আপনি পড়ছেন

প্রকৃত নাম মাসুদ রানা। ১৯৯৯ সালে সেলুলয়েড ফিতার জগতে শাকিব খান নামেই যাত্রা শুরু তার। আফতাব খান টুলু পরিচালিত 'সবাইতো সুখী হতে চায়' ছবির মাধ্যমে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেও তার প্রথম মুক্তি প্রাপ্ত ছবি সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত 'অনন্ত ভালোবাসা'। ১৯৯৯ সালের ২৮ মে মুক্তি পায় ছবিটি।

shakib khan with his wife and son

সেই যাত্রা শুরু। এরপর নানা চড়াই উতরাই পেরোতে হয়েছে এ নায়ককে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পরিচালক ও সিনিয়র নায়ক- নায়িকাদের পিছনে অনেক ঘুরতে হয়েছে। আর খুড়িয়ে খুড়িয়ে পার্শ্ব নায়কের চরিত্রে কাজ করে গেছেন। পরিশ্রম যে সৌভাগ্যের প্রসূতি চলচ্চিত্র ইন্ডাষ্ট্রিতে শাকিব খান তার জীবন্ত উদাহরণ।

মূলত ক্যারিয়ারের শুরুতে শাকিব খান আলোচনায় আসেন দেবাশীষ বিশ্বাস পরিচালিত ‘গোলাম’, এজে রানার 'আজকের দাপট' আবু সাঈদ খান পরিচালিত 'দুজন দুজনার', দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর 'বিষে ভরা নাগিন' চলচ্চিত্রের মাধ্যমে।

এ ছবিগুলো মুক্তির পরই তার মধ্যে নতুন সম্ভাবনা দেখতে পান ঢাকাই ছবির নির্মাতারা। ধীরে ধীরে তার উপর ভরসা বাড়তে থাকে নির্মাতাদের। ফলে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে বাড়তে থাকে শাকিব- রাজত্বের পরিধি। এর আগে সালমান শাহর মৃত্যুর পর ইন্ডাস্ট্রিতে তার শূন্যস্থান পূরণ করার ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রে অভিষিক্ত হন এক ঝাঁক অভিনেতা হন। এদের মধ্যে শাকিল খান, রিয়াজ, ফেরদৌস উল্লেখযোগ্য। 

২০০৫ সালে 'আমার স্বপ্ন তুমি' ছবিটি ঘুরিয়ে দেয় শাকিব খানের ক্যারিয়ারের মোড়। ২০০৬ সালে ডিপজলের 'কোটি টাকার কাবিন' ছবিটি শাকিবকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দেয় দর্শকদের কাছে। ২০০৬- ২০০৭ সালের দিকে দেশের সবচেয়ে ব্যবসা সফল ছবি ছিলো এটি। এরপর ২০০৮ সালে তৎকালীন সুপার স্টার মান্নার মৃত্যুর পর পুরো সিনেমা শিল্প হয়ে পড়ে শাকিব খান নির্ভর। 

এরপর থেকে এ নায়কের ছবি দেখতে প্রেক্ষাগৃহে হুমড়ি খেয়ে পড়েন তারা। চরম অশ্লীলতার সময়েও শাকিব খান অপু বিশ্বাসের সঙ্গে জুটি বেঁধে চলচ্চিত্রকে টেনে তুলেন। ফলে অশ্লীল ছবি করা নায়কদের তালিকা থেকে সেরা নায়কের কাতারে উঠে আসেন শাকিব খান। মান্নার মৃত্যু বাংলাদেশের সিনেমা জগতে প্রতিষ্ঠিত করে শাকিব খানের একক রাজত্ব।

এরপর থেকেই শাকিব সাম্রাজ্যে হানা দেয়ার প্রতিভা দেখা যায়নি কারও মধ্যেই। নেই এখনও। ফলে এককভাবে সুপারস্টার হয়েই রাজত্ব করছেন তিনি। বর্তমানে শাকিব খানই একমাত্র হিরো যার ছবির জন্য হল মালিকদের অগ্রিম বুকিং দেয়া থাকে। দেশের উৎসবগুলোয় প্রেক্ষাগৃহে শাকিব খানের ছবি যেন চলতেই হবে। না চললে রাস্তায় প্লাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় ভক্তদের। কাকরাইল পাড়ায় শাকিব এর সিনেমার জন্য মুখিয়ে থাকে। জনপ্রিয়তার এ রেশ ধরেই দেশের নাম্বার ওয়ান নায়কের তকমা পেয়েছেন তিনি। ভালোবেসে দর্শকরা কিং খান উপাধিও দিয়েছেন।

অশ্লীলতা যুগের প্রান্তিক সময় থেকে সুস্থ ধারায় ফেরানো এ নায়ক এখন বাংলা সিনেমায় একচ্ছত্র অধিপতি। এ আধিপত্য নিয়েই দুই দুই বার শিল্পী সমিতির নেতৃত্বের আসনে বসেন। এ সময় ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন পুরোনো অনেক সম্ভাবনাময়ী নায়কেরা থাকলেও সাফল্যের দিক থেকে শাকিব ধারের কাছেও ভিড়তে পারেননি দেখা যায়নি। দীর্ঘ সময় ধরে একক সফলতার কারণেই ইন্ডাস্ট্রির ভেতরেই তৈরি হয় তার প্রতিপক্ষ দল। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখা যাচ্ছে সম্প্রতি।

shakib khan says someone trying to destroy him

গত বছর ঈদে 'শিকারী' নামের যৌথ প্রযোজনার ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও পরিচিতি পান শাকিব খান। বাংলাদেশের গন্ডি পেরিয়ে ভারতে বাড়তে থাকে শাকিব খানের ভক্ত। এ নায়ক এখন কলকাতার এয়ারপোর্টে নামামাত্রই দেখা যায় সে দেশে তার ভক্তদের কাতারবন্দি হয়ে দাড়িয়ে থাকার চিত্র। ফলে সে দেশ থেকে একের পর এক বিগ বাজেটের ছবির প্রস্তাব আসতে থাকে। যা বিদ্যমান এখনও। বলিউড থেকেও ডাক পান এ নায়ক। চূড়ান্ত কথাও হয়েছে। এখন কেবল শুটিং শুরুর পালা।

ঠিক এ সময়ই ক্যারিয়ারের প্রথমবার মানসিক আঘাত আসে তার জীবনে । ২০০৮ সালে তার সবচেয়ে বেশি ছবির নায়িকা অপু বিশ্বাসকে বিয়ে করে গোপন রাখার বিষয়টি ফাঁস করে দেন অপু নিজেই। শুধু বিয়ের খবরই নয়, সঙ্গে তাদের বাচ্চা নিয়েও একটি চ্যানেলের লাইভে হাজির তিনি। এবার ক্যারিয়ার উপরে তুলার সংগ্রাম নয়, বাঁচানোর সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয় তাকে। বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার কোন পথ খোলা না পেয়ে অবশেষে সন্তান ও বাচ্চার দায়িত্ব নেন ঢাকাই কিং খান। সুপারস্টারদের ব্যক্তি জীবনে স্ক্যান্ডাল থাকবেই। তবে শাকিব খানের মিডিয়া জীবনে তেমন কোন স্ক্যান্ডালের খবর পাওয়া না গেলেও এ সময় চিত্রনায়িকা বুবলীর সঙ্গেও প্রেমর গুজব উঠে আসে মিডিয়া পাড়ায়। যা চলছে এখনও।

এ ইস্যুর পর মানসিকভাবেই ভেঙ্গে পড়েন এ নায়ক। এ সুযোগটিই কাজে লাগাতে সচেষ্ট হয় তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দলটি। দীর্ঘদিন ধরে শাকিব খানের ক্যারিয়ার ধ্বংসের জন্য নানাভাবে কাজ করে আসা এ দলটি একের পর এক ফাঁদ পাততে থাকে। ঘায়েল করতে বেছে নেয় তার সবচেয়ে দুর্বল পয়েন্ট— যৌথ প্রযোজনার সিনেমা প্রসঙ্গ! কারণ বর্তমানে এটিই হচ্ছে সেনসেটিভ ইস্যু। এটাকে কাজে লাগিয়ে শাকিব সাম্রাজ্যে হানা দেয় তারা। কারণ বর্তমানে দেশীয় সিনেমা থেকে যৌথ প্রযোজনার ছবিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন শাকিব খান। এর পিছনে অবশ্যই শক্ত যুক্তিও রয়েছে এ নায়কের। যদিও বিষয়টি নিয়ে সঠিক পথে নেই শাকিব খান।

যৌথ প্রযোজনার ছবিতে কাজ করতে গিয়ে দূরত্ব বাড়িয়েছেন এফডিসির সঙ্গে। কাওকে তোয়াক্কা না করার একটা ভাবও চলে এসেছে তার মধ্যে। এটিই যেন কাল হচ্ছে তার ক্যারিয়ারের জন্য। এছাড়া বিশেষ মহলের উস্কানিতেও চলছেন এ নায়ক। যারা শাকিবকে ভুল পথে পরিচালিত করছেন বলেই মনে করছেন অনেকে। তবে তাদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ার একটা চাপা ক্ষোভও আছে। দীর্ঘদিন দেশের ছবিতে অভিনয় করলেও দেশের নির্মাতারা তাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেননি। ঠোটে লিপস্টিক, কানে দুল, লাল টকটকে প্যান্টের সঙ্গে হলুদ রঙ্গের শার্টের মধ্যে আটকে রেখেছেন। এটা ভেঙ্গে নতুন শাকিব খানের জন্ম দিয়েছেন কলকাতার নির্মাতারাই। পারিশ্রমিকও হাকাচ্ছেন কোটির উপরে।

সম্প্রতি কলকাতার শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসকে দেশের ভেতরে প্রবেশ করছেন শাকিব খানের উপর ভর করেই। এটিকও শাকিবের ভুল সিদ্ধান্ত বলে ধরছেন বোদ্ধারা। এতে করে দেশের পরিচালকগণ শাকিব খানের শিডিউল একেবারেই হাতছাড়া করে ফেলেন। অন্য নায়কদের নিয়ে ছবি বানিয়ে মন্দার মুখ দেখতে দেখতে অন্ধকার দেখছেন তারা। ফলে শাকিব খানের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠেন প্রযোজক ও নির্মাতারা। যার কারণে মানসিক দূরত্বের পাশাপাশি দ্বন্দ্বও তৈরি হয় তাদের মধ্যে। বিশেষ করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সঙ্গে কোন সম্পর্কই থাকে না শাকিবের। এর মধ্যে এফিডিসির নির্মাতাদের বেকার বলায় তার পিছনে লাগার সুযোগ পেয়ে যায় সংগঠনটি।

যার রেশ ধরেই বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিসহ বেশ ক'টি সংগঠন নিষেধাজ্ঞা আনে শাকিবের উপরে। তবে এটি সমিতির ভিতরের অনেক সদস্যই সমিতির সভাপতি বদিউল আলম খোকনের ব্যক্তি স্বার্থের প্রতিফলন বলে মন্তব্য করেছেন। পরে বিষয়টি সুরাহা হলেও দূরত্ব কমেনি তাদের মধ্যে। এ সময় অন্যরাও শাকিবের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেন। সর্বশেষ শিল্পী সমিতির গত ৫ মের নির্বাচনে শাকিব সমর্থিত সানি-অমিত হাসান প্যানেলটির পরাজয়ের কারণে শিল্পী সমিতির ক্ষমতাও হাতছাড়া হয়ে যায় তার।

শাকিবের এ পরিস্থিতির জন্য চলচ্চিত্রবোদ্ধারাদের অনেকেই দায়ী করছেন শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের সঙ্গে চুক্তি থেকে শুরু করে সন্তানসহ স্ত্রী হিসেবে অপুর আত্মপ্রকাশ, নির্মাতাদের হেয় করে বক্তব্য, তাকে বয়কট এবং ক্ষমা চেয়ে পুনর্বহাল এবং নিজ সমর্থিত দলের হার!

সব কিছুর  মধ্যেই শাকিব সাম্রাজ্যের পতনের আলামত পাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। তবে তিলে তিলে গড়া এ সাম্রাজ্য এতো সহজেই ভাঙ্গবে, এটাও মানতে নারাজ অনেকে। কারণ শাকিব খান ছাড়া দেশের সিনেমাশিল্প এখনও মৃতপ্রায়। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটা এ শিল্পকে শাকিব খানই চাঙ্গা করে রেখেছেন। কলকাতার একাধিক সুপাস্টারের সঙ্গে তিনি একাই বাংলাদেশের হয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন। তাই শাকিব- সাম্রাজ্য ধ্বংস হওয়া সহজ নয়। আর যদি শাকিব খানের পতন হয় তাহলে ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিরই পতন হবে বলে ধারণা অনেকের। কারণ শাকিব খানের পর বাংলা ছবির হাল ধরার কোন নায়ক আসেনি এখনও। পূর্বের ক্ষোভ থেকে বর্তমানে অনেকেই অকৃতজ্ঞ বলে সম্বোধন করে যাচ্ছেন।

তবে এ কথা সত্য যে বর্তমানে কিছুটা জেদের বসেই ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এ তারকা। ফলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হচ্ছে আরও। শাকিব নমনীয় হলে পুরো বাংলাদেশের মানুষই হয়ে যাবে তার। তাই সুপারস্টারদের আরও বিনয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব গাজী মাজহারুল আনোয়ার। মূলত শাকিব খানের এখন যে পতনের আওয়াজও উঠেছে; এটি একটি অযৌক্তিক আওয়াজ। চক্রান্ত ছাড়া শাকিব সাম্রাজ্যে হানা দেয়ার এখনও কেউ আসেনি ঢাকাই ছবিতে। এ দিকে সবাই সরে পড়লেও পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন ভক্তরা। অনলাইন অফলাইন সব মাধ্যমেই সাহসী করে তুলছেন প্রিয় নায়ককে। সুপারস্টারদের জীবনে এমন মুহুর্ত আসবেই। এটাকে পতন নয়, দুঃসময় বলে সংজ্ঞায়িত করে যাচ্ছেন তারা। এ ছাড়া শাকিব খানকে অন্যদের মতো দ্বন্দ্বে না জড়িয়ে কিছুটা বিনয়ী হয়ে মিলে মিশে কাজ করারও আহবান করেছেন তারা। ভক্তদের এমন পরামর্শ গ্রহণ করলে অচিরেই খারাপ মুহুর্ত কতটা কাটিয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রের নতুন ইতিহাস হয়ে উঠবেন কিং খান।

লেখক: সংস্কৃতি বিষয়ক সাংবাদিক, দৈনিক যুগান্তর

প্রিয় পাঠক, ভিন্নমতে প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু, রচনারীতি ও ভাবনার দায় একান্ত লেখকের। এ বিষয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার কোনোভাবে দায়বদ্ধ নয়। ধন্যবাদ।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর