আপনি পড়ছেন

বর্তমান সময়ে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অ্যাপ নির্ভর পরিবহন সেবা উবার ও পাঠাও। প্রশ্ন হলো কেন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই অ্যাপস ভিত্তিক সেবা? সহজ উত্তর-অ্যাপসের মাধ্যমে সহজেই নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়েই পাওয়া যায় গাড়ি, ভাড়া নিয়ে কোন দর কষাকষির বালাই নেই, এখানে যাবো না, ওখানে যাবো না কিংবা মিটারের চাইতে ২০/৫০ টাকা বাড়ায় দিয়েন এসব কথাও শুনতে হয় না। ক্লিকের মাধ্যমেই হাজির হচ্ছে গাড়ি, এরপর গন্তব্যে পৌছে যা হিসাবে আসছে তাই পরিশোধ করা হচ্ছে চালককে।

cng anarchy

অন্যদিকে এবার সিএনজিতে আপনার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যাওয়ার কথা চিন্তা করুনতো? কি কি জটিলতা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে? প্রথমত, আপনি যেখানে যেতে চান, সেখানে যেতে আগ্রহী এরকম সিএনজি পেতে হবে আগে, এরপর ভাড়া নিয়ে দর কষাকষি করতে হবে, মিটারে যেতে আগ্রহী এমন সিএনজি খুঁজে পাওয়াই দুস্কর, ১০/১২টা সিএনজি দেখে যদিও বা আপনি মিটারে যেতে ইচ্ছুক এমন সিএনজি চালক পেয়ে থাকেন তবে সেটা সৌভাগ্য, আর মিটারে যেতে ইচ্ছুক এমন সিএনজি পেলেও ধরেই নিন আপনাকে শুনতে হবে মামা ২০/৫০ টাকা বাড়ায় দিয়েন, চুক্তিতে যেতে চাইলেও ২০০ টাকার নিচে কোন সিএনজি পাওয়াটাই কঠিন। আর কাছে পিঠে কোথাও সাধারণত সিএনজি যেতেই চায় না।

লেখাটা শুরুই করলাম তুলনামূলক বিবরণ দিয়ে। এটুকু পড়েই নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায় কেন জনপ্রিয়তা বাড়ছে অ্যাপসভিত্তিক যাত্রী সেবা। ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে সাধারণ যাত্রীদের জন্য ঢাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা সেবা চালু হয়। বর্তমানে সবুজ ও ছাই রঙের অটোরিকশা চলাচল করতে দেখা যায়। সবুজ সিএনজি বাণিজ্যিক আর ছাইগুলো সাধারণ মানুষ তাদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন। প্রথম দিকে সেবা কিছুটা ভালো থাকলেও সিএনজি অটোরিকশাকে কখনোই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সরকার। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) বারবার কড়াকড়ি আরোপের চেষ্টা করলেও মিটারে চলে না অধিকাংশ সিএনজি। অনেক সময় যাত্রীদের সঙ্গে চালকরা চুক্তি করার পর আবদার করে বলেন, 'মামা সার্জেন্ট জিগাইলে কইবেন মিটারে যাইতেছি। যাত্রীরাও বাধ্য হয়ে চালকদের এই অনৈতিক আবদারে সাড়া দেন।'

বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী,রাজধানীতে সিএনজি অটোরিকশার দৈনিক জমা ছিল ৩০০ টাকা। এরপর সেটা ৪৫০ টাকা, দ্বিতীয় দফায় বেড়ে ৬০০ টাকা এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে জমার অঙ্কটা বেড়ে হয়েছে ৯০০ টাকা। অটোরিকশা চালুর শুরুতে প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া ছিল ১২ টাকা, দ্বিতীয় দফায় সেটা হয়েছে ১৩.৫০ টাকা, তৃতীয় দফায় ২৫ টাকা এবং সর্বশেষ চতুর্থ দফায় প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া বেড়ে হয়েছে ৪০ টাকা হয়। প্রথম দুই কিলোমিটারের পর প্রতি কিলোমিটার ভাড়া ২০০৩ সালের দিকে ছিল পাঁচ টাকা, পরে দ্বিতীয় দফায় সেটা বেড়ে হয় ৫.৫০ টাকা, তৃতীয় দফায় ৭.৬৪ টাকা এবং সর্বশেষ কিলোমিটার প্রতি ভাড়া নির্ধারণ করা হয় হয় ১২ টাকা। এছাড়াও সিএনজি অটোরিকশা চালুর পর যাত্রাবিরতি, যানজট, সিগন্যালসহ নানা কারণে গাড়ি থেমে থাকলে ওয়েটিং চার্জ শুরুতে ছিল প্রতি মিনিট ৫০ পয়সা, দ্বিতীয় দফায় সেটি হয় ৭৫ পয়সা, তৃতীয় দফায় এক টাকা ৪০ পয়সা এবং সর্বশেষ চতুর্থ দফায় ওয়েটিং চার্জ বেড়ে হয় ২ টাকা। বিভিন্ন অজুহাতে বিগত ১৪ বছরে সব ধরণের চার্জ তিনগুণের বেশি হলেও যাত্রী সেবার মান বাড়েনি। দেশের প্রচলিত আইন মানছেন না সিএনজি অটোরিকশা চালক বা মালিকপক্ষ। মিটারে চলে এমন সিএনজি অটোরিকশা পাওয়া অত্যন্ত দুর্লভ। চুক্তিতে যাত্রী নেয়ার ব্যাপারটি এখন ওপেন সিক্রেট।

সাধারণ যাত্রীদের অভিযোগ, রাজধানীতে একটি সিএনজি অটোরিকশাও মিটারে চলাচল করছে না। মিটার গাড়িতে লাগানো থাকলেও চালকরা গন্তব্যে যেতে চান নিজের খুশিমতো ভাড়ায়। প্রয়োজনের তাগিদে বাধ্য হয়ে চুক্তিতেই সিএনজিতে উঠতে হয় সাধারণ যাত্রীদের। ভাড়া নিয়ে সিএনজি চালকদের কাছে রীতিমতো জিম্মি সাধারণ যাত্রীরা। অন্যদিকে চালকরা অভিযোগ করেছেন, মালিকরা জমা নিচ্ছেন বেশি, দুই হাতে গাড়ি ভাড়া দেয়া এবং রাজধানীর যানজটের কারণে মিটারে গেলে মালিকের জমার টাকাই উঠানো সম্ভব হয় না।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সর্বশেষ তথ্যমতে, রাজধানীর ৮৭ ভাগ সিএনজি অটোরিকশা মিটারে চলাচল করে না। যদি কোন সিএনজি মিটারে যেতে আগ্রহী হয় তাহলে তার ৯২ ভাগ অটোরিকশা মিটারের চাইতে অতিরিক্ত ২০ থেকে ৫০ টাকা বেশি ভাড়া নেয়। আর যাত্রীর পছন্দের গন্তব্যে যেতে রাজি হয় না ৭৮ শতাংশ অটোরিকশা চালক। এসব পরিসংখ্যানই বলে দেয় সিএনজি চালকদের কাছে কতোটা জিম্মি সাধারণ জনগণ।

সিএনজি অটোরিকশায় ২০০ টাকার নিচে কোন ভাড়াই নেই: যারা সিএনজিতে চলাফেরা করেন তারা ভালোভাবেই জানেন সিএনজিতো মিটারে চলেই না উল্টো চুক্তিতে গেলে, যে কোনো দূরত্বের জন্যই সিএনজি চালকরা হেঁকে বসেন ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা এমনকি ৪০০ টাকা বলতেও দ্বিধাবোধ করে না। আর স্বল্প দূরত্বে গেলে তো রাজিই হবে না কোন চালক। ঢাকার রাস্তায় হয়তো মিটার চালু অবস্থায় ঝাঁকে ঝাঁকে অটোরিকশা দেখা যায় কিন্তু এসবই আইওয়াশ। আর প্রয়োজনের সময় দীর্ঘ সময় ঘাম ঝরিয়েও একজন অটো চালকেরও মন গলানো সম্ভব হয় না।

গত মঙ্গলবার সকাল সাড়ে সাতটায় রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে সিএনজি অটোরিকশা খুঁজতে দেখা গেল পারভীন নামের এক ভদ্র মহিলাকে। তিনি যাবেন ধানমন্ডি ২৭। প্রথমে বাসে ওঠার চেষ্টা করলেন। অফিস টাইম হওয়ায় সিটিং বাসগুলোতে কোন সিট নেই। আর লোকাল গাড়িগুলো ঠাসা। অফিসের সময় হয়ে যাওয়ায় বারবার মোবাইলে সময় দেখছিলেন। এরপর সিএনজি খুঁজতে লাগলেন। কোন সিএনজি চালকই মিটারে যেতে রাজি হলেন না। আড়াই, তিনশ বলেও সিএনজি পাচ্ছিলেন না। অবশেষে প্রায় আধাঘণ্টা পর সাড়ে তিনশত টাকায় একটি সিএনজি পান পারভীন। তার আগে তিনি বলেন, 'বাসে ওঠা কঠিন। দেখছেনই তো অটোরিকশাগুলো মিটারে যেতে চাচ্ছে না। অনেক বেশি টাকায় চুক্তি করে সিএনজিতে উঠতে হলো। এমন অরাজকতা চললে আমরা সাধারণ মানুষ কোথায় যাব? এসব কি দেখার কেউ নেই?' এমন ভুক্তভোগী শুধু পারভীনই নন। সিএনজি অটোরিকশায় যারা চলাচল করেন তাদের অধিকাংশই প্রতিনিয়ত এমন দুর্ভোগের শিকার হন। সংশ্লিষ্টরা দফায় দফায় ভাড়া বাড়ান, মিটার সংশোধন করেন কিন্তু এর কোন সুফল পায় না সাধারণ জনগণ।

সার্জেন্ট জিগাইলে বলবেন ‘মিটারে যাচ্ছি’: সিএনজি অটোরিকশায় চলাচলকারীদের কাছে পরিচিত একটি লাইন ‘মামা সার্জেন্ট জিগাইলে বলবেন মিটারে যাইতাছি’। একটি হিসাবে রাজধানীতে দশ হাজারের বেশি সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করছে। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে কথা হয় বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা ফারুক আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'এক ঘণ্টা ধরে সিএনজি খুঁজছি। এখানে কত সিএনজি তাও কেউ যাবে না। যত টাকা চাইবে সেটাই দিতে হবে। আর বাড়তি ভাড়া দিয়ে সিএনজিতে ওঠার পর চালক হাসিমুখে বলেন, মামা, সার্জেন্ট জিগাইলে বলবেন মিটারে যাইতাচ্ছি।' আর বাধ্য হয়েই বছরের পর বছর ধরে এমন মিথ্যাই বলে যাচ্ছেন রাজধানীর অসহায় যাত্রীরা।

আইনে আছে কোনও চালক যদি মিটারে যেতে না চান অথবা মিটারের চাইতে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে চান তবে তা হবে সিএনজি/পেট্রোলচালিত ৪ স্ট্রোক থ্রি হুইলার সার্ভিস নীতিমালা ২০০৭ এর ‘ঙ’ (৩) অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্তের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সিএনজি অটোরিকশাটির রেজিস্ট্রেশন স্থগিতসহ মামলা, ৭০০ থেকে ১৪০০ টাকা জরিমানা। পাশাপাশি রেকারের বিল আরো ১২০০ টাকা উঠতে পারে। কিন্তু এসব আইন শুধু কাগজে কলমেই শোভা পায়। বাস্তবায়ন হয়না একদমই।

সিএনজি অটোরিকশার চালকরা, মালিক পক্ষকে আর অন্যদিকে মালিকপক্ষ চালককে দোষারোপ করা সংস্কৃতি আমাদের দেশে বেশ পুরনো। এই দুই পক্ষের মাঝখানে পড়ে জান যায় সাধারণ মানুষের। সম্প্রতি উবার, পাঠাওয়ের মতো অ্যাপনির্ভর জনপ্রিয় পরিবহন সেবা বন্ধ করা এবং মেয়াদোত্তীর্ণ অটোরিকশা অপসারণ করে নতুন অটোরিকশা প্রতিস্থাপনসহ আট দফা দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলা সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। আগামী ২৭ নভেম্বর থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৪৮ ঘণ্টা এই ধর্মঘট পালন করা হবে। তাদের আট দফার দাবির মধ্যে একটি ‘অতিদ্রুত উবার,পাঠাওয়ের মতো অ্যাপনির্ভর পরিবহন সেবা বন্ধ করতে হবে।’ সাধারণ মানুষ সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ঐক্য পরিষদের এমন অযৌক্তিক দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চলছে তিরস্কার।

সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নেতা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলবো, সাধারণ জনগণকে সিএনজি চালকদের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করুন। সঠিক মিটার বসান, মিটার অনুযায়ী চলাচলের বিষয়টি নিশ্চিত করুন। আপনাদের পছন্দমতো নয় সিএনজি অটোরিকশা চালান সাধারণ যাত্রীদের পছন্দে। যাত্রীরা যেখানে যেতে চায় সেখানে নিয়ে যান, মিটার অনুযায়ী ভাড়া নিন। আপনারা এই সংস্কৃতি চালু করলে আমি নিশ্চিত রাজধানীতে চলাচল করা ১৩ হাজারের অধিক সিএনজির সঙ্গে কোনভাবেই পেরে উঠবে না উবার বা পাঠাও। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মানে সরকার যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন কেন আপনারা অ্যাপসভিত্তিক পরিবহণ সেবা বন্ধের কথা কেন বলছেন? যুগের চাহিদা মেটাতে আপনারাও ডিজিটালাইডজ হয়ে সরকারি কোন অ্যাপসের আওতায় আসতে পারেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উবার/পাঠাও যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে সরকারিভাবে নিবন্ধনের মাধ্যমে সিএনজি অটোরিকশাগুলো অ্যাপসের আওতায় আনার দাবি তুলতে পারেন। তাহলেই দেখবেন সাধারণ মানুষ আপনাদের প্রতি আস্থা দেখাবেন। সবার আগে নিজেদের বদলান। ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য বন্ধ করুন, যাত্রীসেবা নিশ্চিত করুন।

প্রিয় পাঠক, ভিন্নমতে প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু, রচনারীতি ও ভাবনার দায় একান্ত লেখকের। এ বিষয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার কোনোভাবে দায়বদ্ধ নয়। ধন্যবাদ।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর