আপনি পড়ছেন

এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে আমরা এখন ঈদ উৎসবের জন্য মুখিয়ে আছি। রোজার আগে থেকে শুরু করে ঈদের আগের দিন শেষ রাত পর্যন্ত ঈদশপিং করি আমরা। ঈদের আগেই ঈদের খুশিতে মেতে ওঠে এদেশের মানুষ। ঈদের পরও এক সপ্তাহ পর্যন্ত ঈদের রেশ লেগে থাকে সবখানে। নির্মম হলেও সত্য যে, এদেশের সব মানুষের ঘরে ঈদ আসে না। সব মানুষ ঈদের আনন্দের জোয়ারে ভাসতে পারে না। শুধু এ দেশেই নয়, এ বিভাজন পৃথিবীর সবখানেই দেখা যায়।

farmer

একদল মানুষ উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে, আরেকদল মানুষ উপোসের বেদনায় চোখের জল ফেলে। যারা উৎসবের আনন্দে মেতে থাকে, তারা কি কখনো উপোস করা মানুষের খোঁজ রাখে? হয়ত তারা ভেবেই নিয়েছে, এক মাসের সংযম শেষে আমরা যেমন ভোগের পেয়ালায় ডুবে যাই, অন্য সবাইও একইভাবে ভোগের পেয়ালায় হারিয়ে যায়। সবাই যা ভুলে যায়, কবি তা মনে করিয়ে দেয়। এ জন্যই তিনি কবি। কবি লিখেছেন-

‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছি কি আজ ঈদ।’

কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশে এ বড় বেদনাময় প্রশ্ন। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ‘কৃষকের ঈদ’ নামে ব্যথাভরা কবিতা লিখেছেন নজরুল। তারও পঞ্চাশ বছর আগে বেগম রোকেয়া লিখেছেন কৃষকের রক্তে আঁকা প্রবন্ধ- ‘চাষার দুঃক্ষু’। যুগ যুগ ধরে এদেশের কৃষকরা যে মানবেতর জীবনযাপন করে আসছে অল্প কথায় এত চমৎকারভাবে আর কেউ বলতে পারেনি। ‘চাষার দুঃক্ষু’ প্রবন্ধ শুরু হয়েছে ছোট্ট একটি কবিতা দিয়ে-

‘ক্ষেতে ক্ষেতে পুইড়া মরি রে ভাই
পাছায় জোটে না ত্যানা।
বৌ এর পৈছা বিকায় তবু
ছেইলা পায় না দানা।’

ক্ষেতে ক্ষেতে পুড়ে মরা কৃষককে নজরুল তুলনা করেছেন শীর্ণ গরুপালের সঙ্গে। নজরুল বলেছেন, ঈদের সকালে কৃষক যখন দল বেধে নামাজে যায়, দূর থেকে দেখে মনে হয়, একদল শীর্ণ গরু খোয়ারে যাচ্ছে। এ ব্যথাভরা দৃশ্য দেখে নবীজির মুয়াজ্জিন বেলালের কথা মনে পড়ে যায় কবির। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, শ্রেষ্ঠ জাতি মুসলমানের জন্য এ দৃশ্য যে কত লজ্জার, তাই বোধহয় এ লজ্জামাখা দৃশ্য দেখার ভয়ে মরু গোরস্থানে লুকিয়ে আছেন বেলাল। চোখের জলে কৃষকের রোজা-ইফতার আর ঈদের দিনে ঋণের বোঝা মাথায় পড়পড় দেহ নিয়ে হাঁটতে থাকা কৃষককে দেখে তাই বেলালের আজানও থেমে যায়। নজরুলের ভাষায়-

রোজা এফতার করেছে কৃষক অশ্রু-সলিলে হায়,
বেলাল! তোমার কন্ঠে বুঝি গো আজান থামিয়া যায়!
থালা ঘটি বাটি বাঁধা দিয়ে হেরো চলিয়াছে ঈদগাহে,
তির-খাওয়া বুক, ঋণে-বাঁধা-শির, লুটাতে খোদার রাহে।

সারা বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেও ‘পাছায় ত্যানা’ জোটাতে না পারার দৃশ্য একশ বছর আগে যেমন ছিলো, এখনো তেমনই রয়ে গেছে কৃষক পরিবারে। তাইতো এ বছরও ধানের নায্য মূল্য না পাওয়ার যন্ত্রণা বুকে নিয়েই ঈদের নামাজ পড়তে যাবেন কৃষক। এবারও কৃষকের চোখের অশ্রু বেলালের আজান থামিয়ে দেবে। হায়! কৃষক মাঠে গিয়ে দেখবে, ওই তো সেই এজিদ- সিন্ডিকেটের মরণ বিষে যে কৃষকের ছেলে-মেয়ে-পরিবারের স্বপ্নময় ঈদকে হত্যা করেছে। আহা! ইমাম খুতবা পড়বেন, কিন্তু কৃষকের অধিকার নিয়ে কথা বলবেন না, জাকাত আদায়ের নির্দেশ দেবেন না; বরং নামাজ শেষে ওই সিন্ডিকেট এজিদের সঙ্গেই কোলাকুলি করবেন। তাইতো নজরুল বলেছে, ঈদের মাঠে যত তাকবির ধ্বনি ওঠবে, কৃষকের হৃদয় ততই হাহাকার করে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে খান খান হয়ে যাবে।

‘কৃষকের ঈদ! ঈদগাহে চলে জানাজা পড়িতে তার,
যত তকবির শোনে, বুকে তার তত উঠে হাহাকার!
মরিয়াছে খোকা, কন্যা মরিছে, মৃত্যু-বন্যা আসে
এজিদের সেনা ঘুরিছে মক্কা-মসজিদে আশেপাশে।’

ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া কৃষকের কথা কে ভাববে? কে বলবে তার অধিকারে কথা? কোনো ইমাম তো খুতবায় কৃষকের কথা বলেন না। কেউ তো কৃষকের অধিকার আদায়ে রাস্তায় নামে না। তাই বড় আফসোস করে নজরুল বলেছেন, কৃষকের অধিকার নিয়ে বলবে, সে ইমাম তো এখনো এ পৃথিবীতে আসেনি। ঈদগাহে কৃষকের লাশ ডিঙিয়ে ধণীরা আসে, লাশ ডিঙিয়েই চলে যায়। অথচ ইমাম চাইলে ধণীদের বলে দিতে পারতেন, কৃষককে মেরে কোন ইসলাম করতে এসেছো তোমরা। আগে কৃষকের পাওনা ফিরিয়ে দাও, তা না হলে ঈদের নামাজ পড়া হবে না। হায়! সে ইমাম নেই। ইমাম হয়ত জানেও না, কৃষক-চাষাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্যই যুগে যুগে নবীরাসুলরা এসেছেন। হজরতম মুহাম্মাদ (সা.) -সহ প্রায় নবীই চাষার বন্ধু রাখাল ছিলেন।

হে আল্লাহ! অসহায় কৃষকদের আপনি ছাড়া কেউ নেই। তাদের জীবনেও আপনি ঈদ এনে দিন। আমিন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর