আপনি পড়ছেন

খাগড়াছড়ি (বলপিয়ে আদাম, ২৫ সেপ্টম্বর ২০২০) থেকে সিলেট (এমসি কলেজ ছাত্রাবাস, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০), ঢাকা (সাভার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০) থেকে কুমিল্লা (চলন্ত বাস, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০), সারা বাংলাদেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নির্যাতিত নারী ও স্বজনদের গগণবিদারী আর্তনাদ, চাপা কষ্টের দীর্ঘশ্বাস আর কুপুরুষ নামক হায়েনা শ্রেণির উপর তীব্র ঘৃণা-ক্ষোভ-আতঙ্কের ফলে এই জনপদের আকাশ-বাতাস কী যেন এক অজানা অশঙ্কায় নিস্তব্দ হয়ে রয়েছে- চারিদিকে সুনশান নিরাবতা।

women tortureনারী নির্যাতন- প্রতীকী ছবি

দুর্নীতি, দুবৃত্তায়ন, নৈতিকতার চরম অধঃপতন আর অত্যাচারের দোর্দণ্ড প্রতাপের কাছে যেন মনুষ্যত্ব, বিবেক, ধর্ম অসহায়ভাবে আত্মসমর্পন করে সর্বংসহা বনে যাওয়ার একটি আপস করে নিয়েছে। এই অসীম নিরবতা বুঝি তখনই শেষ হবে যখন প্রকৃতি নিজেই প্রচণ্ড প্রতিঘাতের মাধ্যমে সবকিছুকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিবে।

লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে গড়া বাংলাদেশটিকে যখন অর্থলোলুপ কীটগুলো তাদের সীমাহীন অর্থক্ষুধা মেটানোর জন্য দেশটির সার্বভৌমত্বকে দুর্নীতির কাছে নিলামে তুলেছে তখন আমরা নীরব। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে চরিত্রহীনদের দাপটে যখন শুদ্ধাচার সম্পূর্ণরূপে বিদায় নিচ্ছে তখনও আমরা নীরব। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যখন অন্যায়, অশ্লীলতা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপন করতে বসেছে তখনও আমরা নীরব। আমরা সীমাহীন নীরবতার অতলে ডুব দিয়ে আছি আমাদের চোখের সামনে শতবর্ষী নারী, ছয় মাসের শিশুকে হায়েনার হাতে সম্ভ্রমহানী হতে দেখেও (দৈনিক প্রথম আলো, ২৩ ও ২৫ মে ২০১৯; পরিবর্তন.কম, ৭ মে ২০১৭)।

এই সবকিছুই সাক্ষ্য দেয় আমাদের কুপুরুষ হয়ে ওঠাকে, সমস্ত প্রকার অপকর্মের সাথে আমাদের আপস করে নেয়াকে। অন্য সবকিছুর সাথে আপস করে নেয়া সম্ভব হলেও আমাদের মা, বোন, স্ত্রী, কন্যাদের সম্ভ্রমকেও আমরা পিশাচ, লোলুপদের কাছে বন্ধক রাখতে সম্মত হয়ে গেছি? হয় কাপুরুষের মতো বেঁচে থাকার শর্তে অথবা নিজেদের কুপ্রবৃত্তিকে সংরক্ষশীলতার মোড়কে আবদ্ধ করে রাখার লোভে আমরা সেটা ইতোমধ্যে করে ফেলেছি। আমরা যদি আমাদের পৌরুষত্বকে বিকিয়ে না দিতাম, আমরা যদি কুপুষতার কাছে মাথা নত না করতাম তাহলে কেমন হতে পারতো আমাদের আচরণ?

ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ

বাংলাদেশে আজ নৈতিকতার যে চরম অবক্ষয় ঘটেছে তার দায় সবচেয়ে বেশী ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের। নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে কিছু ব্যতিক্রম বাদে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে বিধি মোতাবেক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। বিশ্বের যেকোনো স্থানে আমরা মসজিদ-মন্দির-গীর্জা ভাঙ্গার প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমে আসবো অথচ ঘরের পাশের অসহায় মেয়েটির সম্ভ্রম বাঁচানোর বিষয়ে ধর্মের নির্দেশ মেনে চলবো না- এরচে দ্বিচারিতা আর কী হতে পারে?

অথচ কন্যা সন্তানের প্রতি, মায়ের প্রতি ইসলামের নবীর (সা:) ছিল কী মায়া! তিনি যখন সফরে বের হতেন সর্বশেষ তাঁর কন্যা ফাতিমা (রা.) এর সাথে দেখা করতেন। আবার সফর থেকে ফিরেও প্রথমেই আদরের কন্যার সাথে দেখা করতেন। (উসুদুল গাবা- ৫/৫৩৫)। নারীরা তো সেই উম্মুল মুমিনীন ফাতিমা (রা.) এর উত্তরসূরী।

পৃথিবীর কোনো ধর্ম যে নারীর প্রতি সহিংসতাকে সমর্থন করতে পারে না এটা নিশ্চিত। এটাও নিশ্চিত যে নারীকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে অত্যাচার, নির্যাতন আর সহিংসতার মাধ্যমে পৃথিবীকে তাদের জন্য আমরা জাহান্নামে পরিণত করে ফেলেছি। শেষ বিচারের দিনে আমাদের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ নারীর পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করার জন্য, নারীর প্রতি ঘৃণ্য আচরণের জন্য রাষ্ট্র ও সমাজে কী অবদান রেখেছিলেন সে প্রশ্নের যথার্থ জবাব দিতে সক্ষম হবেন তো? অথচ ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ আজও বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে সবচেয়ে সম্মানের, শ্রদ্ধার। আমরা বিশ্বাস করি- সকল ধর্মের গবেষক, চিন্তাবিদ এই বিষয়টি নিয়ে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারলে আমরা আমাদের দায় থেকে মুক্তি পেতে পারি।

women abuse 1

রাজনৈতিক কর্মীগণ

একটি দেশের সার্বিক মঙ্গলের জন্য সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের রাজনীতিবিদগণের অধিকাংশই আজ রাজনীতিবিদ নয় যেন রাজনীতিজীবীতে পরিণত হয়েছে। নারী অধিকার রক্ষার সাংবিধানিক নীতিমালা বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাজনীতিবিদগণের। আমরা অত্যন্ত হতাশ হয়ে প্রত্যক্ষ করি, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো রাস্তায় নামলেও ঐক্যবদ্ধ, সংগঠিত ও স্বত:স্ফূর্তভাবে নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে তারা মাঠে নামেনি। যারা সৃষ্টির অর্ধেক অংশের প্রতি এতটা উদাসীন, সংবিধানের বিধির প্রতি এতটা উদাসীন তাদের আত্মবিশ্লেষণের সময় সম্ভবত পেরিয়ে যাচ্ছে।

রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। বাংলাদেশে নারীর অধিকার নিশ্চিত করা, নারীর প্রতি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে যতটা কার্যকর আইন থাকা দরকার ততটা আছে কিনা সেটা হয়তো আলাদা একটি বিতর্কের বিষয়। কিন্তু বিদ্যমান আইনের যথার্থ প্রয়োগ যে নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না বা প্রতিষ্ঠানগুলো করছে না সে বিষয়টিতে কারোরই দ্বিমত করার সুযোগ নেই।

এই দেশে নারীর প্রতি আদিম নির্যাতনের যত খবর শুধুমাত্র আইনের রক্ষক, জনগণের সেবক হিসেবে পরিচিত পুলিশের বিরুদ্ধে বেরিয়েছে তা দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাই। রক্ষক যখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তখন সে জাতির আকাঙ্ক্ষার জায়গাটি ধ্বংস হয়ে যায়। শুধু আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই নয়, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কোনো প্রতিষ্ঠানই নারীর প্রতি সহিংস আচরণের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে তার অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারছে না।

আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এ বিষয়ে আমাদের জবাবদিহিতার জায়গাটিও স্বচ্ছ নয়। রাষ্ট্রের প্রতি, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে বিষয়টি নিয়ে বাস্তবভিত্তিক গবেষণা ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন ছিল অনেক আগেই। রাষ্ট্র যদি এখনও সেটা করতে না পারে তবে তা হবে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকেই ধাবিত হওয়ার স্পষ্ট নিদর্শন।

সুশীল সমাজ

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সফলতা অনেকটাই নির্ভর করে সিভিল সোসাইটির পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা, সত্যের সাথে আপসহীন মানসিকতার ওপর। কিন্তু দুর্ভাগা বাংলাদেশের অনেকগুলো অপ্রাপ্তির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লেজুড়বৃত্তিহীন একটি সুশীল সমাজের সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়া। দেশটির সুশীল সমাজের অধিকাংশ সদস্য আজ দেশের পক্ষে নয় বরং নিজেদের স্বার্থের প্রয়োজনে তারা বিভিন্ন দলীয় রাজনীতির অঙ্গসংগঠনে সক্রিয়।

নারীর অধিকার রক্ষায় সুশীল সমাজের কার্যক্রম কিছুটা চোখে পড়লেও তা প্রভাব বিস্তার করতে ব্যর্থ হয়েছে বারবার। আত্মীকরণ, রাজনীতিকরণের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে সুশীল সমাজ যদি দেশের পক্ষে, জনগণের পক্ষে দাঁড়াতে না পারেন তাহলে তারা হয়তো ব্যর্থ ইতিহাসের অন্যতম নামে পরিণত হবেন। নারী নির্যাতনের বিপক্ষে কার্যকর অবস্থান নিয়ে মানব সভ্যতার এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে নিজেদের সম্পৃক্ত করার এক মহান সুযোগ সুশীল সমাজের এখনও বর্তমান।

উল্লিখিত সংগঠনগুলো ছাড়াও বাংলাদেশে অগণিত সংস্থা রয়েছে যারা নারী অধিকারের বিষয়ে সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। আসলে সংস্থা বা সংগঠনের চেয়েও বড় যে বিষয় তা হলো পারিবারিক শিক্ষা। মনুষ্যত্বের শিক্ষায় বিবেককে আলোকিত করতে না পারলে, নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে, নপুংসকের মতো নারীর প্রতি সহিংসতাকে নীরবে মেনে নিলে অত্যাচারিত, নীপিড়িতের যে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস দিনেদিনে পুঞ্জিভূত হচ্ছে, তা যখন আবার জমিনে ফিরে আসবে সেই উত্তাপে সমগ্র সৃষ্টিজগৎ পুড়ে ছাঁই হয়ে যাবে।

সেই অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে এখনই আমাদের নিপীড়কদের বিরুদ্ধে এমন কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে যা দেখে আঁতকে উঠবে সকল দুর্নীতিগ্রস্ত আত্মা। সাথে সাথে নারীর বিকাশের সমস্ত পথকে করতে হবে কন্টকমুক্ত। নারীর প্রথম পরিচয় হোক মানুষ হিসেবে- এটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া দরকার।

লেখক: মো. আক্তারুজ্জামান, সদস্য, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (সাধারণ শিক্ষা)।

প্রিয় পাঠক, ভিন্নমতে প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু, রচনারীতি ও ভাবনার দায় একান্ত লেখকের। এ বিষয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার কোনোভাবে দায়বদ্ধ নয়। ধন্যবাদ।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর