আপনি পড়ছেন

বর্তমান বিশ্বের মানচিত্রে স্পেন ও পর্তুগাল মিলেই আইবেরিয়ান উপদ্বীপ গঠিত। হিস্পানিয়া বা আন্দালুসিয়া নামেও এটি পরিচিত। আয়তনে প্রায় ছয় লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের এই উপদ্বীপটি উত্তরে পিরেনিজ পর্বতমালা দিয়ে ফ্রান্স থেকে আলাদা, আর দক্ষিণে প্রায় ১৩ কিলোমিটার প্রস্থের জিব্রাল্টার প্রণালী একে আফ্রিকার মরক্কো থেকে আলাদা করেছে। গ্রিকরা এর নাম দিয়েছিল ‘আইবেরিয়া’, আর রোমানরা দিয়েছিল ‘হিস্পানিয়া’।

spain

অন্যদিকে অতীতে সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্কসহ উত্তর ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন জাতি স্পেনে বসবাস করতো। এই জনগোষ্ঠীকে ভান্দাল গোত্র বলা হতো। আর বাসিন্দাদের নামের সাথে মিল রেখে এ ভূখণ্ডকে আরবরা বলতো ভান্ডালুসিয়া। ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন, আন্দালুসিয়া মূলত ‘ভান্ডালুসিয়া’ শব্দেরই অপভ্রংশ। কালের বিবর্তনে এই আন্দালুসিয়া ‘আন্দালুস’ নাম ধারণ করে।

অষ্টম শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে মুসলমানদের সফল বিজয়াভিযানের ফলে স্পেনের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। অন্ধকার ইউরোপে ওই সময় স্পেনের মুসলমানরা আলোর মশাল নিয়ে প্রবেশ করে। কর্ডোভা ছিল মুসলিম স্পেনের রাজধানী। ঐতিহাসিকরা বলেন, কর্ডোভার গ্রন্থাগারগুলোতে সব মিলিয়ে প্রায় চার লক্ষ বই ছিল। যখন কোনো ছাপা খানা ছিল না- এটা তখনকার কথা।

এ প্রসঙ্গে বিবিসির এক প্রতিবেদনে স্পেনে মুসলিম যুগকে জ্ঞানচর্চার স্বর্ণযুগ বলে উল্লেখ করা হয়। যেখানে গ্রন্থাগার, বিদ্যালয় ও হাম্মামখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, আর সেই সাথে বিকাশ লাভ করেছিলো সাহিত্য, কবিতা এবং স্থাপত্যকলাও।

স্থাপত্যশিল্পের ক্ষেত্রে ছিল চমকপ্রদ সব দৃষ্টান্ত। আলহামরার প্রাসাদ সম্পর্কে একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক মন্তব্য করেন, এটি ভারতবের্ষর তাজমহলের চেয়েও বেশি সুন্দর। কর্ডোভা কেন্দ্রীয় মসজিদটি ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য নিদর্শন, যা কালের পরিক্রমায় টিকে থাকা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে গণ্য করা হয়।

এই মসজিদের ছাদঢাকা অংশটুকুই আমাদের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের আটগুণেরও বেশি বড়। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে বারো হাজার বর্গ কিলোমিটার। দি লিগেসি অব ইসলাম, সম্পাদক, আরনল্ড ও গুইলম, পৃষ্ঠা ১১-১৩।

কর্ডোভা সেতু কর্ডোভার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। এটি স্পেনের অন্যতম প্রধান নদী ওয়াদিল কাবরের ওপর বানানো হয়েছে। যার দৈর্ঘ্য প্রায় চার শ মিটার। এই সেতু যখন মুসলমানরা বানিয়েছিলো তখন মানুষ পরিবহন মাধ্যম বলতে কেবল ঘোড়া-গাধা-খচ্চরের কথাই চিন্তা করতো।

একদিকে যেমন মুসলমানদের হাত ধরে ইউরোপীয় সভ্যতার আলো জ্বলে, অন্যদিকে ভাগ্যদোষে সে মুসলমানদের রক্তেরই ইউরোপ ও স্পেনের খ্রিস্টানরা গোসল করে। এ বড় নির্মম ইতিহাস। মুসলমানদের বংশসহ স্পেন থেকে তাড়িয়ে দেয় মানুষরূপী পশুগুলো।

১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন। আর এ বছরই সমাপ্তি হয় স্পেনে মুসলিম শাসনের সোনালী অধ্যায়ের। ক্যাথলিক কর্তৃক মুসলমান নির্যাতনের লোমহর্ষক ও বিভীষিকাময় ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুসলিম কিশোরীদের ধর্মান্তরিত করার জন্য টেনে-হিচরে নিয়ে যাওয়া হতো। এ সময় তাদের চিৎকারে পুরো এলাকার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে যেত। 

islam 4

একজন ৯০ বছরের বৃদ্ধা মুসলিম মহিলাকে একটা গাধার পিঠে চড়িয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানো হয়েছিল, তার ‘অপরাধ’ ছিল তার কাছে পবিত্র কোরআনের একটি কপি ছিল। একদল আশ্রয়হীন বৃদ্ধ, নারী ও শিশু স্পেনের একটি মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদেরকে ভেতরে রেখেই মসজিদটিকে বারুদের সাহায্যে উড়িয়ে দেওয়া হয়।Harvey, L. P. (1992). Islamic Spain, 1250 to 1500. Chicago: University of Chicago Press. Page 9.

একজন ঐতিহাসিকের বর্ণনায় পাওয়া যায়, ‘সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা এমন ছিল যে, তা লিখতে কলম পর্যন্ত কেঁদে উঠে। আমি নিজে একজন মুসলিম নারীর ক্ষত-বিক্ষত লাশ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেছি। আশপাশে তার সন্তানদের ছয়টি মৃতদেহও পড়েছিল। ওই নারীর একটি জীবিত শিশু দুধ মনে করে মায়ের রক্তপান করছিল। লোভী সৈন্যরা নারীদের মৃতদেহ থেকে গহনাগুলো খুলে নিচ্ছিল।’

শূকরের মাংস খাওয়া ও মদ্যপান না করার জন্য মুসলমানদের দোষী ঘোষণা করে শাস্তি দেয়া হতো। মুসলমানদের সর্বস্ব লুট করে জোর করে খ্রিস্টান বানাতো, মসজিদগুলোকে গীর্জায় রূপান্তরিত করে তার দরজায় বিভিন্ন মূর্তি বসাতো।

একবার মুসলমানদের একটি জাহাজে ভরে সেটা সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বহু মুসলমানকে অন্যায়ভাবে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। ফাঁসির আগে তাদের জিজ্ঞেস করা হতো, তোমরা কি খ্রিস্টান হিসেবে মরতে চাও, নাকি মুসলমান হয়ে? যদি বলতো মুসলমান হয়ে মরতে চাই, তাহলে তাকে স্বাভাবিক ফাঁসি না দিয়ে চারদিক থেকে পাথর ছুড়ে তীব্র যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করতো। এভাবেই দীর্ঘদিন জুলুম নির্যাতন চালানো হয় স্পেনের মুসলমানদের ওপর।

বিখ্যাত ঐতিহাসিক পিকে হিট্টি তার গ্রন্থে স্পেনে মুসলমানদের নির্যাতনের ইতিহাস সম্পর্কে যে বর্ণনা দেন তা শুনলে গা শিউরে উঠে। প্রিন্সিপাল ইবরাহিম খাঁর অনুবাদে আসুন চোখ বুলিয়ে নেই পিকে হিট্টি কী বলেছেন- 

‘১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে আরাগনের ফার্ডিন্যান্ড ও কেস্টাইলের ইসাবেলার মধ্যে বিয়ে হয় এবং উভয় রাজ্য চিরতরে এক হয়ে যায়। এই মিলন মুসলিম স্পেনের ধ্বংসের পথ অবারিত করে দেয়। এই ক্রমবর্ধমান বিপদের সম্মুখীন হওয়া নাসরিদ বংশের সাধ্যাতীত ছিল।

এ বংশের শেষ সুলতান এক রক্তক্ষয়ী আত্মকলহে লিপ্ত হন এবং তার অবস্থা আরো বিপদজনক হয়ে পড়ে। ১২৩২ হতে ১৪৯২ পর্যন্ত যে ২১ জন সুলতান রাজত্ব করেন, তাদের মধ্যে ৬ জন দুইবার এবং একজন তিনবার রাজত্ব করেন।

যে সময় আমেরিকার ইতিহাসের সূচনা, ঠিক সেই ১৪৯২ সালে এক দীর্ঘ অবরোধের পর খ্রিস্টান সৈন্যদের হাতে মুসলিম গ্রানাডার পতন ঘটে- ‘ক্রুশ হেলালকে উৎখাত করে’। ‘উদার’ সম্রাট ফার্ডিন্যান্ড ও সম্রাজ্ঞী ইসাবেলা মুসলমানদের আত্মসমর্পণের শর্তগুলো পালন করলেন না।

১৪৯৯ সালে রানী ইসাবেলার ধর্মগুরু কার্ডিনাল জিমেনেজ ডি সিসনারো’র নেতৃত্বে জোর করে ধর্মান্তরকরণের অভিযান শুরু হয়। কার্ডিনাল প্রথম চেষ্টা করেন ইসলাম বিষয়ক সমস্ত আরবি বই পুড়িয়ে ফেলতে। গ্রানাডায় আরবী পান্ডুলিপি পোড়ানোর উৎসব শুরু হয়। এরপর প্রতিষ্ঠিত হয় বিধর্মী উচ্ছেদ অর্থাৎ মুসলিম উচ্ছেদ আদালত- ইনকুইজিশন! এর কাজ জোরেশোরে চলতে থাকে।

গ্রানাডার পতনের পর যেসব মুসলমান রয়ে যায়, তাদের সবাইকে এখন থেকে বলা হয় মরিসকো। স্পেনীয় ভাষায় এর মানে ছোট মুর। রোমকরা পশ্চিম আফ্রিকাকে বলতো-মরেটানিয়া। আর পশ্চিম আফ্রিকার বাসিন্দাদের বলতো, ম-রী। এই ম-রী হতে স্পেনীয় মোরো এবং ইংরেজি মুর শব্দের উৎপত্তি। বারবাররাই ছিল প্রকৃত মুর। কিন্তু স্পেন ও উত্তর পশ্চিম আফ্রিকার সমস্ত মুসলমানকেই মুর বলা হয়।

ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জে পাঁচ লাখ মুসলমান আছে, এদের বলা হয় মোরো। ম্যাগেলান কর্তৃক ১৫২১ সালে এই দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কৃত হওয়ার পর স্প্যানীয়রা তথাকার মুসলমানদের এ নাম দেয়।

মুসলিম স্পেনীয়রা একটি রোমান উপভাষায় কথা বলতো। কিন্তু ব্যবহার করতো আরবি হরফ। বেশিরভাগের না হলেও অনেক মরিসকোরই পূর্বপুরুষ স্পেনীয় ছিল। কিন্তু এখন সবাইকে ‘মনে করিয়ে দেওয়া’ হয় যে, তাদের পূর্বপুরুষরা খ্রিস্টান ছিল; কাজেই তাদের হয় আবার খ্রিস্টান হতে হবে, নইলে তার ফল ভোগ করতে হবে।

spain muslim

মুদেজারদের মরিসকোদের সঙ্গে এক শ্রেণীভুক্ত করা হয়। এদের অনেকে প্রকাশ্যে খ্রিস্টধর্ম স্বীকার করতো, কিন্তু গোপনে ইসলামের আচার-অনুষ্ঠান পালন করতো।

কেউ কেউ খ্রিস্টান মতে বিয়ে করে বাড়ি এসে গোপনে ইসলামী মতে ফের বিয়ে করতো। অনেকে বাইরে খ্রিস্টানি নাম রাখতো, আর বাড়িতে ব্যবহারের জন্য আরবি নাম রাখতো।

১৫০১ সালে কেস্টাইলে এক রাজকীয় আদেশে ঘোষণা করা হয় যে, কেস্টাইল আর লিয়নের সব মুসলমানকে হয় খ্রিস্টান হতে হবে, না হয় স্পেন ছেড়ে চলে যেতে হবে। তবে মনে হয়, এই ঘোষণা অনুযায়ী যথাযথ কাজ হয়নি।

১৫২৬ সালে আরাগনের মুসলমানদের ওপর ওই একই আদেশ জারি করা হয়। ১৫৫৬ সালে দ্বিতীয় ফিলিপ এক আইন জারি করেন যে, বাকি মুসলমানদের অনতিবিলম্বে তাদের ভাষা, নামাজ-রোজা, অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং জীবনযাত্রা প্রণালী ত্যাগ করতে হবে। তিনি এমন আদেশ দিয়ে বসেন যে, স্পেনীয় হাম্মামখানাগুলিও মুসলিদের চিহ্ন, কাজেই সেগুলি ভেঙে ফেলতে হবে।

এতে গ্রানাডা অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয় (এই দ্বিতীয় বার) এবং পার্শ্ববর্তী পার্বত্য অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তবে সে বিদ্রোহ দমন করা হয়।

১৬০৯ সালে তৃতীয় ফিলিপ মুসলিম বিতাড়নের শেষ হুকুম নামায় দস্তখত করেন। এর ফলে স্পেনের সমস্ত মুসলমানকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়।

কথিত আছে, প্রায় পাঁচ লাখ মুসলমান আফ্রিকা বা অন্য কোনো মুসলিম দেশে যাওয়ার জন্য জাহাজে উঠতে বাধ্য হয়। হিসাবে দেখা যায় যে, গ্রানাডার পতন ও সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দশকের মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ মুসলমান হয় নির্বাসিত, না হয় নিহত হন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর