আপনি পড়ছেন

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ নতুন কিছু নয়। কোভিডের আগ মূহূর্তে বিশ্বব্যাপী এই বিষয়টিই ছিলো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সে সময় চীনা পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ করে। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীনও যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্ক আরোপ করে। তখন রীতিমতো বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল দুই দেশের মধ্যে। এর মধ্যে কোভিড এসে বিষয়টি রূপ নিয়েছিল ‘কে জীবানু ছড়িয়েছে, এর প্রভাব কী হবে’ সংক্রান্ত আলোচনায়। এর মধ্যে বাণিজ্য সংক্রান্ত খণ্ডযুদ্ধ যে চলেনি- তা কিন্তু নয়। চীনা প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হুয়াইয়ের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ, ২০২১ এ জিনজিয়াং এর টমেটো ও তুলায় নিষেধাজ্ঞা ছিল যুদ্ধের কিছু খণ্ডচিত্র। এবার দেশদুটির মাঝে যেন ‘অলআউট’ রণক্ষেত্রের প্রেক্ষাপট তৈরি হতে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়বে চীন তথা জিনজিয়াং প্রদেশটির ওপর বাণিজ্যিকভাবে নির্ভরশীল দেশগুলোর ওপর।

flag us china bdচীনা পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, কতখানি প্রভাব বাংলাদেশে?

গত ২১ জুন থেকে ‘উইঘুর ফোর্সড লেবার প্রিভেনশন অ্যাক্ট’ বা ও শ্রম আইন ইস্যুতে চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াংয়ে উৎপাদিত পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। ‘বলপূর্বক’ এই শ্রম আইন প্রণয়নের পর এবার দাপ্তরিকভাবে চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং অঞ্চলে উৎপাদিত সব পণ্য নিষিদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, জিনজিয়াং প্রদেশের যেখানে এ তুলা তৈরি হয়, সেখানে উইঘুর মুসলিম নির্যাতন, শিশু শ্রম ও শ্রম আইনের লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে থাকে। যা যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার ও শ্রম আইন অনুমোদন দেয় না। এ কারণে এখানে উৎপাদিত পণ্য নিষিদ্ধ করেছে দেশটি।

শুধু তাই নয় যেসব দেশ ও প্রতিষ্ঠান চীনের এই অঞ্চল থেকে পণ্য আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করবে তাদেরকেও নিশ্চিত করতে হবে, এসব পণ্য জোরপূর্বক শ্রমে তৈরি হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র বারবারই অভিযোগ করে আসছে চীনের জিনজিয়াংয়ে উইঘুর সম্প্রদায়ের মুসলমানদের আটকে রেখে জোর করে কাজ করানো হচ্ছে। যা মানবাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ লংঘন ও গণহত্যার শামিল। এদিকে আবার চীন বরাবরই বলে আসছে, জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলমানরা ঐতিহ্যগতভাবেই বাস করে। কেউ তাদের জোর করে আটকে রাখেনি সেখানে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের বহুদিনের অভিযোগ, ২০১৭ সাল থেকে ১০ লাখের বেশি উইঘুর ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মুসলমানকে জিনজিয়াংয়ে আটকে রেখে খুব কম মজুরি বা বিনা মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তা করা হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন এবং শিল্পসহায়তার মতো গালভরা বুলির আড়ালে। গণ বন্দীশিবিরে উইঘুর মুসলমানদের আটকে রেখে মানবেতর পরিবেশে রাখার অভিযোগও উঠেছে। এদিকে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্তের জবাবে বলেছে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা উভয় দেশের কোম্পানি এবং ভোক্তাদের স্বার্থকে মারাত্মকভাবে আঘাত করবে এবং চীন তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় ‘প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ নেবে।

নিষেধাজ্ঞাটি জিনজিয়াংয়ের সকল পণ্যে আরোপ করা হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মূল শঙ্কার কারণ তৈরি পোশাক শিল্পে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প যখন করোনা ও বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির মোকাবেলা করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তখন এই নিষেধাজ্ঞা এলো। কারণ এই মূহূর্তে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পখাত কাঁচামালের জন্য চীনের এই প্রদেশটির ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে ব্যবহৃত তুলার ৩০ ভাগ আসে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ থেকে। অন্যান্য পণ্য ও একসেসরিজের বড় অংশ আসে চীন থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের এ নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প সংকটে পড়তে পারে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকরা।

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ফলে জিনজিয়াং প্রদেশের ফেব্রিক শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইউরোপেও রপ্তানি করা যাবে না। মোদ্দা কথাটি হলো, জিনজিয়াংয়ের তুলা বাংলাদেশ ব্যবহার করতে পারবে না। এমন নয় যে তুলা বা গার্মেন্টস একসেসরিজের অন্যান্য পণ্য অন্য দেশে পাওয়া যায় না। কিন্তু চীন তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের কাছের দেশ হওয়া এবং কম সময়ে চীন থেকে পণ্য সরবারহের সুবিধা থাকার কারণে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা অনেকটাই চীন-নির্ভর। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে সমস্যায় পড়বে উদ্যোক্তা। গত এক বছর ধরে এমনিতেই তুলার বাজার অস্থির, তারপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর অস্থিরতা আরো বাড়বে। তুলা আমদানি করতে ব্যয় বাড়বে, ব্যয় বাড়লেও সুতা তৈরি করতে খরচ বাড়বে। তৈরি পোশাকের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। আর সামগ্রিকভাবে এর প্রভাব পড়বে রপ্তানি ব্যয়ে।

এদিকে বিবিসিরি খবরে জানা গেছে যুক্তরাষ্ট্র চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের তুলাকে শুধু নিষেধাজ্ঞাই জারি করেনি, ওই অঞ্চলের পানি ও বায়ুতে বানানো ফেব্রিক চিহ্নিত করার জন্য বিশেষ মেশিন আবিষ্কার করেছে। কোনো দেশ ভুল করেও জিনজিয়াং প্রদেশের তুলা দিয়ে ফেব্রিক বানিয়ে রপ্তানি করলে যুক্তরাষ্ট্র ওই বিশেষ মেশিন ব্যবহার করে তা ধরে ফেলবে।

তবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এ বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বিজিএমইএ-এর সূত্র জানিয়েছে, চীন থেকে তুলা আমদানির সময় জিনজিয়াংয়ের তুলা না পাঠানোর নিশ্চয়তা নিচ্ছে বাংলাদেশ। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে জিনজিয়াংয়ের তুলা ও ফেব্রিক শনাক্তকরণের যন্ত্র আমদানি করার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

এতসব হতাশার মাঝে আছে আলোর রেখাও। মূল্যস্ফীতি ও মন্দার ভয়াল পদধ্বনিতে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি গন্তব্যে পোশাকের ক্রয়াদেশ কিছুটা কমতির দিকে থাকলেও চীন থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ক্রয়াদেশ ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনাও রয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীনা পণ্যে নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটির ক্রয়াদেশগুলো ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশে আসার কথা। এছাড়া ভারত এবং পাকিস্তানও এর সুফল ভোগ করবে।

লেখক: মো. মনিরুজ্জামান, সাংবাদিক

প্রিয় পাঠক, ভিন্নমতে প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু, রচনারীতি ও ভাবনার দায় একান্ত লেখকের। এ বিষয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার কোনোভাবে দায়বদ্ধ নয়। ধন্যবাদ।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর