কথায় আছে, 'মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়'। উক্তিটিতে কিন্তু কোন ধরনের মানুষ, তা বলা হয়নি। অর্থাৎ শুধু মানুষের কথা বলা হয়েছে। সেই উক্তিটিকেই যেন বাস্তবে প্রমাণ করলেন জেসিকা কক্স। এখন আপনি বলতে পারেন, এমন কত মানুষই তো আছে যারা নিজের স্বপ্নকে ছুঁতে পেরেছে, এ আর এমন কী? এক্ষেত্রে আপনার যুক্তি সত্য! কিন্তু কিছুটা ভুল রয়ে গেছে। একজন পরিপূর্ণ মানুষের স্বপ্ন ছোঁয়া আর একজন অপরিপূর্ণ মানুষের স্বপ্ন ছোঁয়া যে এক নয়।

jessica cox pilotপা দিয়েই বিমান চালাচ্ছেন জেসিকা কক্স

আমি যার কথা বলছি, সেই মানুষটি আর বাকি আট-দশ জনের মতো পরিপূর্ণ নয়। তার দুই হাত নেই। হাত ছাড়াই তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তিনি একজন নারী। এবার আসি তার বিশেষ গুণাবলীর কথায়।

জেসিকা কক্স একাধারে সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত যুদ্ধবিমানের পাইলট, যুক্তরাষ্ট্রের তায়কোয়ান্দো অ্যাসোসিয়েশন থেকে ব্ল্যাক বেল্ট প্রাপ্ত মার্শাল আর্ট চ্যাম্পিয়ন, মোটিভেশনাল স্পিকার। এ ছাড়া তিনি সার্টিফিকেট প্রাপ্ত গাড়ি চালক, পিয়ানো বাদক, স্কুবা ড্রাইভার হিসেবেও তার বেশ সুনাম আছে। এমনকি পা দিয়েই কম্পিউটারের কি বোর্ডে এক মিনিটে ২৫টি শব্দ টাইপ করতে পারেন। গড়েছেন দুই দুইবার গিনেস বুক অব ওয়াল্ড রেকর্ড।

পেছনের গল্প

অসাধারণ প্রতিভাবান এই মানুষটির আজকের অবস্থায় আসার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান তার বাবা-মার। তারা কখনোই নিজের মেয়েকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেখেননি। হাতবিহীন থাকা সত্ত্বেও তার অন্য ভাইবোনদের মতো স্বাভাবিকভাবে বড় করেছেন। বিশেষ স্কুলে না পাঠিয়ে সাধারণ স্কুলে পাঠিয়েছেন। এমনকি পাইলট হওয়ার প্রস্তাবে জেসিকা কক্সের আগে তার বাবাই সম্মতি দিয়েছিলেন।

১৯৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন জেসিকা কক্স। জন্মের পর মেয়ের হাত না থাকায় অনেক কষ্ট পান তার মা। মাতৃত্বকালীন কোনো জটিলতা না থাকায় হাতবিহীন শিশুর জন্মগ্রহণ করায় আশ্চর্য বনে যান চিকিৎসকরাও। এটিকে বিরল জন্মগত ত্রুটি হিসেবে মনে করেন তারা। এরপর মেয়েকে স্বাভাবিক জীবন দেয়ার জন্য বাবা-মা কৃত্রিম হাত লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তা ছোট্ট জেসিকার মোটেই পছন্দ হয়নি।

jessica cox pianuপা দিয়েই পিয়ানো বাজাচ্ছেন জেসিকা কক্স

নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা

ইচ্ছে হতো কৃত্রিম হাতগুলো পুড়িয়ে ফেলার। তবুও কষ্ট করে সেগুলো ১১ বছর ধরে পড়ে ছিলেন। এরপর ১৪ বছর বয়সে হাত দুটো খুলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন জেসিকা। পরবর্তীতে আর কখনোই কৃতিম হাত পরেননি তিনি। স্কুলে থাকাকালীনই ট্যাপ ডান্স ও গার্লস স্কাউটের সাঁতার শেখা শুরু করেন। পরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচ করতেন এবং স্কুলের খেলাধুলার ইভেন্টগুলোতেও স্বাভাবিক প্রতিযোগীদের সঙ্গে অংশ নিতেন।

হাত না থাকা সত্ত্বেও পরিবার থেকে স্বাভাবিক জীবন পেলেও স্কুলে এ নিয়ে বেশ বিপাকে পড়তে হতো জেসিকাকে। হাত নেই বলে সহপাঠীরা সব সময় তাকে রাগিয়ে তুলতো। এতে মানসিকভাবে কিছুটা আঘাত পেলেও প্রচণ্ড রাগে পা ছুঁড়তেন, চিৎকার করতেন। আর তা দেখেই একদিন মেয়েকে মার্শাল আর্ট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন তার বাবা। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর।

মার্শাল আর্ট চ্যাম্পিয়ন

জেসিকাকে এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই ওই স্কুল থেকে প্রথম ব্ল্যাক বেল্ট প্রাপ্ত হন। এরপর ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনায় ভর্তি হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের তায়কোয়ান্দো অ্যাসোসিয়েশনে ট্রেনিং নিতে শুরু করেন। সেখান থেকেই দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্ল্যাক বেল্ট অর্জন করেন তিনি। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে তায়কোয়ান্দোতে অ্যারিজোনা স্টেট চ্যাম্পিয়নের খেতাব অর্জন করেন। আর এই খেতাব জিততে স্বাভাবিক প্রতিযোগীদের সঙ্গেই লড়াই করেন। এর মধ্য দিয়ে প্রথম ও একমাত্র হাতবিহীন তায়কোয়ান্দো চ্যাম্পিয়ন হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়াল্ড রেকর্ডে নাম লেখান।

jessica cox taykuandoমার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ

স্কুলে থাকাকালীন অন্যান্য বাচ্চারা দোলনায় দোল খেতে খেতে জেসিকার হাত না থাকা নিয়ে টিটকারি করতো। কিন্তু ছোট্ট জেসিকা সেই টিটকারি গায়ে না মেখে অন্যদের মতো উড়তে চাইতো। তখন থেকেই মূলত উড়ার ইচ্ছেটা জন্মে।

এরপর সেই অধরা স্বপ্নটাও একদিন ধরা দিলো। ২০০৫ সালে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাইকোলজি এবং কমিউনিকেশন্স নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর বাকি সাধারণ মানুষদের জন্য অনুপ্রেরণার এক মিসাইল বনে যান তিনি। তখন জেসিকা উপলব্ধি করলো যে, তার কথা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা অন্য মানুষরা অনুপ্রেরণা পাচ্ছে। সে সময়ই সিদ্ধান্ত নেন মোটিভেশনাল স্পিকার হবেন এবং তাই করেন।

পরিপূর্ণ যুদ্ধ বিমানচালক

ওই বছরই একটি অনুষ্ঠানে জেসিকার সাক্ষাৎ হয় বিমান চালানোর প্রশিক্ষক রবিন স্টোড্ডার্ডের সঙ্গে। তখন জেসিকাকে বিমান চালানোর প্রস্তাব দেন তিনি। আর সঙ্গে সঙ্গেই পাশে থাকা জেসিকার বাবা এতে সম্মতি দিয়ে দেন। এরপরই তার পাইলট হওয়ার যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘ তিন বছরের কঠোর সাধনা ও পরিশ্রমের পর ২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর প্রথম বিমান চালানোর সার্টিফিকেট অর্জন করেন এই অদম্য নারী। পরবর্তীতে যুদ্ধ বিমান চালানোরও প্রশিক্ষণ নেন এবং হয়ে উঠেন একজন পরিপূর্ণ যুদ্ধ বিমানচালক। এর মধ্য দিয়ে প্রথম ও একমাত্র হাতবিহীন পাইলট হিসেবে আবারও গিনেস বুক অব ওয়াল্ড রেকর্ডে নাম লেখান জেসিকা কক্স।

jessica cox husbandস্বামীর সঙ্গে জেসিকা কক্স

পরবর্তীতে তার জীবনে একজন ভালোবাসার মানুষও আসে। ওই মানুষটির নাম প্যাট্রিক ছেইম্বালেন। যিনি পরিপূর্ণ একজন মানুষ। ২০১২ সালে প্যাট্রিকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তখন তিনি বলেছিলেন, 'হাত না থাকলে জীবন অর্থহীন হয়ে যাবে, এমনটা ভুল। হাতবিহীন মানুষরাও তাদের মনের মানুষ খুঁজে পায় এবং ভালোবাসা পায়। তাদেরও স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনযাপন করার পূর্ণ অধিকার আছে।'

২০১৫ সালে 'Disarm Your Limits' নামে নিজের আত্মজীবনী বই প্রকাশ করেন জেসিকা কক্স। তার মতো এমন আরো যত মানুষ আছেন, তাদের অনুপ্রাণিত করতেই বইটি প্রকাশ করেন তিনি। তাকে নিয়ে বেশ কিছু তথ্যচিত্রও বানানো হয়েছে।

Discover extraordinary stories from around the world with our exceptional news coverage. From uplifting human interest stories to groundbreaking scientific discoveries, we bring you the best of the best. Stay informed about the latest breakthroughs in technology, medicine, and beyond, and explore the world's most fascinating cultures and communities. Get inspired and informed with our exceptional news coverage.