আপনি পড়ছেন

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিষয়ে “দাবি, আন্দোলন ও আন্দোলনের প্রক্রিয়া” শিরোনামে একটি কলাম লিখেছেন। স্যার তার কলামে ছাত্রদের উদ্দেশে একটি প্রশ্ন তুলেছেন, সেটি হল- ‘তোমার দাবি আদায় করার জন্য তুমি কি সবাইকে নিয়ে রাস্তাঘাট বন্ধ করে পুরো শহরকে জিম্মি করে ফেলার বিষয়টি সমর্থন কর?’

answer to the question of zafar iqbal sir

একই কলামে স্যার শিক্ষার্থীদের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলন করার সমালোচনা করে লিখেছেন, ‘তাদের দাবিটি মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার বা স্বৈরশাসকের পতনের মতো জাতীয় কোনও দাবি নয়, নিজেদের একটা চাকরি পাওয়ার সুযোগটা বাড়িয়ে দেওয়ার দাবি।’

আমার কথায় যাওয়ার আগে প্রথমেই বলে নেই, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পূর্বের চেয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে -এ বিষয়ে হয়ত কারোরই দ্বিমত থাকার কথা নয়। পূর্বের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশের পার্থক্য দিবালোকের মত পরিষ্কার। কিন্তু বেকারত্বের মত ভয়াবহ একটি সমস্যা বাংলাদেশ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। স্যারের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে স্যারের কাছে আমার প্রশ্ন, ‘স্যার, আপনি কি বেকারত্বের মত একটি ভয়াবহ সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখেন না?’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিচালিত সর্বশেষ ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ। অর্থাৎ দেশে ৮০ হাজার বেকার বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। (সূত্র: যুগান্তর, ২১ মার্চ ২০১৮ সংখ্যা, শেষ পৃষ্ঠা) সরকারি হিসাবের বাইরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে দেশে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বেকার।

কোন দুর্ঘটনায় ৫০ জন মানুষ মারা গেলে আমরা রাষ্ট্রীয় শোক পালন করি অথচ দেশের এত বিপুল পরিমাণ মানুষ জীবিত থেকেও বেকারত্বের কারণে জীবন্ত লাশ হয়ে যাচ্ছে তা কী জাতীয় সমস্যার পর্যায়ে পড়ে না?

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, একমাত্র সরকারি চাকরি পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতি তুলে দিলেই কি এদের সবার চাকরি হয়ে যাবে? মোটেও না। তবে দেশে যেখানে এত পরিমাণ মানুষ বেকার সেখানে কোটায় লোক না পেলে পদ ফাঁকা রাখাটা কি অন্যায় নয়? মেধায় নিয়োগ না দিয়ে ৫৬ ভাগ কোটায় নিয়োগ দেয়া কি বৈষম্য নয়? রাষ্ট্র যদি এই মুহূর্তে সবাইকে চাকরি দিতে না পরে অন্তত সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য তো তুলে দিতে পারে। আর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল এই বৈষম্য নিরসনের পক্ষেই। যদিও ‘অভিমান করে’ প্রধানমন্ত্রী এখন কোটাই তুলে দিয়েছেন।

বৈষম্য কমাতে যেয়ে রাষ্ট্র যখন নতুন বৈষম্য তৈরি করে তখন তা জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়। কারণ সকল ধরণের সরকারি চাকরিতে এই বৈষম্য চলছিল। পাকিস্তান আমলে `সরকারি চাকরিতে বাঙালিদের কম সুযোগ দেয়া' একটি জাতীয় আন্দোলনের ইস্যু ছিল। এখন স্বাধীন দেশে মেধাবীদের কম সুযোগ দেয়া অর্থাৎ চাকরিক্ষেত্রে ‘মেধা বৈষম্য’ করা কী জাতীয় ইস্যু না?

‘তোমার দাবি আদায় করার জন্য তুমি কি সবাইকে নিয়ে রাস্তাঘাট বন্ধ করে পুরো শহরকে জিম্মি করে ফেলার বিষয়টি সমর্থন কর?’

মোটেও না স্যার। আমি দাবি আদায়কারীদের রাস্তাঘাট বন্ধ করার মত কর্মসূচি দেয়ার আগেই তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার পক্ষপাতি। আমি যৌক্তিক দাবি পূরণ করার পক্ষের মানুষ। যদি তা পূরণ হয়ে যায় তাহলে তো আর পরিস্থিতি জটিল হয় না। কোটা সংস্কার আন্দোলন এদেশে একযুগেরও বেশি সময় ধরে চলছে। ২০০২ সালে মালেক আফসারী ‘বোমা হামলা’ নামে একটি সিনেমা তৈরি করেছেন। ওই সিনেমায় কোটা সংস্কারের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলেন!

এরপরের বছর ২০০৩ সালে, ২০০৮ সালে এবং ২০১৩ সালে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে (সূত্র: বিবিসি বাংলা, বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে যা যা হলো)। আর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছেন। গত ৮ এপ্রিল পর্যন্ত এই আন্দোলন ছিল অহিংস এবং শান্তিপূর্ণ। আন্দোলনকারীরা পুলিশকে ফুল পর্যন্ত দিয়েছে, পুলিশ বিনিময়ে দিয়েছে কাঁদানে গ্যাস, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট। এরপর ক্রমেই বিক্ষোভের মিছিল বড় হয়েছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার পর সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। অথচ এই আলোচনা ততদিন পর্যন্ত হয়নি যতদিন পর্যন্ত আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল। আলোচনায় শিক্ষার্থীরা এক মাসের সময় নিয়ে ফিরে আসে এবং অধিকাংশই ঘরে ফিরে যায়। একটি অংশ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও তারা কোন সহিংস পথ বেঁছে নেয়নি। কিন্তু সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী আশ্বাস দেয়ার পরপরই যখন অন্য দুইজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ভিন্ন কথা বললেন তখন শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্ন, আমরা কোন মন্ত্রীর কথা শুনবো? ফলে তারা ফের আন্দোলনে নামল।

একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘প্রশ্নই উত্তর’। স্যারের কাছে আমার প্রশ্ন ২০০৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা যখন আন্দোলন করে আসছে তখন তাদের কথা কেউ কানে তুলেছে? চলতি বছর যখন দুই মাস ধরে রাস্তা অবরোধ না করে ছাত্ররা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছে তখন কেউ তাদের সাথে আলোচনায় বসেছে? যদি না বসে থাকে তবে শিক্ষার্থীদের কী করা উচিত ছিল?

আর উপাচার্যের বাসায় হামলা চালানোর নিন্দা আন্দোলনকারীরা সবাই করেছে, আন্দোলনকারীরা কখনোই এ ধরণের ঘটনা সমর্থন করে না। তাই কোন স্বার্থান্বেষী মহল এই কাজ করেছে তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়া হোক। কারণ কোন ছাত্র শিক্ষকের বাসায় হামলা চালাতে পারে না। আর পুলিশ কেন ছাত্রদের ক্যাম্পাসের মধ্যে ঢুকে হামলা চালালো তার বিচারও যেন নিশ্চিত করা হয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রিয় পাঠক, ভিন্নমতে প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু, রচনারীতি ও ভাবনার দায় একান্ত লেখকের। এ বিষয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার কোনোভাবে দায়বদ্ধ নয়। ধন্যবাদ।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর