ক্রোয়েশিয়ার কাছে বিশাল হার, খাদের কিনারে আর্জেন্টিনা

ম্যাচের তখন মাত্র শুরু। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে জাতীয় সঙ্গীত। লিওনেল মেসির একটা হাত তার কপালের ডানে বাঁয়ে ছোটাছুটি করছে। আর্জেন্টাইন অধিনায়কের মনের দুশ্চিন্তাটা তখন যেনো ভর করছিলো ওই হাত আর কপালেই। কিছুক্ষণ পর তা ছড়িয়ে পড়লো আগুয়েরোর চোখে-মুখেও। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে এই ম্যাচটা যে তাদের স্নায়ুর এক কঠিন পরীক্ষা নিতে যাচ্ছে, তাই প্রকাশ হয়ে যাচ্ছিলো মেসি-আগুয়োরের ওই রকম বিচলিত উপস্থিতিতে।

ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় ম্যাচটা যখন শেষ হলো, মেসি-আগুয়েরোর শুরুর বিষন্ন মুহূর্ত তখন ছড়িয়ে গেলো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা আর্জেন্টাইন সমর্থকদের মনোজগতেও। ম্যাচটা যে আর্জেন্টিনা হেরে গেছে ৩-০ গোলে এবং প্রায় বিনাযুদ্ধে।

ম্যাচের ৫৩ মিনিটে প্রথম গোল হজম করে আর্জেন্টিনা। সেই গোল ফিরিয়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টাও যখন সফল হচ্ছিলো না, হোর্হে সাম্পাওলি তখন মাঠে নামিয়ে দেন ক্রিশ্চিয়ান পাভন ও গঞ্জালো হিগুইয়েনকে। প্রথম ম্যাচে আর্জেন্টিনার একমাত্র গোলদাতা আগুয়েরোকে উঠিয়ে নিতেও বাধ্য হন সাম্পাওলি। এতে আক্রমণের ধারও বেড়ে যায়।

কিন্তু প্রথম গোল ফেরত দেয়া দূরে থাক, ৮০ মিনিটে গিয়ে দ্বিতীয় এবং ইনজুরি টাইমের প্রথম মিনিটে তৃতীয় গোল হজম করে আর্জেন্টিনা। পুরো ম্যাচে মেসি থাকেন নিষ্প্রভ। তাকে ঠেকিয়ে রেখেও আর্জেন্টাইন রক্ষণ ভেঙে চুরমার করে দেয় ক্রোয়েশিয়া।

মেসি-আগুয়েরো যে অস্থিরতা নিয়ে ম্যাচ শুরু করেন, তা বেড়ে যায় ম্যাচের মাত্র ষষ্ঠ মিনিটেই যখন আর্জেন্টিনার আক্রমণ নস্যাৎ করে দিয়ে দুর্দান্ত এক পাল্টা আক্রমণ করে ক্রোয়েশিয়া। আর্জেন্টিনার ডিফেন্সের দুর্বলতাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন ইভান পেরিসিচ। আর্জেন্টিনার জাল লক্ষ্য করে অসাধারণ শটও নেন তিনি। কিন্তু উইলি ক্যাবালেরো, আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক তার চেয়েও অসাধারণ দক্ষতায় শটটি ঠেকিয়ে দেন।

ঠিক ঠেকিয়ে দেননি তিনি, বরং কোনোমতে বলের পথটা ঘুরিয়ে দেন অন্য দিকে। এই মুহূর্তে আর্জেন্টিনার রাইট উইং-ব্যাককে চোখেই পড়ছিলো না। পেরিসিচ শটটা নিয়ে ফেলেছিলেন একটু দ্রুতই। তা না হলে ম্যাচের মাত্র ষষ্ঠ মিনিটেই পিছিয়ে পড়তে পারতো আর্জেন্টিনা।

শুরুতে এভাবে বেঁচে গিয়ে আর্জেন্টিনা দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু তাদের প্রতিটি আক্রমণ শেষ হয়ে যায় ক্রোয়েশিয়ার গোলবারের সামনে গিয়ে। মেসিকে আরো কার্যকর করে তোলার জন্য তার সতীর্থদের যা করার কথা, তা করতে ব্যর্থ হয় তারা।

ম্যাচের ৩০ মিনিটের মধ্যেই আর্জেন্টিনা ডি মারিয়া ও পাওলো দিবালার শূন্যতা টের পেয়ে যায়। এই ম্যাচে ডি মারিয়াকে ছাড়াই নিজের সেরা একাদশ সাজান হোর্হে সাম্পাওলি। আগের ম্যাচের মতো বাইরে থাকেন দিবালাও।

প্রথমার্ধে সব মিলিয়ে আর্জেন্টিনার তুলনায় বেশি দাপট দেখায় ক্রোয়েশিয়া। আর্জেন্টিনাকে খুব বেশি আক্রমণ করতে না পারলেও, তাদের মধ্যমাঠ ছিলো অসাধারণ। মাশচেরানো-মেসি-আগুয়েরো বারবার আক্রমণ শানানোর চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্তু খুঁজে পাননি কুল-কিনারা। গোলশূন্য অবস্থায় শেষ হয় প্রথমার্ধ। ম্যাচের আর্জেন্টিনার কিছু পাওয়ার সম্ভাবনাও যেনো শেষ হয়ে যায় তখনই।

ম্যাচের ৫৩ মিনিটে গিয়ে গোলরক্ষকের শিশুতোষ ভুলে গোল হজম করে আর্জেন্টিনা। ব্যাক পাস দেয়া বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে ভুল শট করেন ক্যাবালেরো। তার কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আন্তে রেবিচ নিজের শরীর এক দিকে বাঁকিয়ে ডান পায়ের অসাধারণ শটে বল পাঠিয়ে দেন আর্জেন্টিনার জালে। তা জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না ক্যাবালেরোর।

প্রথম গোলের ধাক্কা সামলাতে মরিয়া আর্জেন্টিনা ৮০ মিনিটে গিয়ে হজম করে দ্বিতীয় গোল এবং ম্যাচ থেকে তাদের কিছু পাওয়ার আশা মোটামুটি তখনই শেষ হয়ে যায়। দ্বিতীয় গোলটি করেন লুকা মডরিচ। তারপরও আর্জেন্টিনার যেটুকু আশা টিকে ছিলো, ইনজুরি টাইমের প্রথম মিনিটে গোল করে তা শেষ করে দেন মেসির বার্সেলোনার সতীর্থ ইভান রাকিতিচ।

তিন তিনটি গোল হজম করার পর আর্জেন্টিনার আর ফিরে আসার কোনো সুযোগ ছিলো না। আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ড্র করার ম্যাচে খুব বেশি বোঝা না গেলেও, ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে বেরিয়ে পড়ে এই আর্জেন্টিনার কঙ্কাল। ডাগআউটে দাঁড়িয়ে অস্থির পায়চারি করতে করতে তা দেখেন হোর্হে সাম্পাওলি।

মেসি-আগুয়েরোর বিচলিত-শঙ্কিত মুখাবয়ব, হোর্হে সাম্পাওলির অস্থির পায়চারি, ক্রোয়েশিয়ার কাছে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় পর্ব অনিশ্চিত হয়ে পড়া; এই ম্যাচের পর কেবল এই দৃশ্যগুলোই আর্জেন্টাইন দর্শকদের মনোজগতে ঘোরার কথা। অথচ কী স্বপ্ন নিয়েই না আজ তারা খেলাটা দেখতে বসেছিলেন!