আপনি পড়ছেন

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সক্রিয় হতেই ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক এবং সামরিক বিষয়ে চীনের একক আধিপত্য ও দাদাগিরি কমছে। এমনকি প্রতিবেশী আসিয়ানভুক্ত দেশগুলি থেকেও চীনের দাদাগিরি ও সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতায় লাগাম টানতে সক্ষম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

china usa flag 2019দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় চীনের দাদাগিরি বন্ধে সক্রিয় যুক্তরাষ্ট্র

চীনকে দমাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট একগুচ্ছ কূটনৈতিক উদ্যোগ নেন। মে মাসের প্রথম দিকে ওয়াশিংটনে আসিয়ান নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং শেষদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান সফরে গিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্কের (আইপিইএফ) সূচনা করেন। এটাই চীনকে কোণঠাসা করার বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে। টোকিওতে চতুর্ভুজ নিরাপত্তা সংলাপ বা কোয়াড নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও জাপান, অস্ট্রেলিা ও ভারত কোয়াড শীর্ষ সম্মেলনে চীনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। সিওল থেকেও প্রেসিডেন্ট বাইডেন আরও বেশি সহযোগিতার আশ্বাস আদায় করতে সক্ষম হন।

ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডকে নিয়ে ১৯৬৭ সালে যাত্রা শুরু আসিয়ানের। এখন যুক্তরাষ্ট্রের মদদে তাদের সদস্য দেশ ১০। ১৯৮৪ সালে ব্রুনাই, ১৯৯৫ সালে ভিয়েতনাম, ১৯৯৭ সালে লাওস ও মিয়ানমার এবং ১৯৯৯ সালে কম্বোডিয়া যোগ দেয়। আসিয়ান পুনর্গঠনেও চীনের উদ্বেগ বাড়ছে।

নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নয়নের পাশাপাশি আসিয়ানভুক্ত দেশগুলি যৌথ গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নিয়ে কাজ করছে। সেইসঙ্গে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়েও তাদের একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরে শান্তি বজায় রাখতে ১৯৯২ সালে আসিয়ান দেশগুলির পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা একটি ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন। ২০১২ সালের জুলাই মাসে আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আত্মসংযম এবং বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের বিষয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়ে ছয় দফা নীতি ঘোষণা করেছিলেন।

আসিয়ানের অন্যতম উদ্দেশ্যই হলো আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যকার সমস্যার সমাধান। পাশাপাশি, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখা। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে চীনের শিকারি নজর থেকে এই অঞ্চলকে সুরক্ষিত রাখতে। আসিয়ান সদস্যদের মধ্যে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে চীনের বিরোধ চলছে। দক্ষিণ চীন সাগরের নিয়ন্ত্রন পুরোপুরি নিজেদের দখলে রাখতে চায় চীন। চীনের আধিপত্য রুখতে আসিয়ানকে শক্তিশালী করতে চাইছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। সেইসঙ্গে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নে কোয়াডকেও কাজে লাগাতে চান তিনি।

ওয়াশিংটনে আসিয়ান দেশগুলির সঙ্গে বৈঠক ছিল চীনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কৌশলের একটা অঙ্গ। টোকিওতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক কাঠামো বা আইপিইএফ গঠনের কথা বলে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমন্বয় ও সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করেছেন। বিশ্লেষকদরে মতে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আধিপত্য এর ফলে অনেকটাই কমানো যাবে।

আসিয়ানের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ব্রুনাই, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনাম আইপিইএফের সক্রিয় সদস্য। এছাড়াও রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও নিউজিল্যান্ড। এরমধ্যে ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোয়াডেরও সদস্য। ফলে আসিয়ান এবং কোয়াডের মধ্যে সুসম্পর্ক অবধারিত। এটা চীনের পক্ষে উদ্বেগের। তাই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতিতে নিজেদের দাপট হারানোর ভয় পেতে শুরু করেছে বেইজিং। চীনের অর্থনীতিতেও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নয়া কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

আইপিইএফ যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার অর্থনীতিতে সরবরাহ শৃঙ্খল, ডিজিটাল বাণিজ্য, পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ, শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়তা করবে। চীনের বিপরীতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এমন অর্থনৈতিক কৌশল যুক্তরাষ্ট্র আগে কখনও নেয়নি। এর ফলে বেইজিংয়ের ওপর ছোট ছোট দেশগুলির নির্ভরতাও অনেকটা কমবে। আইপিইএফ গঠন করে যুক্তরাষ্ট্র পরিস্কার বুঝিয়ে দিয়েছে তারা চীনের একাধিপত্য মেনে নেবে না। বরং সরবরাহ শৃঙ্খল বজায় রেখে পরিবেশবান্ধব অবরকাঠামোর উন্নয়ন এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উন্নয়নে আসিয়ান দেশগুলিকে সহায়তা করা হবে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, 'আইপিইএফ মার্কিন-নেতৃত্বাধীন বাণিজ্য নিয়ম প্রতিষ্ঠা করবে। সরবরাহ শৃঙ্খলের ব্যবস্থা পুনর্গঠন করে আঞ্চলিক দেশগুলিকে চীনা অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করবে।' লাওস ও কম্বোডিয়া চীনের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় এবং মিয়ানমারে অত্যাচারী সামরিক সরকার থাকায় তাদের আইপিইএফের সদস্য করা হয়নি। চীন অবশ্য মিয়ানমারের অত্যাচারী-বর্বর সামরিক সরকারকে সমর্থন জুগিয়ে চলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে আইপিইএফ এখন খুবই শক্তিশালী অর্থনৈতিক গোষ্ঠী হয়ে উঠেছে। গোটা দুনিয়ার মোট দেশীয় পণ্য বা জিডিপি-র ৪০ শতাংশই এখানকার। ২০২২ সালে চীনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ২ শতাংশের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের বৃদ্ধির হার দাঁড়াতে পারে ২.৮ শতাংশ। কঠোর লকডাউন ব্যবস্থা চীনের অর্থনীতিকে তছনছ করে দিয়েছে। আবাসন ব্যবসাতেও ধস নেমেছে। ছোট ছোট শহরগুলিতে বাড়িঘরের দাম মারাত্মক কমে গিয়েছে। চীন একদিন আমেরিকাকেও আর্থিক দিক থেকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে যে জল্পনা চলছিল তা এখন দিবাস্বপ্ন। বিশেজ্ঞরা বলছেন, ধুঁকছে চীনা অর্থনীতি।

দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সফর ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলে সঙ্গে তিনি চীনের আগ্রাসী মনোভাবের পাশাপাশি কোয়াড এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতামূলক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে দক্ষিণ কোরিয়ার ভূয়সী প্রশংসা করে শীর্ষস্থানীয় সেমিকন্ডাক্টর, পরিবেশ বান্ধব ইভি ব্যাটারি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি, বায়োটেকনোলজি এবং রোবোটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি বিষয়ে যৌথভাবে কাজ করতে রাজি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের সামরিক হুমকি নিয়ে জাপানের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এছাড়াও উদীয়মান প্রযুক্তি, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো এবং সরবরাহ শৃঙ্খলের স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে আলোচনা হয়। চীন নির্ভরতা দূরীকরণ নিয়েও কথা হয়েছে তাদের মধ্যে।

এশিয়া সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সাফ জানিয়ে গিয়েছেন, চীন যদি তাইওয়ান আক্রমণ করে তবে তার জবাব তারা সামরিকভাবেই পাবে। তিনি বলেন, 'চীনের একতা নিয়ে আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু গায়ের জোর খাটিয়ে তাইওয়ান দখল বরদাস্ত করা হবে না।'

মার্কিন প্রেসিডেন্টের এশিয়া সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় চীনের বিকল্প প্রতিষ্ঠা। সেইসঙ্গে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের দাদাগিরি বন্ধ করা। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর বারবার আঘাত হানছে চীন। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত বলেছে, 'স্থিতাবস্থার পরিবর্তন করতে চায় বা এলাকায় উত্তেজনা বাড়াতে চায় এমন পদক্ষেপের আমরা দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করি। কোনো জবরদস্তিমূলক, উস্কানিমূলক বা একতরফা পদক্ষেপ- যেমন সামরিক শক্তি বৃদ্ধি, উপকূলরক্ষী জাহাজ এবং নৌ-বাহিনীর বিপজ্জনক ব্যবহার প্রভৃতি চলবে না।'

কোয়াডের যৌথ বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের সমুদ্র বিষয়ক আইন মেনেই পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরে সকলকে চলতে হবে। চীনের একতরফা দখলদারি চলবে না। সমুদ্রের আইন মেনেই সকলের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। চীনের কৃত্রিম দ্বীপ এবং সামরিক স্থাপনা নিয়েও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কোয়াড। এক কথায়, দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন যে একক আধিপত্য ও দাদাগিরি দেখাচ্ছিল সেটা আমেরিকার হস্তক্ষেপে বন্ধ হতে চলেছে।

লেখক: মো. মনিরুজ্জামান - সাংবাদিক

প্রিয় পাঠক, ভিন্নমতে প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু, রচনারীতি ও ভাবনার দায় একান্ত লেখকের। এ বিষয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার কোনোভাবে দায়বদ্ধ নয়। ধন্যবাদ।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর