আপনি পড়ছেন

চলতি মাসে ঐতিহাসিক ঢাকা সফরের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ঠিক এমন একটি মুহূর্তে তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দিকে আত্মতুষ্টি নিয়ে ফিরে তাকাতেই পারেন। প্রতিবেশীদের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কের অবস্থান প্রচারে তিনি এ বিষয়টি ভালোভাবেই উল্লেখ করতে পারেন।

india bangladesh

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরাপত্তা থেকে শুরু করে কানেক্টেভিটি নিয়ে ভারতের সব উদ্বেগই প্রশমিত করার চেষ্টা করেছেন; অন্যদিকে ভারতও এর বিনিময় দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। কোভিড ভ্যাকসিন সরবরাহে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দেওয়া, একটি সমন্বিত স্থলসীমা চুক্তির মাধ্যমে ছিটমহলগুলোর সমস্যা সমাধান- এরকম নানাবিষয়ে সবসময়ই বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো বাংলাদেশের পাশে থেকেছে দিল্লি।

বাংলাদেশের ৫০তম স্বাধীনতা দিবসে (মার্চ ২৬, যখন পাকিস্তানের নিষ্ঠুর সেনারা অপারেশন সার্চলাইট নামে জঘন্যতম হত্যাকান্ড শুরু করে। ৫০ বছর আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র জায়গায় এই হত্যাকান্ড চলে) সম্মানীয় অতিথি হিসেবে শুধুমাত্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য নয়, ১৯৭১ সালের হত্যাকান্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে জাতিসংঘের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন এবং পাকিস্তানকে এজন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি করে ভারতীয়দের মন জয় করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ভারতীয় কূটনীতিবিদরাও (যারা পাকিস্তান সেনাবহিনীর ভারতঘৃণার রোগকে একটি অর্থবোধক শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো) সঠিক সময়ের মধ্যেই ১৯৭১ সালের গণহত্যার ইস্যুতে গুরুত্ব দিয়েছে। এটি কাশ্মিরের মতো বিবাদমান অঞ্চলেও ভারতকে সহায়তা করেছে; যেখানে ইসলামিক বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাকিস্তানপন্থী স্লোগান এবং তাদের চাহিদা মেটাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে যাচ্ছে।

subir bhaumikসুবির ভৌমিক

১৯৭১ সালের গণহত্যা কাশ্মিরের নেতাদেরকেও প্রশ্নের সম্মুখিন করেছে যে, বাঙ্গালি মুসলিমরা যারা অবিভক্ত পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ, যদি ন্যায়বিচার ও অধিকার না পায় তাহলে শ্রীনগর উপত্যকার মুসলিমরা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কি প্রত্যাশা করতে পারে? যেখানে তারা দেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্রতম অংশ হবে।

কাশ্মিরিরা ভারতের কাছে যা যায় তা পেয়েছে এ বিষয়ে বিতর্কের কিছু নেই। কাশ্মিরের পুরুষরা ভারতের হয়ে ফুটবল খেলছে এবং মেয়েরা শ্রীনগর উপত্যকায় বিমান চালাচ্ছে এবং ভারতীয় পদ্ধতিতে গণতান্ত্রিক বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে সব কাশ্মিরিদের উপকারে আসবে। বইটি কাশ্মিরিদের বোঝার উপযোগী ভাষাতেই পাওয়া যায়।

উত্তরপূর্ব ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর ২০০৯ সাল পরবর্তী সময়ে হাসিনা সরকারের পরিচালিত অভিযান ছিলো অঞ্চলটিতে বিদ্রোহ দমনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক পদক্ষেপ। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের দেয়া তথ্যানুযায়ী, অঞ্চলটিতে বিদ্রোহীদের সহিংসতা ৮০ শতাংশ কমেছে। চলতি মাসে মোদি ও হাসিনার যৌথভাবে উদ্বোধন করা ফেনী নদী সেতুর মতো ‘কানেক্টেভিটি অবকাঠামো’ নির্মাণ এবং আরো নতুন চুক্তির সাথে সাথে ভারতের মূলভূখণ্ড এবং দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের মধ্যে মাল্টি-মডেল ট্রানজিট এখন ক্রমে বাস্তবতায় পরিণত হচ্ছে।
বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পে বিনিয়োগকারী ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এখন ছোট ত্রিপুরাতেও তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং কার্যক্রম বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে।

এছাড়া বাংলাদেশের ইন্টারনেটের মূল সংযোগ হওয়ার সূত্র ধরে আগরতলাও এখন ভারতে ইন্টারনেটের তৃতীয় প্রবেশদ্বার হয়ে উঠেছে; যার সুবাদে উত্তরপূর্বাঞ্চলে আইটি শিল্পে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। এখানে ইংরেজি ও বিজ্ঞান শিক্ষায় আলোকিত হয়ে একটি দক্ষ জনবল তৈরির প্রতিশ্রুতি দেয় যা এখন বেঙ্গালুরু অথবা হায়দ্রাবাদেও দেখা যাচ্ছে।

২৬ মার্চ মোদির সফরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের পাশে থাকার স্মৃতি পুনরায় জাগ্রত হবে, সেসময় খুব ছোট একটা অর্থনীতির দেশ খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি ১০ মিলিয়ন শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিলো। অন্য কোন উপায়ে না হলেও শুধুমাত্র এ বিষয়টিই ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে সাহায্য করে।

ভারত ও বাংলাদেশের একসঙ্গে বেড়ে ওঠা পূর্বনির্ধারিত। বিশ্বব্যাংকের নতুন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে নির্বিঘ্নে পরিবহন যোগাযোগ বাংলাদেশের জাতীয় আয় ১৭ শতাংশ এবং ভারতের জাতীয় আয় আট শতাংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে।

‘সফলতার জন্য সংযোগ: পূর্বাঞ্চলীয় দক্ষিণ এশিয়ায় সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ ও সুযোগসমূহ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটিতে আরো ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, পরিবহন সংযোগ উন্নত হওয়ার পাশাপাশি উভয় প্রতিবেশী মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে (এফটিএ) সই করলে বাংলাদেশের রপ্তানি ভারতে ২৯৭ শতাংশ বাড়বে এবং বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে ১৭২ শতাংশ। এর আগের গবেষণাগুলোতেও বলা হয়েছিলো পরিবহন যোগাযোগ বৃদ্ধি পেলে ভারতে বাংলাশের রপ্তানি ১৮২ শতাংশ এবং বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ১২৬ শতাংশ বাড়বে বলে আভাস দেয়া হয়েছিলো।

পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন নির্বাচন এবং বিজেপির ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় স্বংকল্পে থাকা মোদি মূল্যপরিশোধের বিষয়েও প্রত্যাশা করছেন।

এমতাবস্তায় বাংলাদেশে থাকা ভারতের অনেক মিত্রই তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি, অন্যান্য সাধারণ নদীগুলোর জন্য একই ধরনের চুক্তি কার্যকর হয় কি না, বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা হ্রাসে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ অবসান- এরকম নানা ইস্যুতে সমাধানে কি আশ্বাস এবং ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় সে বিষয়ে মোদির দিকে তাকিয়ে থাকবেন।

এরইমধ্যে কিছু কিছু ইস্যু সমাধানের জন্য পর্দার অন্তরালে কাজ চলছে; অবশ্য এক্ষেত্রে আরো প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ঢাকায় ভারতের একজন প্রগতিশীল হাই কমিশনার এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী রয়েছেন, যারা সেখানে আমাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। অন্যদিকে দিল্লিতেও বাংলাদেশের একজন চৌকস কূটনীতিবিদ রয়েছেন যিনি এখানে তার পূর্বের দায়িত্বপালন করা অবস্থা থেকেই ভারতকে খুব ভালো করে জানেন। এছাড়া এমন একটি পররাষ্ট্রনীতি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যার সুবাদে কোভিডের ভ্যাকসিন থেকে শুরু করে রোহিঙ্গা নানাধরনের ইস্যুতে ভারতকে মূল্যায়ন করা হয়।
মাঝে মাঝে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুপক্ষের মৌলবাদীদের উন্মাদ ছড়িয়ে পড়লেও ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক আরো ফলপ্রসু হতে চলেছে।

লেখক: বিবিসির সংবাদদাতা ও বিশ্লেষক

প্রিয় পাঠক, ভিন্নমতে প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু, রচনারীতি ও ভাবনার দায় একান্ত লেখকের। এ বিষয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার কোনোভাবে দায়বদ্ধ নয়। ধন্যবাদ।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর