্ত অনুপ্রেরণা।

প্রতিবন্ধিতা মানে সকল স্বপ্নের শেষ নয় বরং এর মানে প্রতিবন্ধকতার সকল বাঁধা অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। পরিবারের সকলের মনের ভয় আর শঙ্কাকে ইফতি আজ মিটিয়ে দিয়েছেন। তুলে ধরেছেন তার জীবনের সফলতার কাহিনী। একজন প্রতিবন্ধী কখনোই সমাজের বোঝা নয়, তারাও পারবে দেশের আরো দশজন মানুষের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে। শুধু লাগবে সাহস আর স্বপ্ন দেখার ইচ্ছা।

সেরিব্রাল পলসি:

সেরিব্রাল পলসি কিছু সমস্যার সমন্বিত রূপ যা মাংসপেশীর বৃদ্ধি, নড়াচড়া এবং শারীরিক অবস্থাকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে প্রতিবন্ধিতা সৃষ্টি করে। এর ফলে শিশুর নাড়াচড়া করতে বা কাজ করতে সমস্যা হয়। তাছাড়া শারীরিক সমস্যার সাথে আরো কিছু যেমন, যোগাযোগের সমস্যা, বুদ্ধিমত্তা, চিন্তাগত সমস্যা এবং আচরণগত সমস্যা থাকতে পারে যা শিশুর বেড়ে ওঠাতে বাধার সৃষ্টি করে।

সেরিব্রাল পলসির কারণ:

শিশুর জন্মের আগে, জন্মের সময় অথবা জন্মের পরে অক্সিজেনের অভাবে অথবা মস্তিষ্কে সংক্রমন সেরিব্রাল পলসির অন্যতম কারণ।

সেরিব্রাল পলসির ধরণ:

১. কোয়াডিপ্লেজিক সেরিব্রাস পলসি: সম্পূর্ণ শরীর বা দেহ আক্রান্ত হবে এবং এর প্রভাব পড়বে মুখের মাংশ পেশীতে।

২. হেমিপ্লেজিক সেরিব্রাল পলসি: শরীরের যে কোন এক পাশ আক্রান্ত হয়।

৩. ডাইপ্লেজিক সেরিব্রাল পলসি: শরীরের উপরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চেয়ে নিচের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন-পা, সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়।

৪. মনোপ্লেজিক সেরিব্রাল পলসি: দেহের বা শরীরের যে কোন একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যে কোন এক অংশ বা এক পাশ আক্রান্ত হবে।

সেরিব্রাল পলসি: শিশু বা ব্যক্তিদের ভাষা ও কথা সংক্রান্ত সমস্যা-

• কোন কিছু শুনতে ও মনোযোগ দিতে সমস্যা
• কথা বলতে না পারা
• কথা বলার জন্য ব্যবহৃত মুখের মাংপেশির দূর্বলতা বা নড়াচড়াr সমস্যার কারণে কথা জড়িয়ে যাওয়া অথবা অস্পষ্ট হওয়া
• কথা বলার গতি ধীর হয়ে যাওয়া
• একঘেয়ে স্বরে কথা বলা
• কণ্ঠস্বরের সমস্যা (যেমন: কর্কশ কন্ঠ, ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠ ইত্যাদি)
• কথা বলার সময় অন্যের কথা বুঝতে বা নিজের কথা প্রকাশে সমস্যা
• পড়তে ও লিখতে সমস্যা

শিশুর যোগাযোগের যে মাধ্যমগুলো লক্ষ্য করতে হবে:

১. হাতের বা চোখের ইশারায় কথা বলা

২. আঙ্গুল দিয়ে দেখানো বা কোন কিছু ধরা

৩. আওয়াজ করা যেমন: বা-বা, বু-বু, উ, আ ইত্যাদি

৪. হাত-পা নড়াচড়া বা কান্নার মাধ্যমে যোগাযোগ করা।

শিশুর যোগাযোগের উন্নতির জন্য অভিভাবকের করণীয়:

থেরাপি ও তথ্যের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন যোগ্যতাসম্পন্ন স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুযেজ থেরাপি বিভাগ সি.আর.পি. ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে। এছাড়াও যোগাযোগ করতে পারেন প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র যা জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন দ্বারা পরিচালিত।

- ড. নুরভীন জাহান আশা, ড.সাবরিনা হোসেন তৃষা

স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি ডিপার্টমেন্ট

সি.আর.পি - সাভার।