আপনি পড়ছেন

আজকের এই যুগে আমরা সকলেই নারীর উচ্চশিক্ষার পক্ষে কথা বলি। আমরা এটা মেনে নিয়েছি যে, একজন শিক্ষিত মা-ই পারেন একটি শিক্ষিত জাতি গড়তে। আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক পুরুষ এবং অর্ধেক নারী। সমাজের অর্ধেক অংশকে অশিক্ষিত রেখে উন্নয়ন সম্ভব নয় তাও আমরা জানি। কিন্তু একজন শিক্ষিত নারীর পেশাদার এবং পারিবারিক অবস্থানের কথা বিবেচনা করলে হয়তো নারীর উচ্চশিক্ষার পক্ষ আপনি নেবেন না। জানি, একবিংশ শতাব্দির এই যুগে এমন কথা উচ্চারণ এক কথায় গোঁড়ামি ছাড়া আর কিছুই না। তবুও ভাবুন।

mother and child paint

শিক্ষা মানুষকে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখায় কিন্তু একজন উচ্চশিক্ষাকামী নারী হয়ে আপনি নিজেকে কতোটুকু উচ্চতায় কল্পনা করেন? নিশ্চয়ই সেটা একজন শিক্ষিত পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

ধরুন, আপনি একজন স্নেহময়ী মা, আদর্শ স্ত্রী, কর্মস্থলে দায়িত্বশীল কর্মী। আপনি একই সাথে এই সবগুলো ক্ষেত্র থেকে নিয়মিত মানসিক চাপ পেতে থাকবেন। আপনি যদি বিবাহিত হয়ে থাকেন এবং দেশের বাইরে যেতে চান, শ্বশুরবাড়ির নানা মহল থেকে আপনাকে বাধার সম্মুখিন হতে হবে। আপনি নিশ্চয়ই আপনার স্বামীকে ত্যাগ করে স্বপ্নের পথে যেতে চাইবেন না! উপরন্তু যদি একটি সন্তান থেকে থাকে তাহলে তো আর কথাই নেই। আপনি কি আপনার সন্তানকে অন্তত একটি বছরের জন্যেও ছেড়ে যেতে পারবেন? চাকরির কথা বাদ দিন, যদি কোন উচ্চতর ডিগ্রীর সুবাদে হয়, তাও কি এটা সম্ভব? কেন আপনি যাবেন? কী করে সন্তানকে ফেলে যাওয়ার মতো একটি সিদ্ধান্ত আপনি নিতে পারেন? যদি পারেন তবে আপনাকে একজন নিষ্ঠুর মা, একজন নিষ্ঠুর মানুষ বলে বিবেচনা করা হবে। এক্ষেত্রে আরও প্রতিবন্ধকতা দেখুন, আপনি যদি অবিবাহিত হন, তবে প্রশ্ন উঠবে, আপনি কতদিনে ফিরে এসে বিয়ে করবেন? বাজারে চাল ডালের দাম যে হারে বাড়ছে, আপনার বয়সটা কিন্তু তার চেয়ে বহুগুণে দ্রুত বেড়ে চলেছে। একটা সময় আপনার যতই বিদেশী ডিগ্রী থাকুক না কেন, কেউ আপনাকে বিয়ে করবে না।

এখন আপনি যদি একজন বিবাহিত নারী হওয়া সত্ত্বেও একটি প্রতিষ্ঠানের পূর্ণকালীন কর্মী হয়ে থাকেন তাহলে আপনাকে একই সাথে ঘর এবং বাহির দুটোই একা হাতে সামলাতে হবে এবং এই কাজে আপনাকে সাহায্য করার জন্য কেউ থাকবে না। কেননা এটা আপনার উচ্চাভিলাষী এবং আত্মনির্ভরশীল হওয়ার শাস্তি। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, সব ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম থাকবেই। কিন্তু ব্যতিক্রম কখনও উদাহরণ হতে পারে না। অধিকাংশ নারীর জন্য এটাই সত্য।

পরবর্তী প্রতিবন্ধকতায় আসি। মনে করুন, আপনি একজন চাকরিজীবী অন্তঃসত্ত্বা নারী। আপনি জেনে থাকবেন, বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়া কতোটা কঠিন। আশ্চর্যজনক হলেও, কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ছুটির মেয়াদ মাত্র একমাস! এরপর হয়তো আপনি চার মাস পর্যন্ত ছুটি পাবেন কিন্তু এই সময় আপনাকে কোন বেতন দেয়া হবে না। একটি নারীর জন্য এই পরিস্থিতিতে চাকরি করা বা ছাড়া, দুটোই কল্পনাতীত কঠিন। আর এই সময় যদি স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির কোন সাহায্য আপনি না পান তবে বলুন, আত্মনির্ভরশীল হওয়ার শাস্তির কি পরিপূর্ণ হল?

এবার ভাবুন, আপনি একজন চাকরিজীবী মা। আপনি আপনার সংসার, সন্তান এবং কর্মস্থল সবকিছুই সমতালে ঠিক রাখছেন। আপনার স্বামী এবং পরিবারের সহযোগিতা পেলে হয়তো এটা সম্ভব হতে পারে এবং কিছু পরিবারে এমন সুবিধা নারীরা পাচ্ছেন। এসব পরিবারের পুরুষ সদস্যরা হয়তো আপনার প্রশংসাই করবেন কেননা, যদিও পুরুষের জন্য সংসারী হয়ে চাকরিজীবী হওয়া খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য। কিন্তু একজন নারী যদি তা করেন তবে সকলের দৃষ্টিতে তিনি হয়ে যান অস্বাভাবিক স্তরের একজন অতিমানব। প্রশংসা পেয়ে আপনার নিশ্চয়ই এমন অতিমানবিক শক্তিকে আরও জোরদার করতে ইচ্ছে হবে। আপনি আপনার পরিবারের প্রতি আগের চেয়ে বেশি দায়িত্বশীল হবেন এবং আপনার কর্মক্ষেত্রে জাদুকরী অবস্থান দেখাতে চাইবেন। এই পরিবেশটা কর্মজীবী নারীদের পক্ষে শুভ। কিন্তু ক’জন পায় এমন পরিবার? অনেক পরিবারে বিয়ের সময় প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তাকে সকল স্বাধীনতা ও সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। কিন্তু বিয়ের পর বা গর্ভধারণ করলে তারা কি কথা মনে রাখে?

একটি শিশু জন্মের পর অন্তত ১০ বছর পর্যন্ত নিবিড় পরিচর্যা পাওয়ার দাবি রাখে। কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময় সন্তানকে কার কাছে সুরক্ষিত রেখে যাবেন সেই বিষয়ে আপনাকে নিশ্চিত হতেই হবে। আপনি একজন গৃহপরিচারিকার ওপর নির্ভরশীল হতে পারেন না এবং এক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় আপনি আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকেও সাহায্য পাবেন না। যদি বা পান, সেটা সাময়িক সময়ের জন্য। আপনার শাশুড়ি যদি জীবিত এবং সক্ষম থাকেন তাহলে হয়তো একটি উপায় হয় কিন্তু তা না হলে সন্তানের বেড়ে ওঠার পরিবেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা আপনি কিছুতেই ছাড়তে পারবেন না। যদি এই সন্তানের বয়স পাঁচ বছরের কম হয়ে থাকে তাহলে তার কতোরকম দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, সেটা হয়তো অফিসের টেবিলে বসে আপনি অনুমানও করতে পারবেন না।

সবশেষে আপনার যে বিষয়ে একান্ত মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন তা হল, আপনার স্বামী এবং আত্মীয়স্বজনের কাছে সন্তানের শৈশব এবং তার শিক্ষার বিষয়ে যৌথ সহযোগিতা পাওয়া একরকম স্বপ্নের মতো। কারণ আপনি নারী। আপনার সংসার, স্বামীর পরিবার, সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব একান্ত আপনারই। সেটা যদি আপনি না পারেন তবে তা আপনার ব্যর্থতা বলেই গণ্য হবে।

তাহলে এবার বলুন, একজন নারী হয়ে কিভাবে আপনি উচ্চশিক্ষিত ও আত্মনির্ভরশীল হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন? আপনার সার্টিফিকেটের ফাইলটা আলমারিতে তোলা থাকলে আপনি কি নিজেকে আহত, অপমানিত, অবহেলিত, বৈষম্যে অবদমিত একজন সাধারণ, বলা চলে অল্প শিক্ষিত কোন নারীর তুলনায় নিজেকে নিগৃহীত মনে করবেন না?

বি.দ্র. স্টার উইকেন্ড-এ প্রকাশিত মেহনাজ পারভিন তুলির ফিচার থেকে অনুবাদিত। 

প্রিয় পাঠক, ভিন্নমতে প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু, রচনারীতি ও ভাবনার দায় একান্ত লেখকের। এ বিষয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার কোনোভাবে দায়বদ্ধ নয়। ধন্যবাদ।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর