সাধারণত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীদের প্ল্যাটিলেট (রক্তের অণুচক্রিকা) অনেক কমে যায় ও রক্তক্ষরণ হয়। তখন স্বজনদের রক্তের জোগার করতে হয়। এই ভোগান্তির অবসান ঘটাতে এবার কার্যকর ওষুধ পাওয়ার দাবি করেছেন বাংলাদেশি একদল গবেষক। তাদের ওই ওষুধ প্ল্যাটিলেট বাড়াতে ও রক্তক্ষরণ বন্ধে সহায়তা করবে।
ডেঙ্গু মশা
এক্ষেত্রে 'এলট্রম্বোপ্যাগ' নামের একটি জেনেরিক ওষুধের (ট্যাবলেট) স্বল্পমাত্রার সংক্ষিপ্ত ডোজ ডেঙ্গু রোগীদের শরীরে প্রয়োগ করতে হবে। আর তা প্রয়োগ করে গবেষক দলটি কার্যকারিতা পেয়েছে বলে চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী দ্যা ল্যানসেটে উল্লেখ করা হয়েছে।
ল্যানসেটের প্রতিবেদনে বলা হয়, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউন সিস্টেম) দুর্বল হয়ে পড়লে লিভারের মারাত্মক জটিলতার কারণে এবং লিউকোমিয়া (রক্তের ক্যান্সার) রোগীদের ক্যামোথেরাপি দেয়ার কারণে প্ল্যাটিলেট কমে যায়। এ পরিস্থিতিকে থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া বা থ্রম্বোসাইটিস বলা হয়। এলট্রম্বোপ্যাগ ওষুধটি এসব রোগীদের দেয়া হয়ে থাকে। আর এসব রোগের সঙ্গে ডেঙ্গুর উপসর্গজনিত মিল রয়েছে। সেটির ওপর ভিত্তি করেই গবেষণার পরিকল্পনা করা হয়।
এ বিষয়ে গবেষক দলটির অন্যতম সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এএইচএম নুরুন নবী বলেন, গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অনেক রোগী প্লাটিলেট কমে যাওয়ায় এবং সময়ের মধ্যে ব্লাড ম্যানেজ করতে না পারায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এমনই এক রোগী ব্লাড ম্যানেজ করতে না পারায় তাকে বাঁচাতে এলট্রম্বোপ্যাগ ওষুধটি ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. মৌসুমী। একদিনেই রোগী সুস্থ হয়ে যান।
'এটা দেখে তিনি আরো পাঁচ জন রোগীর শরীরে ওষুধটি প্রয়োগ করেন। তাতে দেখা যায়, দুই জন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান। আর দুই জন মোটামুটি সুস্থ এবং অপরজনের ফল আশানুরূপ হয়নি।'
পরবর্তীতে ডা. মৌসুমী ঘটনাটি জানালে তারা যৌথ উদ্যোগে ১০১ জন ডেঙ্গু রোগীর ওপর এলট্রম্বোপ্যাগ ওষুধটি প্রয়োগ করেন। এর কার্যকরিতার প্রমাণও পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ওষুধটি প্রয়োগে অধিকাংশের ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। কেবল তিন শতাংশের ক্ষেত্রে ডায়রিয়ার মতো কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে।
'গবেষণার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বেটার লাইফ হাসপাতাল ও এ এম জেড হাসপাতাল থেকে সাধারণ ডেঙ্গু রোগী ৭৭ জন ও রক্তক্ষরণসহ ডেঙ্গু রোগী ২৪ জনকে বেছে নেয়া হয়েছিল। তাদের তিনটি দলে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে দুটি দলের একটিকে প্রতিদিন এক পিস করে ৫০ মিলিগ্রামের ও আরেকটিকে ২৫ মিলিগ্রামের এলট্রম্বোপ্যাগ ট্যাবলেট সেবন করানো হয়। আর অপর দলকে মানসম্পন্ন প্রচলিত চিকিৎসা দিয়ে সব রোগীকেই সাত দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।'
দেখা গেছে, যাদের ২৫ মিলিগ্রাম এলট্রম্বোপ্যাগ ট্যাবলেট দেয়া হয়েছিল, তাদের ৯১ শতাংশ রোগী এবং যারা ৫০ মিলিগ্রাম পেয়েছিল তাদের ৯৭ শতাংশ সুস্থ হয়ে যায়। উভয় দলের রোগীদের প্ল্যাটিলেট সাড়ে তিন লাখের ওপরে উঠে। আর অপর দলটির ৫৫ শতাংশ স্বাভাবিক মাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হন। তবে ওষুধটির উচ্চতর ডোজ (৫০মিগ্রা/প্রতিদিন) চেয়ে নিম্নতর ডোজ (২৫মিগ্রা/প্রতিদিন) প্রয়োগ বেশি নিরাপদ ও কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
গবেষণা দলটির সদস্যরা হলেন- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মৌসুমী সান্যাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এএইচএম নুরুন নবী, ঢাকা মেডিকেলের ডা. আহমেদুল কবির, ডা. রোবেদ আমিন, ডা. চৌধুরী তামান্না তাবাসসুম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সজীব চক্রবর্তী, স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী সারওয়ার আলম, মোহাম্মদ সায়েম, তন্ময় দাশ ও পিয়াল সাহা, স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক বার্থোলোমিয়া কেয়া বেপারী এবং আইচি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. মোহাম্মদ সায়েম।