রুমেলু লুকাকু। ২৫ বছর বয়সী বেলজিয়ান পেশাদার ফুটবলার। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এ স্ট্রাইকার ক্লাব ক্যারিয়ারে বর্তমানে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে খেলছেন। বেলজিয়াম জাতীয় ফুটবল দলের একমাত্র বিজ্ঞাপন হয়ে অংশ নিয়েছেন ২০১৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ ও ২০১৬ সালের ইউরো কাপে। খেলছেন ২০১৮ সালের বিশ্বকাপও। একজন সফল ফুটবলার হয়ে ওঠার জন্য লুকাকু জীবনে যে অবিশ্বাস্য পথ পাড়ি দিয়েছেন তা বুঝি কল্পকাহিনীকেও হার মানায়। দৃঢ় মুঠিবদ্ধ সংকল্পসহায় বন্ধুর সে পথ পাড়ি দেয়ার গল্প শুনুন লুকাকুর মুখেই।

romelu lukaku main image

“সুনির্দিষ্টভাবে ঠিক ওই ক্ষণটাই আমি মনে করতে পারি, ঠিক যে ক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম আমাদের পরিবারটা আসলে ভেসে যাচ্ছে। ওই সময়ে বাসার ফ্রিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমার মায়ের মুখ এবং তার মুখে লেগে থাকা ছাপ এখনও আমার চোখে লেগে আছে।

আমার বয়স তখন মাত্র ছয়। প্রতিদিন লাঞ্চ ব্রেকে স্কুল থেকে বাসায় আসি। লাঞ্চ মেন্যু কিন্তু নির্ধারিত। এমন কোনো দিন নেই যে, মা আমার জন্য টেবিলে ব্রেড এবং দুধ রাখতেন না। ওই ছোট বয়সে আমার ধারণা ছিলো, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Romelu Lukaku four

একদিনকার ঘটনা। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও লাঞ্চ ব্রেকে বাসায় আসলাম। ঘরে ঢুকেই কিচেনের দিকে হাঁটা ধরলাম। দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম মাকে, আমার জন্য দুধ রেডি করছেন। হঠাৎ মনে হলো, মা যেনো দুধের সাথে কিছু একটা মেশাচ্ছেন। দুধের বোতলটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে মা লাঞ্চ নিয়ে এলেন আমার কাছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। অবশ্য মায়ের আচরণ দেখে মনে হচ্ছিলো, সবকিছুই যেনো স্বাভাবিক। হঠাৎ সবকিছুই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে এলো আমার সামনে।

আমার মা দুধের সাথে পানি মেশাচ্ছিলেন। আমাদের কাছে পুরো সপ্তাহ চলার মতো দুধ ছিলো না। আবার দুধ কিনে নিয়ে আসার মতো পর্যাপ্ত টাকাও ছিলো না। আমরা একেবারে অভাবী ছিলাম। দরিদ্র না, তারচেয়েও অভাবী। সেই প্রথম আমার মনে হলো, আমরা আসলে ভেসে যাচ্ছি।

বাবা ছিলেন একজন পেশাদার ফুটবলার। কিন্তু আমি ওই সময়ের কথা বলছি, যখন তার ক্যারিয়ার একেবারে পড়তির দিকে। অর্থকড়ি যা আয় করেছিলেন তার সবই এখন যাওয়ার পথে। প্রথম যে জিনিসটা ঘর থেকে চলে গেলো সেটি হলো টিভি। টিভির সাথে সাথে ফুটবলও দূর হলো ঘর থেকে।

রাতে যখন বাসায় ফিরতাম দেখতাম বাড়ির সমস্ত লাইট নেভানো। বুঝতাম, ইলেক্ট্রিসিটিও নেই। এভাবে দুই কিংবা তিন সপ্তাহের জন্য অন্ধকারে থাকতে হতো আমাদের। গোসল নিতে গিয়ে দেখতাম গরম পানিও নেই। মা তড়িঘড়ি করে স্টোভে এক কেতলি পানি গরম করে দিতেন। আমি বাথরুমে দাঁড়িয়ে ছোট কাপে করে পানি নিয়ে সেই পানি দিয়ে গোসল সারতাম।

এক সময় মা পাড়ার দোকান থেকে বাকিতে ব্রেড কিনে আনা শুরু করলেন। দোকানদার আমাকে আর আমার পিচ্চি ভাইটাকে চিনতো। আমাদের ওপর দয়াপরবশ হয়েই কিনা ওই দোকানদার শুক্রবারে টাকা পরিশোধের শর্তে সোমবারে মায়ের হাতে এক টুকরো ব্রেড তুলে দিতো।

romelu lukaku two

আমি ওই ছয় বছর বয়সেই জানলাম, জীবনযুদ্ধে আমরা সংগ্রাম করছি। কিন্তু যেদিন মাকে দুধের সাথে পানি মেশাতে দেখলাম সেদিন আমি বুঝলাম, আসলে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। সেদিন আমি ‘সংগ্রাম’ শব্দটাকে পুরোপুরি উপলব্ধি করলাম। বুঝতে শিখলাম, আসলে এটাই আমাদের জীবন।

ওই দুপুরে আমি একটা কথাও বলিনি। এ নিয়ে মাকে কিছু জিজ্ঞাসাও করিনি। নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করে উঠে গেলাম। কিন্তু ওই দিনই, ওই দুপুরেই আমি নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। আমি জেনে গেলাম, আমাকে আসলে কী করতে হবে এবং আমি কী করতে চলেছি। এটা অনেকটা এমন যেনো কেউ আমাকে একটা চড় মেরে নিশ্ছিদ্র ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে গেলো।

সংসারে আমি আমার মাকে ওই হতদরিদ্র অবস্থায় কখনোই দেখিনি এবং দেখতেও পারছিলাম না। না না না…

romelu lukaku three

ফুটবলমোদীরা খেলোয়ারদের মানসিক শক্তিমত্তা নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে। আমি মনে করি, তুমি তোমার জীবনে আমার চেয়ে প্রবল মানসিক শক্তির অধিকারী কাউকে পাবে না। আমার এখনও মনে আছে- আমি, আমার ছোট ভাই এবং মা, তিনজনে মিলে অন্ধকারে বসে প্রার্থনা করতাম। আগামীতে কী ঘটতে যাচ্ছে তা আমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম।

আমার প্রতিজ্ঞা আমার নিজের মনের মধ্যেই সুপ্ত ছিলো। কিন্তু মাঝে মাঝেই স্কুল থেকে ফিরে মাকে কাঁদতে দেখতাম। অবশেষে একদিন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। মাকে সেদিন বললাম, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে মা। তুমি দেখো, খুব শিগগিরই আমি আন্দেরলেখট ক্লাবে ফুটবল খেলবো। আমরা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবো। তোমার আর কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না।

তখন আমার বয়স মাত্র ছয়। বাবাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, কখন থেকে পেশাদারি ফুটবল খেলা যায়? বাবা জানালেন, ১৬ বছর বয়স থেকে। সেই থেকে আমিও ’১৬ বছর বয়স’-এর অপেক্ষায় রইলাম।

romelu lukaku ten

এই সময়টাতে আমি কিন্তু বসে ছিলাম না। প্রতিটি মুহূর্তে আমি আমার প্রতিজ্ঞার দিকে এগিয়ে গেছি। ওই সময় থেকেই আমি যতো ম্যাচ খেলেছি সবই ছিলো আমার কাছে ফাইনাল ম্যাচ। যখন পার্কে ফুটবল খেলছি, সেটা আমার জন্য ফাইনাল ম্যাচ। টিফিনের সময় কিন্ডারগার্টেনে খেলছি, সেটা আমার জন্য ফাইনাল ম্যাচ। আমি এক অন্ধের মতো আমার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে শুরু করেছিলাম। বলে শট করার সময় প্রতিটা শটে আমি বলটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে চেয়েছি। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে আমি বলে লাথি দিতাম। কিক করার সময় কোনো চাতুর্য্যের ধার ধারতাম না আমি। আমি জানতাম, এটা প্লে স্টেশনের ফিফা গেইম নয়। আমি সেটা কখনও খেলিওনি। সোজা কথায় আমি জাস্ট ‘মেরে’ ফেলার জন্য বলে কিক করতাম।

একসময় আমি লম্বা হতে শুরু করলাম। অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই লম্বা। স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক এবং কিছু গার্ডিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রূকুটি করতেন। আমার তো বেশ মনে আছে, যেদিন একজন বয়স্ক ব্যক্তি আমাকে আমার বয়স জিজ্ঞাসা করলেন। আমার জন্ম সাল জানতে চাইলেন।

এগারো বছর বয়সে আমি যখন লিয়ার্সা ইয়ুথ টিমে খেলছি তখন একদিন প্রতিপক্ষ দলের একজন খেলোয়ারের বাবা-মা এসে আমাকে মাঠে নামতে বাধা দিলেন। তারা বারবার জানতে চাইছিলেন, এই বাচ্চার বয়স কতো? তার আইডেন্টিটি কার্ড কোথায়? সে কোত্থেকে এসেছে?

আমি তখন মনে মনে ভাবি, কোত্থেকে এসেছি মানে? আমি এই এন্টর্পে জন্ম নিয়েছি। আমি একজন বেলজিয়ান।

Romelu Lukaku seven

অন্যদের মতো আমার বাবা আমার সাথে থাকতেন না। এর কারণও ছিলো অবশ্য। আমাদের কোনো গাড়ি ছিলো না। সুতরাং দূরের কোনো খেলায় আমাকেই একা একা যেতে হতো। অন্য গার্ডিয়ানদের তোপের মুখে পড়ে আমি গিয়ে আমার আইডি কার্ড নিয়ে আসলাম। আনার পর তারা আমার আইডি কার্ড নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু করে দিলো। ততোক্ষণে আমার শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। আমি শুধু তখন মনে মনে বলছি, তোমাদের ছেলেকে আমি শুধু খেলায় হারাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এখন আমি তাদের একেবারে দুমড়ে মুচড়ে দিবো। তোমাদের ছেলেরা একেকজন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি যাবে।

আমি সব সময়ই বেলজিয়ান ইতিহাসের সেরা ফুটবলার হতে চেয়েছি। ভালো ফুটবলার নয়, গ্রেট ফুটবলারও নয়। এটাই ছিলো আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। প্রচণ্ড রাগ নিয়ে আমি প্রতিটি খেলায় অংশগ্রহণ করেছি। খেলার সময় আমার মাথায় থাকতো, আমাদের সারা ঘরময় ইঁদুরেরা ছোটাছুটি করে… একটা টিভির অভাবে আমি চ্যাম্পিয়নস লীগ দেখতে পারি না… কেনো অন্যান্য গার্ডিয়ানরা আমার দিকে এমন অদ্ভুতভাবে তাকায়…

আমি একটা লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়েছি। আমার একটা মিশন ছিলো। যখন আমার বয়স ১২, তখনই আমি ৩৪ ম্যাচে ৭৬ গোল করে ফেলি। এই এতোসব গোল আমি আমার বাবার জুতো পরে করেছি। একটা সময় যখন আমি আরেকটু লম্বা হয়ে উঠলাম তখন বাবা আর আমার পা সমান সাইজের হয়ে গেলো। তখন এক জোড়া জুতো দুজনে শেয়ার করতে আর কোনো বাধাই ছিলো না।

romelu lukaku nine

এরইমধ্যে আমার নানা একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমার মায়ের বাবা। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষগুলো আমার জীবনের সাথে মিশে আছেন তার মধ্যে তিনি একজন।

বাবা-মায়ের আদি নিবাস কঙ্গোর সাথে এই নানাই ছিলেন একমাত্র যোগসূত্র। বড়ো উৎসাহের সাথে নানাকে ফোন করলাম আমি। ফোন ধরেই বললাম, তুমি কি জানো, আমি এখন সত্যি সত্যিই ভালো করছি। এই সিজনে আমি ৭৬টি গোল করেছি এবং শেষ পর্যন্ত লীগশিরোপাও আমাদের দখলে এসেছে। সামনে ভালো কিছু আমাকে হাতছানি দিচ্ছে।

নানা সাধারণত ফোন করে আমার খেলাধুলার খবরই নিতেন। কিন্তু ওইদিন যেনো কিছু একটা হয়েছিলো। নানা বললেন, খুবই ভালো সংবাদ। পরক্ষণেই বললেন, তুমি কি আমার একটা উপকার করতে পারবে?

আমি একটু অবাক হলেও সাথে সাথেই বললাম, অবশ্যই পারবো। বলো, সেটা কী?

তিনি অদ্ভুত এক গলায় বললেন, তুমি কি আমার মেয়েকে দেখে-শুনে রাখতে পারবে, প্লিজ?

আমি তখন পুরোপুরি ধন্দে পড়ে গেলাম। নানা হঠাৎ এমন প্রসঙ্গে কেনো কথা বলছেন? আমি বললাম, মায়ের কথা বলছো? আমরা খুবই ভালো আছি।

তিনি বললেন, না, তুমি আমার সাথে প্রতিজ্ঞা করো। পারবে? তুমি শুধুমাত্র আমার মেয়েকে দেখে-শুনে রাখবে, যত্নে রাখবে। পারবে প্রতিজ্ঞা করতে?

আমি তখনই নানার সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। জীবন থাকতে মাকে কখনোই কষ্ট দেয়া যাবে না।

এর পাঁচ দিন পরই নানা মারা গেলেন। আমি বুঝলাম, নানা আসলে আমাকে কী বুঝাতে চেয়েছিলেন। আমার খুবই কষ্ট হতে লাগলো এই ভেবে যে, আর চারটা বছর বেঁচে থাকলে নানা নিজেই আমাকে আন্দেরলেখট ক্লাবে খেলতে দেখে যেতে পারতেন। তিনি দেখে যেতে পারতেন যে, আমি তাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রেখেছি। সবকিছু একদম ভালোভাবে এগুচ্ছে।

মাকে বলেছিলাম, দেখো, ১৬ বছর বয়সেই তোমার ছেলে লীগে খেলে দেখাবে। কিন্তু আমি সেটা পারিনি। আমার ১১ দিন দেরি হয়ে গিয়েছিলো।

romelu lukaku eight

২০০৯ সালের ২৪ মে। সেই দিনটি এখনও চোখে ভাসে। আন্দেরলেখট আর স্ট্যান্ডার্ড লিগের মাঝে প্লে অফ ফাইনাল চলছে। কোচ আমাকে অনূর্ধ্ব-১৯ টিমের বেঞ্চে বসিয়ে রেখেছেন। আমি বেঞ্চে বসে বসে নিজেকে গালমন্দ করি আর ভাবি, এখনও যদি মাঠের বাইরে বসে কাটাতে হয় তাহলে লীগ খেলবো কীভাবে?

ভাবতে ভাবতেই ওইদিন কোচের সাথে বাজি ধরে বসলাম।

কোচকে বললাম, যদি তুমি আমাকে খেলাও তাহলে কথা দিচ্ছি, ডিসেম্বরের মধ্যেই ২৫টা গোল দিবো।

কোচ আক্ষরিক অর্থেই আমার কথা শুনে হেসে উঠলেন। আমি কিন্তু নাছোড়বান্দা। এবার কোচকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করলাম। তিনি সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। সাথে এই হুমকিও দিলেন, যদি ব্যর্থ হই তাহলে আবার আমাকে বেঞ্চে পাঠিয়ে দিবেন।

কিন্তু আমি তো হাল ছাড়ার পাত্র নই। আমি বললাম, যদি বাজিতে আমি জিতি তাহলে আমার দুটো আবদার আছে। প্রথমটা হচ্ছে, খেলোয়াড়দেরকে বাসা থেকে মাঠে আনা-নেয়ার জন্য যে মিনিভ্যানগুলো আছে সেগুলো পরিষ্কার করতে হবে। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে, আমাদেরকে প্রতিদিন প্যানকেক দিতে হবে খাওয়ার জন্য। কোচ এক কথায় তা মেনে নিলেন। এটা সম্ভবত পৃথিবীর কোনো মানুষের ধরা সবচেয়ে বাজে চ্যালেঞ্জ ছিলো।

নভেম্বরের মধ্যেই আমি ২৫ গোল দিলাম! আর ক্রিস্টমাসের আগেই আমি এবং আমার টিম প্যানকেক খেতে লাগলাম। এই ঘটনা একটা শিক্ষা দেয়। ক্ষুধার্ত মানুষের সাথে কখনোই কোনো চ্যালেঞ্জ নয়।

romelu lukaku belgium striker

মে মাসের ১৩ তারিখ, আমার জন্মদিনে আন্দেরলেখটের সাথে আমার চুক্তি হলো। ওইদিনই সোজা বাসায় গিয়ে আমি ক্যাবল সংযোগ নিলাম। ওই বছরের জন্য ফুটবল সিজন প্রায় শেষের দিকে। কিন্তু সিজনটা যে কী পরিমাণ রোমাঞ্চকর ছিলো তা বলে বুঝানো যাবে না! সমান সমান পয়েন্ট নিয়ে আন্দেরলেখট এবং স্ট্যান্ডার্ড লিগ মুখোমুখি। শিরোপা নির্ধারণের জন্য দুই দলকেই দুইটি প্লে অফ ম্যাচ খেলতে হবে।

প্রথম লেগের দিন আমি বাসাতেই ছিলাম। একজন পাঁড় ফুটবল ভক্তের মতো টিভিতে খেলা দেখে কাটিয়েছি। ঘটনা ঘটলো দ্বিতীয় লেগের আগের দিন। রিজার্ভ বেঞ্চের কোচ আমাকে ফোন দিলেন।

- হ্যালো?

- হ্যালো, রোম। কী করছো?

- এই তো, পার্কে যাবো। ফুটবল খেলতে।

- না, না, না… এক্ষুণি তোমার ব্যাগ গুছাও। এক্ষুণি…

- মানে! কী বলছো এসব?!!

- হুম্ম, তুমি এক্ষুণি স্টেডিয়ামে চলে আসো। মূল একাদশ তোমাকে চাচ্ছে…

- মানে! আমি!!!

- ইয়েস, তুমি। দ্রুত চলে আসো।

আক্ষরিক অর্থেই আমি দৌঁড়ে বাবার রুমে গেলাম। গিয়ে শুধু বললাম, উঠো। আমাদেরকে যেতে হবে। বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায়? আমি বললাম, আন্দেরলেখট!

romelu lukaku five

ওই মুহূর্তটি আসলে ভোলার মতোন নয়। আমি স্টেডিয়ামে ঢুকে এক রকম দৌঁড়েই গেলাম ড্রেসিং রুমে। কিটম্যান আমাকে বাচ্চা বলেই সম্বোধন করলো। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, জার্সি নাম্বার কতো চাও? আমি বললাম, আমাকে ১০ নম্বর জার্সি দাও।

ওই কথা মনে হলে এখনও হাসি পায়। সম্ভবত কাঁচুমাচু হওয়া বা ইতস্তত করাটা আমার ধাঁতে ছিলো না। তখন বেশ অনেকটা ছোট ছিলাম বলেই হয়তো।

কিটম্যান জানালো, একাডেমির খেলোয়াড়দের ৩০ নম্বরের পর থেকে জার্সি চয়েজ করতে হয়।

আমি বললাম, ঠিক আছে। তিন আর ছয় যোগ করলে নয় হয়। মনে হচ্ছে, নম্বরটা ভালোই হবে। আমাকে ৩৬ দাও। জার্সি নম্বর ৩৬ পছন্দ করে নিলাম আমি।

রাতে হোটেলে দলের সিনিয়র খেলোয়াড়দের সাথে ডিনার হলো। ওখানে সবাই মিলে আমাকে একটা গান গাইতে বললেন। গানটা শুধুই তাদের জন্য হতে হবে। আমি আসলে তখন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। মাথা পুরোপুরি ঘুরছে। কী গান গেয়েছিলাম, কতোক্ষণ গেয়েছিলাম, কিছুই মনে নেই আমার।

পরদিন সকালে একটা মজার ঘটনা ঘটলো। সকালে বাড়িতে এক বন্ধু এসে হাজির। মার সাথে দেখা হতেই আমার কথা জিজ্ঞেস করলো, রোমেলু কোথায়? আমরা ফুটবল খেলতে যাবো।

মা কিন্তু নির্লিপ্ত। এই নির্লিপ্ত কণ্ঠ নিয়েই তিনি বললেন, রোমেলু বাইরে খেলতে গিয়েছে।

- কোথায়?

- ফাইনাল!

lukaku twelve

খেলোয়াড়দের নিয়ে আমাদের বাসটা যখন স্টেডিয়ামে গিয়ে থামলো তখন ধীর পায়ে নেমে যাচ্ছিলো সবাই। সিনিয়র প্রত্যেক খেলোয়াড়ই স্যুট পরা ছিলো। একমাত্র আমার গায়েই পাড়ার মাঠে খেলা করার ট্র্যাকস্যুট। প্রত্যেকটা টিভি ক্যামেরা যেনো আমার মুখ বরাবর ধেয়ে এলো। বাস যেখানে থামিয়েছে সেখান থেকে ড্রেসিং রুমটা ৩০০ মিটার দূরে। অন্তত তিন মিনিটের হাঁটা। ওই পথটুকু আমি কীভাবে যে এলাম, আমি নিজেও জানি না। কোনো মতে নিজেকে ড্রেসিং রুমে এনে লুকালাম।

আমার ফোন তখন সমানে বাজছে। পরিচিতরা সবাই ততোক্ষণে আমাকে টিভিতে দেখে ফেলেছে। বিশেষ করে আমার বন্ধুরা একেকজন ক্ষেপাটে হয়ে গেছে বুঝতে পারছি। মাত্র তিন মিনিটে আমার মোবাইল ফোন ২৫টি এসএমএস এসে হাজির!

“হেই, কী হচ্ছে এসব? তোমাকে টিভিতে দেখতে পাচ্ছি…”

“রোম, তুমি খেলায় কেনো?!!”

আমি শুধু আমার বেস্ট ফ্রেন্ডটাকেই ফিরতি এসএমএস পাঠালাম। “বন্ধু, আমি আসলে জানি না, কী ঘটতে চলেছে। আমি আজ খেলতেও পারি, নাও পারি। তুমি শুধু টিভিতে চোখ রাখো।”

খেলার ৬৩ মিনিটে সেই আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি এলো। কোচ আমাকে একজনের বদলি হিসেবে মাঠে নামালেন। আমি আন্দেরলেখটের হয়ে মাঠে নামলাম। আমার বয়স তখন ১৬ বছর ১১ দিন।

আমরা সেদিন ম্যাচটা হেরেছিলাম। কিন্তু আমার অবস্থাটা ছিলো একেবারেই ভিন্ন। আমি যেনো স্বর্গে ছিলাম বলে মনে হচ্ছিলো আমার কাছে। মা এবং নানার কাছে করা প্রতিশ্রুতি আমি রক্ষা করতে পেরেছি। ওটা এমন একটা মুহূর্ত ছিলো, যে সময় আমি বুঝতে পারলাম যে, সবকিছু ভালোমতোই চলছে।

romelu lukaku end

পরবর্তী বছরটা আরও ভালো গেলো। আমার তখন হাই স্কুলের শেষ বছর চলছে। একইসাথে আমি ইউরোপা লীগেও খেলছি। স্কুলে যাওয়ার সময় প্রতিদিন ইয়া বড় এক ব্যাগ নিয়ে যেতাম। পরে স্কুল থেকেই মাঠে চলে যেতাম। ওই বছর আমরা লীগ শিরোপা জিতে যাই। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিলো যে, সেবারই আমি বছরের সেরা আফ্রিকান খেলোয়াড় নির্বাচিত হই!

সবকিছু আমার প্রত্যাশা মতোই হচ্ছিলো। কিন্তু সম্ভবত খুবই ধীরে ধীরে। হঠাৎই পত্রপত্রিকাগুলো আমাকে নিয়ে হইচই শুরু করে দিলো। প্রত্যাশার ফুলঝুরি সাজিয়ে আমাকে তারা অনেক উপরে উঠিয়ে নিয়ে এলো। কিন্তু কোথাও একটা সমস্যা ছিলো বলে আমার মনে হয়। জাতীয় দলে আমি অতোটা ভালো খেলছিলাম না। কেনো যেনো হচ্ছিলো না। অবশ্য, আমার বয়স তখন আর কতোই বা ছিলো। ধীরে ধীরে তিনটা বছর শেষ হলো। ১৭, ১৮ শেষ করে আমি ১৯ বছরে পা দিলাম।

সবকিছু ঠিকঠাক মতোই যাচ্ছে। এরই মধ্যে একদিন পত্রিকা পড়তে গিয়ে খেয়াল করলাম, পত্রিকায় লিখা হচ্ছে ‘রোমেলু লুকাকু, বেলজিয়ান স্ট্রাইকার’!

অথচ এই আমিই যখন মাঠে অনুজ্জ্বল ছিলাম, তখন আমাকে ডাকা হতো, ‘রোমেলু লুকাকু, কঙ্গো বংশোদ্ভূত বেলজিয়ান স্ট্রাইকার’।

তুমি যদি আমার খেলা পছন্দ না করো, তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমি এই দেশে জন্ম নিয়েছি। আমি এই এন্টর্প, লিজ আর ব্রাসেলসে বেড়ে উঠেছি। আন্দেরলেখটে খেলা ছিলো আমার স্বপ্ন। আমি সারা জীবন ভিন্সেন্ট কোম্পানির মতো হতে চেয়েছি। আমার মুখের প্রথম ভাষা ছিলো ফ্রেঞ্চ, পরে ডাচ শিখেছি। স্প্যানিশ, পর্তুগিজ বা লিঙ্গালা বলেছি কালে-ভদ্রে; কোথায় আছি তার ওপর নির্ভর করে। তারপরও আমি কেনো আফ্রিকান হবো?

আমি একজন বেলজিয়ান। আমরা সবাই বেলজিয়ান। আমরা সবাই মিলেই এই দেশে আছি।

lukaku celebration

আমি বুঝতে পারি না, আমার দেশের কিছু মানুষ আমাকে বরাবরই কেনো যেনো ব্যর্থ হিসেবে দেখতে চায়। আমি সত্যিই বুঝি না। যখন চেলসির সাইড বেঞ্চে বসা থাকতাম তখনও দেখতাম কিছু মানুষ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। একসময় ওয়েস্ট ব্রোম আমাকে ধারে খেলাতে নিয়ে গেলো, তখনও দেখেছি কিছু মানুষ আমাকে নিয়ে হাসছে।

একসময় আমি এটা মেনে নিয়েছি। যখন আমাদের কষ্টের দিনকাল তখন যারা আমাদের এড়িয়ে চলতো, এই মানুষগুলো আসলে তারাই। আমি মনে করি, আমার দুঃসময়ে কাছে না এলে তুমি আমাকে কখনোই বুঝতে পারবে না।

মজার ব্যাপার কী জানো, আমি যখন ছোট তখন দশটা বছর আমি চ্যাম্পিয়ন লীগ ফুটবল দেখতেই পারিনি। হ্যাঁ, দশটা বছর। আসলে এটা আমাদের জন্য সম্ভবও ছিলো না। আমি স্কুলে এসে শুনতাম প্রত্যেকটা ছেলে ফাইনাল ম্যাচ নিয়ে আলোচনা করছে। অথচ আমার কোনো ধারণাই ছিলো না এ ব্যাপারে। ২০০২ সালের একটা ঘটনা মনে পড়ে, সেবার মাদ্রিদ আর লিভারকুজেনের খেলা ছিলো। পরদিন স্কুলে সবাই বলাবলি করছিলো, ‘কী দারুণ খেলা, বিশেষ করে ওই ভলিটা, ওহ মাই গড!’

আমি কিছুই জানতাম না। অথচ আমাকে ভান করতে হতো তারা যে বিষয়ে কথা বলছে সেটা আমি জানি।

দুই সপ্তাহ পর যখন কম্পিউটার ক্লাসে গেলাম তখন আমার এক বন্ধু ইন্টারনেট থেকে ওই খেলার ভিডিও ডাউনলোড করলো। এবং শেষপর্যন্ত আমারও ভাগ্য হলো ওইদিনের ম্যাচের সেই দুর্দান্ত ভলি দেখার।

ওই বছর গ্রীষ্মে বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখতে আমি আবার সেই বন্ধুর বাড়িতে গেলাম। রোনালদোকে সেই আমার দেখা। আর টুর্নামেন্টের বাকি সবকিছুই স্কুলে আমার বন্ধুদের মুখে মুখে শুনে শুনে কাটিয়েছি।

আমার মনে আছে, বেশ ভালো করেই মনে আছে, ২০০২ সালে আমার জুতায় একটা ছিদ্র ছিলো। বড়সড় একটা ছিদ্র।

এর ঠিক বারো বছর পর আমি ফুটবল বিশ্বকাপ খেলেছি!

lukaku in kazan

এখন আমি আরেকটা বিশ্বকাপ খেলছি। আমার ভাইও আমার সাথে ফুটবল খেলে। একইরকম অভাবে থেকে, একটা পরিবার থেকে দুইটা ছেলে জাতীয় দলে খেলছে, এটা কীভাবে সম্ভব! এখানে একটা কথা আপনাকে মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন ঘটনা আর চাপ সামলাবার জন্য জীবনটা আসলে খুবই ছোট। মানুষ আমার দল বা আমার ব্যাপারে যা খুশি ভাবতে পারে, এতে আমার কিছু যায় আসে না।

যখন বাচ্চা ছিলাম, তখন আমরা ম্যাচের দিন কখনোই টিভিতে থিয়েরি হেনরিকে দেখতে পাইনি। সত্যি বলতে, আমাদের সে সামর্থ্যই ছিলো না। অথচ এখন প্রতিদিন আমরা তার কাছ থেকেই শিখি। এখন আমি প্রতিদিন রক্ত-মাংসের ওই কিংবদন্তির সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করি। তিনি আমাকে শেখান, কীভাবে শূন্যে দৌড়াতে হয়, ঠিক নিজে তিনি যেভাবে দৌড়াতেন। থিয়েরিই সম্ভবত পৃথিবীতে একমাত্র ব্যক্তি যে আমার চেয়েও বেশি ফুটবল ম্যাচ দেখেছে। আমরা সবকিছু নিয়ে তর্ক করি। জার্মানীর সেকেন্ড ডিভিশন ফুটবলও আমাদের তর্কের বাইরে নয়।

কথার কথা, আমি হয়তো থিয়েরিকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি ফরচুনা ডুসেলডর্ফের খেলার কৌশল দেখেছো?

সে উত্তর দিবে, মজা করো না। আমি অবশ্যই ওই ম্যাচটা দেখেছি।

এর চেয়ে আনন্দের, মজার এবং উপভোগের জীবন আর কী হতে পারে!

romelu lukaku eleven

আমার খুব ইচ্ছা হয়, ঠিক এই সময়ে নানা যদি বেঁচে থাকতেন, আমার এই সাফল্য দেখে যেতে পারতেন…। না, না, আমি প্রিমিয়ার লীগে খেলার কথা বলছি না। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের কথাও না। এমনকি বিশ্বকাপও নয়।

নানা যদি একবার আমাদের বর্তমান জীবনযাপন দেখে যেতে পারতেন। তিনি যদি আমাকে আরেকটাবার ফোন দিতেন, আমি যদি তাকে জানাতে পারতাম…

‘দেখো, আমি তোমাকে বলেছিলাম না? তোমার মেয়ে বেশ ভালো আছে। আমাদের ঘরে এখন আর ইঁদুর নেই। আমরা এখন আর ফ্লোরে ঘুমাই না। আমাদের কোনো হতাশা নেই, চাপ নেই। আমরা খুব ভালো আছি। খুব ভালো। এখন কেউ আর আমার আইডি চেক করতে আসে না। কারণ তারা সবাই আমার নাম জানে!"

Stay on top of the latest sports news, including cricket and football, from around the world. Get comprehensive coverage of matches, tournaments, and leagues— along with expert analysis and commentary from our team of sports journalists. Whether you're a die-hard fan or a casual observer, you'll find everything you need to know about your favorite sports here.

Sports, cricket, and football are popular topics in the world of sports. Cricket is a bat-and-ball game played between two teams of eleven players and is particularly popular in South Asian countries. Football, also known as soccer, is a team sport played with a spherical ball between two teams of eleven players and is widely popular worldwide. Sports enthusiasts follow the latest news, matches, tournaments, and leagues in these sports and analyze and comment on the performances of players and teams.