আপনি পড়ছেন

বাবা-মা'র লালসার ফসল সন্তান। আশা করি কেউ তর্কে জড়াতে আসবেন না। আরো জেনে লজ্জিত হবেন যে, ছেলেমেয়ে বিপথগামী হলে বাবা-মা'রা পরিচয় পর্যন্ত দিতে অস্বীকার করেন। আবার ছেলেমেয়ে ভালো কিছু করলে বাবা-মার চাইতে অন্য কাউকে অতো বেশি আনন্দিত হতে দেখা যায় না। অথচ বিষয়টা উল্টো হওয়ার কথা ছিলো। উচিৎ ছিলো নিজেদের অপারগতা স্বীকার করা।

abu rayhan misbah 01

দেখা গেছে, সন্তান যদি অপকর্ম করে অমনি বাবা-মা সাফ সাফ জানিয়ে দেয়, এ সন্তান আমার না। অথবা সন্তানের বাবা-মা হিসেবে পরিচয় দিতে ওনারা লজ্জাবোধ করেন। অথচ কেউ কি ভেবেছেন, এ সন্তানটি কার উদাসীনতার জন্য নষ্ট হয়েছে? নষ্ট হয়ে যাওয়া এ সকল সন্তানদের দায় আমরা কেউই এড়িয়ে যেতে পারি না।

এইতো কিছুদিন আগে বেশ কিছু যুবক আত্মঘাতী হামলা করে বিশের অধিক দেশি-বিদেশি নাগরিক হত্যা করেছে। অবশেষে যৌথবাহিনীর দীর্ঘ অভিযানে এসব যুবকের জীবন প্রদীপ নিভে যায়। নিভে গেল তাদের মনের দুঃখ, কষ্ট, ক্ষোভ। কেউ কি কখনো নিজের অজান্তে প্রশ্ন করেছেন, কেনো এ সকল যুবকরা এমন আত্মঘাতী কাজ করল? তাদের তো কোনো কিছুর অভাব ছিল না। বিত্ত ছিল, বৈভব ছিল, কারো হয়ত চোখ জুড়ানো প্রেমিকা ছিলো, তারপরেও কেনো তারা বিপথগামী হলো?

এতে করে কি আমরা অন্য কিছু ধরে নিতে পারি? এই যেমন, এরা পরিবারের দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার ফসল, অথবা স্বয়ং রাষ্ট্রযন্ত্রের অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের নোংরা স্বীকার? কেউ জানতেও চাইল না এদের পেছনের কষ্টগুলো কী ছিলো। সবাই একজোটে এদের ধিক্কার দিচ্ছে, তা দিক। আমি দিব না। আমি বরং আফসোস করব এদের অকাল ঝরে যাওয়াতে। আমি বরং অভিযোগ করব এ সকল যুবকদের বাবা-মা, পরিবার, সমাজ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাসহ স্বয়ং রাষ্ট্রযন্ত্রের দিকে। এ অভিযোগ অব্যাহত থাকবে যতদিন এভাবে আমাদের সন্তানদের বিপথগামী হতে দেখব।

একটিবারের জন্য হলেও নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন- আমরা কি আমাদের সন্তানদের সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি, অথবা পারছি? আসুন পরিবারের কাছে প্রশ্ন করি, সন্তান জন্ম দেয়ার পর প্রাতিষ্ঠানিক কিছু পুঁথি শিক্ষা ও গতানুগতিক ভরণপোষণের মাধ্যমেই কি আপনাদের দায়িত্ব শেষ? এছাড়া সন্তানকে নামী-দামী স্কুলে পড়ানো, ডজনখানি হোমটিউটর রেখে দিয়ে দায়সারাভাবেই কিচ্ছা খতম? কখনো খেয়াল করেছেন, ছেলেমেয়েদের মাঝে পড়াশুনার পাশাপাশি অন্য কোনো প্রতিভা আছে কিনা। থাকলেও সে সকল প্রতিভা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তার উপর গুরুত্বারোপ করাই শ্রেয়। মনে রাখতে হবে, নদীর পানি ঢলের দিকেই গড়ায়। দয়া করে তথাকথিত মানুষ করতে গিয়ে আর একটিও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রতিভা নষ্ট করবেন না। অন্যদিকে খেয়াল করতে হবে কারা আমাদের সন্তানদের সহপাঠী, খেলার সাথী ও বন্ধুবান্ধব তাদের গতিবিধি মনিটরিং করা চাই। শুধু শাসন না করে এদের সাথে বন্ধুর মত মিশতে হবে। সময় দেওয়ার পাশাপাশি নৈতিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের দিকে উদ্বুদ্ধ করা ও পর্যাপ্ত খেলাধুলার পাশাপাশি শিক্ষণীয় মানসিক চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাকে প্রযুক্তি সম্পর্কে জানাতে হবে এবং এর সুষ্ঠু প্রয়োগ হচ্ছে কিনা সেদিকেও মনোযোগ রাখতে হবে।

একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, ফেইসবুক যেমন আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে সহজ করেছে তেমনি এর কিছু কিছু বিরূপ প্রভাব সন্তানদের মাঝে পড়তে দেখা গেছে। তাই বিষয়টাতে গুরুত্বারোপ করার এখনই সময়। মনে রাখতে হবে, সন্তান সন্তানই। সন্তান সব সময় বাবা মার কাছে ছোট। আপনি যদি মনে করেন, আমার সন্তান তো অনেক বড় গেছে এখনো কি তাকে শাসন করব? বলব, অবশ্যই। কেননা সন্তান কখনো বড় হয় না। সে সব সময় সন্তানই। তবে শুধু শাসন নয় ভালবাসাও থাকতে হবে, সে ভালবাসা হতে হবে সার্থহীন ও সীমাহীন। বিষয়গুলি ভেবে দেখার অনুরোধ রইল।

এরপর সরকারকে বলি, মাথামোটা বিটিভির মাধ্যমে পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি ও সরকারের উন্নয়নের হালচিত্র দেখানোতেই ব্যস্ত থাকলে চলবে না। কাজ করতে হবে। কাজ করে দেখাতে হবে। জনগণ এখন বুঝে। ফাটাকেষ্ট কাদের-নাহিদ প্যানেল কত দিন মানুষের অন্তরে থাকবে তা সময়ই বলে দেবে। তাই দয়া করে লোক দেখানো ছেড়ে জনগণের ভাষা বুঝার চেষ্টা করুন। দেশ ও দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করুন।

মুখে শুধু মাদককে না বলে এখনই কর্যকর প্রদক্ষেপ নিন। আমাদের সন্তানকে মাদকের হাত থেকে মুক্তি দিন। অন্যথা, মাদক আমদানিতে সীমান্ত খুলে দেওয়ার ভয়াবহতা কি তা পরিষ্কার হয়ে আসছে। তাই নিজের জাহির কমিয়ে দ্রুত কোমলমতি শিক্ষার্থী ও যুবসমাজের দিকে সুনজর দিন। তথাকথিত নাহিদ ফর্মুলার শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে ধর্মীয় অনুশাসন সংবলিত ও নৈতিক শিক্ষার সমন্বয়ে বাস্তবসম্মত সময়োপযোগী বিজ্ঞানবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন সময়ের দাবি। পাশাপাশি বিদেশী অগ্রাসী সংস্কৃতির হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। একদিকে যেমন অবাধ যৌন সুড়সুড়ি সংবলিত পশ্চিমা সংস্কৃতির চ্যানেলগুলোর প্রচার বন্ধ করতে হবে। তেমনি বন্ধ করতে হবে স্টার জলসার মত সংসার বিধ্বংসী চ্যানেলগুলো। শুধু চ্যানেল বন্ধ করে ক্ষান্ত হলেই চলবে না। চাই দেশীয় চ্যানেল ও নির্মাতাদের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা। অপসংস্কৃতির বন্ধের পাশাপাশি তৈরি করতে হবে নিজস্ব সংস্কৃতির আদলে শিক্ষণীয় ও সন্তানদের উৎকর্ষ চিত্তবিনোদনের মত অনুষ্ঠান। অন্যদিকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে সৃজনশীলতা ছড়িয়ে দিতে হবে। এ সকল কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য সুপরিসর শিক্ষাঙ্গন, প্রতিষ্ঠানভিত্তিক নাচ, গান, আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতার পাশাপাশি পর্যাপ্ত খেলার মাঠ, সহশিক্ষার উপকরণ সহজলভ্য করতে হবে এবং অন্ধকার থেকে এখনই আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে আনতে হবে।

বলা বাহুল্য দেশ আজ কোন দিকে যাচ্ছে এবং কতটা খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন সময় জাগার, জেগে ওঠার। সময় এসেছে প্রজন্মকে রাহুর গ্রাস থেকে ছিনিয়ে আনার। সজাগ থাকতে হবে, সন্তান যেনো কোনো বিপথগামীর (জঙ্গিগোষ্ঠি) তুরূপের তাস না হয়। কিংবা নোংরা ছাত্ররাজনীতির কবলে পড়ে কারো ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি না হয়। আমাদের চেষ্টা থাকবে সন্তানকে মানুষ করার, পাশাপাশি একজন আদর্শ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।

অনেক কথার মাঝে এটাও বলতে চাই, পড়াশুনার বাইরে ছেলেমেয়েদের যে সকল বিষয়গুলোতে আগ্রহ আছে তা অগ্রাহ্য করা চলবে না। একটি প্রশ্নের অবতারণা থেকে বলছি, সবাই চায় সন্তানকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে। বানাবেন ভাল কথা। তবে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সবাই কি সোনার হরিণ সরকারি চাকুরী তথা সরকারি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে পেরেছে? অন্যদিকে যারা প্রাইভেটে সময় দিচ্ছেন তারাও কিন্তু খারাপ নেই। এখন কথা হলো যে, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে সময় দেওয়া ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার মেধা খাটিয়ে বিভিন্ন প্লানিং তৈরি করে যার কাছে বিক্রি করে সে উদ্যোক্তা কি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার?

প্লিজ, আপনার স্বপ্ন-ইচ্ছা সন্তানদের উপর চাপিয়ে দিবেন না। লক্ষ করুন, সন্তানের আগ্রহ কোন দিকে। তার আগ্রহকে সম্মান করতে শিখুন। হোক না সে একজন খেলোয়াড়, গায়ক, উপস্থাপক, কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক কিংবা খুদে উদ্যোক্তা। পেশা হিসেবে কোনোটাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নাই।

সন্তানকে শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। তবে শুধু শিক্ষিত হলে চলবে না। পাশাপাশি চাই সুশিক্ষার আদর্শ উপকরণের সমন্বয়। সে শিক্ষা হতে পারে পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক বা অন্যান্য মাধ্যমে। তবে আজকে শিক্ষার যে অবস্থা যাচ্ছে, ব্যঙের ছাতার মত যে হারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠছে, তার ভয়াবহতা লক্ষণীয়। অবস্থা এমন, শিক্ষার চাইতে এ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে ব্যস্ত। শিক্ষক আছে এটা ঠিক, তবে সে শিক্ষকের মাঝে বন্ধুত্ব ও পিতৃস্নেহ নেই বললে চলে। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছ, কিছু শিক্ষিত যুবক এটাকে পেট ও সংসার চালানোর সাময়িক মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়ায় শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষার মাহাত্ম্য অনুপস্থিত থেকে যাচ্ছে। যার দরুন এ সকল কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যবান সময়গুলো। পরিতাপের বিষয় হলো - দেশে অনেক বাণিজ্যিক ও সরকারি সুনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে নেই তা নয়, তবে আদর্শিক ও মানুষ গড়ার কারিগরের সংখ্যা অপ্রতুল।

সন্তানকে মানুষ করার আপনার সকল চেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। অনুরোধ, মানুষ করতে গিয়ে তাঁর আবেগকে মেরে ফেলবেন না। আর যে মানুষটার ভেতর আবেগ অনুপুস্থিত তার যাত্রিক আচরণ যে কল্যাণমুখি হবে না এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। তাই কথা দিতে হবে, সন্তানের ভাল-মন্দ দুটোই আমাদের। ভাল সন্তানটা যেমন আমার, তেমনি নষ্ট সন্তানটিও আমার। শুধু কষ্ট করে তাকে ভাল পথটি দেখিয়ে দিলেই চলবে। তবেই আমরা আশা করতে পারি আমাদের সন্তান আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে।

আবু রায়হান মিসবাহ
কবি ও লেখক, সম্পাদক

প্রিয় পাঠক, ভিন্নমতে প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু, রচনারীতি ও ভাবনার দায় একান্ত লেখকের। এ বিষয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার কোনোভাবে দায়বদ্ধ নয়। ধন্যবাদ।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর