আপনি পড়ছেন

নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করা হচ্ছে। দেশ-বিদেশের অনেক নেতাও এতে শামিল হয়েছেন। এর অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ১০১তম জন্মদিনকে উপলক্ষ্য করে ভারতের ওপেন ম্যাগাজিনে একটি দীর্ঘ কলাম লিখেছেন ভারতের শাসক দল বিজেপি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব। ইংরেজিতে লেখা কলামটির শিরোনাম রাখা হয়েছে ‘এ সিটিজেন অব দ্য সাবকন্টিনেন্ট’।

7th march speech of bangabandhu 1

রাম মাধব লিখেছেন, ৫৫ বছরের জীবদ্দশায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের নাগরিক ছিলেন শেখ মুজিব। তার সংগ্রামী জীবনে ভারত ও পাকিস্তান যে ভূমিকা পালন করেছিল তা নিয়ে কথা না বললে মুজিবের জীবন সম্পর্কে আমাদের জানা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

কয়েক সহস্রাব্দ ধরে ভারতের ইতিহাস সভ্যতার ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম যায়। পরবর্তীতে ২৪ বছর পর, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙ্গে বাংলাদেশের জন্ম হয়।

১৯৪৪ সালের ৬ জুলাই সিঙ্গাপুরের একটি রেডিওতে দেওয়া ভাষণে সুভাষ চন্দ্র বোস প্রথমবারের মতো গান্ধীকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে সম্বোধন করেন। পরে ভারতের সংসদ এর স্বীকৃতি দেয়। পাকিস্তানের জন্মের পর জিন্নাহ বাবা-ই-কওম উপাধি অর্জন করেছিলেন, যা পাকিস্তানের জন্য জাতির পিতার সমতুল্য। ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ গঠিত হয়, তখন মুজিবুর রহমানকে জনগণ কর্তৃক ‘জাতির পিতা’ উপাধি দেওয়া হয়।

জিন্নাহর মতো মুজিবও ছিলেন পাইপে ধূমপান করা আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ নেতা। তবে জিন্নাহ ভারতকে বিভক্ত করার জন্য ইসলামকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি বেশিরভাগ মুসলিমকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, একটি স্বাধীন ভারত মানে হিন্দু ভারত এবং মুসলিমরা ভারতে বৈষম্যের শিকার হবে। দেশভাগের আগে বাংলায় জিন্নাহর মুসলিম লীগের বড় রকম প্রভাব ছিল। মুজিব তার যৌবনে জিন্নাহর ভাবনায় প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং বাংলায় মুসলিম লীগের বিভাজন নীতি প্রচারে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তবে মুজিব কেবল মুসলিমদের কল্যাণের কথা চিন্তা করেছিলেন। এর বাইরে, হিন্দু ও মুসলিমদের পৃথক দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে জিন্নাহর যে ভয়ানক তত্ত্বটি ছিল, তা তিনি কখনো গ্রহণ করেননি।

মুজিব বরং সুভাষচন্দ্র বোস এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো নেতাদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন- ‘আমরা যখন সিঙ্গাপুর থেকে রেডিওতে দেওয়া সুভাষ বোসের ভাষণ শুনতাম, উদ্দীপনা পেতাম। আমাদের কাছে মনে হয়েছিল তিনি যদি তার সৈন্যবাহিনী বাংলায় অবতরণ করাতে পারেন তবে ইংরেজদের ক্ষমতাচ্যুত করা আমাদের পক্ষে সহজ হবে। কিন্তু তারপর আমাদের মনে হয়েছিল, তিনি বাংলায় আসলে আমরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাব। তখন দেশের লাখ লাখ মুসলিমের কী হবে? তবে আমি আবারও ভেবেছিলাম, যে ব্যক্তি তার দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সমস্ত কিছু ছেড়ে যেতে পারে, তার দৃষ্টিভঙ্গি কখনো সংকীর্ণ হতে পারে না। মনে মনে সুভাষ বোসের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বাড়তে থাকে।’

দেশভাগের সময় বাংলার পরিবেশ পাকিস্তানের পক্ষে যায়নি, যেমনটি জিন্নাহ কল্পনা করেছিলেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের ভাই এবং বাংলার সিনিয়র কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বসুসহ কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তৎকালীন বঙ্গ প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তারা একসঙ্গে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন। তারা পুরো বাংলা এবং উত্তর-পূর্ব ভারত নিয়ে একটি তৃতীয় দেশের দাবি তোলেন। জিন্নাহ এর পক্ষে ছিলেন, তবে কংগ্রেস দৃঢ়ভাবে এর বিরোধিতা করে। অবশেষে দেশভাগ হয় এবং পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের মধ্যে চলে যায়।

নতুন দেশটি তৈরি হওয়ার সাথে সাথে মুজিবের রাজনৈতিক উত্থানও শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে জিন্নাহর সিদ্ধান্তের কারণে পূর্ববাংলায় ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। মুজিব সেসব প্রতিবাদে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মূলত বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর ওপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে এই আন্দোলনই ভবিষ্যত বাংলাদেশ তৈরির বীজ ছিল। ১৯৫৫ সালে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়, ফলে বাঙালির মধ্যে আরও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তবে সোহরাওয়ার্দীর মতো পূর্ব বাংলার বেশিরভাগ সিনিয়র নেতারা পশ্চিম পাকিস্তান নেতৃত্বের সহকর্মী ছিলেন। এমনকি এক বছরেরও কম সময়ের জন্য (১৯৫৬-৫৭) সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

এদিকে মুজিব বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রচারে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান এবং জেনারেল ইয়াহইয়া খানের মতো লাহোরের শাসকদের ধারাবাহিক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলার মতো, মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের লড়াইয়ে প্রায় ১৩ বছর কারাভোগ করেন। তিনি হেয়ালি করে একবার বলেছিলেন, ‘কারাগার আমার অন্য বাড়ি।’

১৯৭০ সালে পাকিস্তান প্রথম সত্যিকারের সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করে। সামরিক আইনের ছায়ায় অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনগুলো মুজিবকে পাকিস্তানের সর্বাধিক জনপ্রিয় নেতায় পরিণত করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে দুটি বাদে সব আসনে তার দল আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের আরেক বড় নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো আওয়ামী লীগের তুলনায় অর্ধেক আসন পেয়ে নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এই নির্বাচনের ফলাফল পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্কে চূড়ান্ত বিচ্ছেদের সৃষ্টি করে। সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে একজনের উত্থান হবে, এটা মানতে না পেরে জেনারেল ইয়াহইয়া হাত মেলান ভুট্টোর সঙ্গে এবং ১৯৭১ সালের ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত করেন।

পরাজিত এই দুজন নির্বাচন ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেছিল। বাঙালির সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায়। ইয়াহিয়ার শাসনে মুজিবকে গ্রেপ্তার করার পর পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে মানুষ ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু করে।

bangabandhu in kolkata

তবে তৎকালীন ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি মুজিবের পক্ষে ছিল না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ছাড়া তার আশপাশে কোনো বন্ধু পাননি তিনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং তার সেক্রেটারি অফ স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার সেই সময় চীনের মাও সেতুংয়ের বিরুদ্ধে জয়ের লক্ষ্যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহইয়া খানকে সমর্থন দিচ্ছিলেন। ইয়াহইয়া মাওয়ের সঙ্গে নিক্সনের বৈঠকের মধ্যস্থতা করছিলেন সেই সময়। যার কারণে বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্র ইয়াহইয়ার যাবতীয় অন্যায়ে কোনো কথা বলেনি।

চীনও তার পুরোনো বন্ধু পাকিস্তানের সঙ্গেই ছিল। এমনকি নিরপেক্ষ দেশ এবং ইসলামিক দেশগুলোও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেতে রাজি হয়নি। ইয়াহইয়া যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদের কাছ থেকে যে সমর্থন পেয়েছিলেন, তাতে তিনি উজ্জীবিত হন এবং পূর্ব পাকিস্তানে সন্ত্রাসের এক মহাযজ্ঞ পরিচালনা করেন। বাঙালিদের হত্যা, ধর্ষণ ও মারধর করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অমানবিক সন্ত্রাসের এক রাজত্ব চালিয়ে যায়। লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারত সংলগ্ন রাজ্যগুলোতে পালাতে শুরু করে। যার ফলস্বরূপ ১ কোটিরও বেশি শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করেছিল এবং ভারত সরকার তাদের জন্য ব্যবস্থা করেছিল।

মুজিব কারাগারে ছিলেন, তার কাছে পত্রিকা পর্যন্ত যেতে দেওয়া হয়নি। ফলে দেশে কী হচ্ছে তাও তার পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি।

মুজিব বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের জন্য যখন চূড়ান্ত লড়াই চালাচ্ছিলেন, ভারতে ঠিক সেই সময়ে ইন্দিরা গান্ধী একজন শক্তিশালী নেতা হিসেবে গড়ে উঠছিলেন। ১৯৬৬ সালে তাশখন্দে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর অকাল মৃত্যুর পর ইন্দিরা প্রধানমন্ত্রী হন। তার বয়স তখন ৫০ বছরও হয়নি এবং সবাই ভাবেন যে তাকে সহজেই কাবু করা যাবে। কিন্তু ইন্দিরা একজন দৃঢ় সংকল্পের নারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি একবার বলেন, ‘আমার বাবা রাজনীতিতে একজন সাধু ছিলেন, কিন্ত আমি নই।’

তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে নকশালদের এবং মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডে ভারতবিরোধী বাহিনীকে পরাস্ত করেন। এছাড়া দেশের অন্য জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও দমন করেন শক্ত হাতে। ১৯৯৯ সালে কংগ্রেস বিভক্ত হয়ে যায় এবং ইন্দিরা একটি গ্রুপের নেতা হন। ১৯৭১ সালের গোড়ার দিকে যখন তিনি সাধারণ নির্বাচন দেন, জনগণ কংগ্রেসের প্রবীণ নেতাদের তুলনায় তার ওপর বেশি আস্থা রেখে বিপুল ভোটে জয়ী করে।

ইন্দিরা গান্ধী মুজিবকে তার সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ভারতের সাহসী হস্তক্ষেপের জন্য ইয়াহইয়া নৃশংসতার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। ভারত একদিকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত করুণ চিত্র ব্যাখ্যা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মন্ত্রী ও কূটনীতিকদের দূত হিসেবে প্রেরণ করে একটি জনসংযোগ প্রচার চালাচ্ছিল। অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিবাহিনী নামে মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন করার জন্য তিনি সবকিছু করেন।

১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে দুই কাশ্মিরি সন্ত্রাসী শ্রীনগর থেকে একটি ভারতীয় বিমান ছিনতাই করে লাহোরে নিয়ে যায় এবং সেখানে ধ্বংস করে। তত্ক্ষণাৎ পাকিস্তানকে ভারতের আকাশসীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইন্দিরা সরকার। ফলে পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং ইয়াহইয়ার পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে সেনা পাঠানো কঠিন হয়ে পড়ে। জেনারেল ইয়াহইয়া অবশ্য তীব্রভাবে অভিযোগ করেন বিমানটি ভারতীয় এজেন্সিগুলোর চালক ছিনতাই করেছিল।

১৯৭১ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন ওয়াশিংটন ডিসি সফরে যান, প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাকে পাকিস্তানের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করতে হুমকি দেন। অন্যদিকে বেইজিংয়ে মাও সেতুংয়ের কমিউনিস্ট পার্টি ইন্দিরা গান্ধীর বিরোধিতায় প্রতিমূর্তি পোড়াচ্ছিল।

মুক্তিবাহিনীকে ভারত প্রচণ্ড সমর্থন করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি করে তাড়িয়ে দিচ্ছিল এবং ছদ্মবেশে ভারতীয় অঞ্চলগুলোতে প্রবেশ করতে শুরু করে, তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ করতে হয়েছিল। যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী একটি বড় পাল্টা আক্রমণ শুরু করে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সামরিক শাসক এবং পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি অশ্রুসিক্ত অবস্থায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্ব কমান্ডের জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে নতুন জাতির জন্ম হয়। জেনারেল স্যাম মানেকশ ইন্দিরা গান্ধীকে আত্মসমর্পণের বিষয়টি জানালে তিনি তত্ক্ষণাৎ খুশিতে সংসদে যান। উল্লাসের সঙ্গে ঘোষণা করেন, ‘ঢাকা এখন একটি মুক্ত দেশের মুক্ত রাজধানী। বিজয়ের মুহূর্তে আমরা বাংলাদেশের মানুষকে অভিনন্দন জানাই।’

দীর্ঘ নয় মাস কারাবাসের পর মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের একটি কারাগার থেকে মুক্তি পান। এরপর সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তিনি দিল্লিতে থামেন এবং ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির সঙ্গে একটি বড় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। ওই সমাবেশে উপস্থিত মানুষকে সম্বোধন করে তিনি বলেন, ‘ভারতের জনগণ আমাদের সবচেয়ে অন্ধকার সময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং আমরা কখনোই এটা ভুলব না।’

তিনি সত্যিই তার কথা রেখেছিলেন এবং পরের চার বছর সমস্ত ফোরাম এবং ইস্যুতে ভারতকে সমর্থন করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছান এবং প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ তাকে উল্লসিত সংবর্ধনায় স্বাগত জানায়। আবেগ ভরা কণ্ঠে মুজিব ঘোষণা করেন, ‘আমার জীবনের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। আমার বাংলা স্বাধীন।’

মুজিব একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়েন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার শোনার বাংলা’ নতুন দেশের জাতীয় সংগীত হয়ে ওঠে। পরের দুই বছরে মুজিব তার সদ্য জন্মগ্রহণকারী রাষ্ট্রের সঙ্গে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ এবং আমেরিকার দেশগুলোর সম্পর্ক তৈরি করেন। বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থায় (ওআইসি) যোগ দেয়, তবে এর ধর্মনিরপেক্ষতা ত্যাগ করেনি। চীন কয়েক বছরের জন্য ভেটো দিয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রবেশ বন্ধ করে রেখেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত প্রবেশাধিকার দেয়।

নতুন জাতি গঠনের চার বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট উদীয়মান দেশটির ভাগ্যরেখায় দুর্দশা আঘাত হানে। একটি অভ্যুত্থানে মুজিব এবং তার স্ত্রী, ছেলে, ভাইসহ প্রায় পুরো পরিবারকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়।

মুজিবকে হত্যার সময় তার বড় মেয়ে শেখ হাসিনা পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন, যেখানে তার স্বামী এম এ ওয়াজেদ মিয়া পারমাণবিক বিজ্ঞানী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ফলে এই হত্যাযজ্ঞ থেকে তিনি বেঁচে যান। পরে হাসিনা দিল্লিতে চলে আসেন এবং ভারত সরকার তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়। ১৯৮০’র দশকের গোড়ার দিকে তাকে পুনরায় বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। তিনি ১৯৮১ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তার বাবার দল আওয়ামী লীগের সভাপতি হন এবং আজও এটিকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।

শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সত্যিকারের একজন উজ্জ্বল উত্তরাধিকার। তিনি ১৯৯৬ সালে এবং পরবর্তীতে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এরপর থেকে তিনি পরপর তিনটি ম্যান্ডেট জিতেছেন এবং বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

বাবার উত্তরাধিকার রক্ষা করায় শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আসে পাকিস্তানের স্বল্প সমর্থিত মৌলবাদী ইসলামিক বাহিনী থেকে। তার সর্বোত্তম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও উগ্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলো দেশে অশান্তি সৃষ্টি করে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ঢাকার শহরতলিতে মহান নেতার একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা নিয়েও সরকার এই বাহিনীর তীব্র প্রতিবাদের মুখোমুখি হয়। কলকাতার মাওলানা আজাদ কলেজ (পূর্বের ইসলামিয়া কলেজ) ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণেও উগ্রপন্থী শিক্ষার্থীরা মুজিবের একটি ভাস্কর্য স্থাপনের তীব্র বিরোধিতা করে।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে মুজিব বলেছিলেন, ‘আমাদের একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। সম্পর্কটি বন্ধুত্বপূর্ণ। আমাদের বন্ধুত্বের চুক্তিটি আমাদের হৃদয়ে রয়েছে।’ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বছরের পর বছর এই দুই দেশের সম্পর্ক আরও উন্নত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বন্ধুত্বের বন্ধনগুলো নতুন উচ্চতা ছুঁয়েছে।

বাংলাদেশ ভারতের কাছে একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। ভারত এমন একটি দেশের সঙ্গে এই গভীর সম্পর্ক লালন করে, যাদের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও ভারতের ভূমিকা ছিল। একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার আজীবন স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এই অঞ্চলে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে এবং আরও অনেক জাতিরাষ্ট্রের জন্য আদর্শ হয়ে থাকবেন।

লেখক : ভারতের শাসক দল বিজেপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক

প্রিয় পাঠক, ভিন্নমতে প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু, রচনারীতি ও ভাবনার দায় একান্ত লেখকের। এ বিষয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার কোনোভাবে দায়বদ্ধ নয়। ধন্যবাদ।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর