আপনি পড়ছেন

সেহেরি খাওয়ার সময় শেষ। এখন আর কেউ সেহেরি খাবেন না। এ কথাটির সঙ্গে আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত। পবিত্র রমজানের শেষ রাতে ফজরের আজানের ঠিক ৪-৫ মিনিট আগে (ইসলামিক ফাউন্ডেশন নির্ধারিত সেহেরির শেষ সময়) মুয়াজ্জিন মসজিদের মাইকে এমনটি ঘোষণা করেন। কিন্তু মুয়াজ্জিনের ঘোষণার সঙ্গে রাসুলের (সা.) ঘোষণার সম্পূর্ণ বৈপরীত্য পাওয়া যায়।  

know the reasons for breaking fast

আহলে সুফফার অন্যতম সদস্য জলিলুল কদর সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, عن أبي هريرة قال قال رسول الله ﷺ إذا سمع أحدكم النداء والإناء على يده فلا يضعه حتى يقضي حاجته منه

অর্থ: ‘তোমাদের কেউ যখন আজান শোনে, আর এ সময় তার হাতে খাবারের প্লেট থাকে, সে যেন আজানের কারণে খাবার বন্ধ না করে, যতক্ষণ না সে পেট ভরে খেয়ে নেয়।’ সুনানে আবু দাউদ, সাওম অধ্যায়, হাদিস নং ২৩৪২; মুসনাদে আহমাদ; ২য় খণ্ড, হাদিস নং ৫১০, সনদ হাসান। 

ইমাম হাকেম তার মুসতাদরাকে হাদিসটি গ্রহণ করেছেন এবং ইমাম মুসলিমের শর্তে সহিহ বলেছেন, ইমাম যাহাবি তা সমর্থন করেছেন। হাকেম; আল মুসতাদরাক, ১ম খণ্ড, হাদিস নং ৫৮৮।

তখনকার সময়ে সেহরির জন্য দুটি আজান দেয়া হতো। হজরত বিলাল (রা.) রাত থাকতেই আজান দিতেন। তাই ইবনে ওমর এবং হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন-

عن ابن عمر والقاسم بن محمد عن عائشة رضى الله تعالى عنها أن بلالا كان يؤذن بليل ، فقال رسول الله ﷺ : كلوا واشربوا حتى يؤذن بن أم مكتوم فإنه لا يؤذن حتى يطلع الفجر

অর্থ: ‘বিলাল (রা.) এর আজান যেন তোমাদেরকে সেহেরি খাওয়া থেকে বিরত না রাখে। অর্থাৎ, বিলালের আজান শুনে তোমরা সেহেরি খাওয়া বন্ধ করো না। সে রাত থাকতেই আজান দেয়। তাই তোমরা উম্মে মাকতুমের আজান না দেয়া পর্যন্ত খেতে থাক। সে ফজর না হলে আজান দেয় না।’ সহিহ বুখারি, সাওম অধ্যায়, হাদিস নং ১৭৯৭।

আলোচ্য হাদিসের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত হাদিস বিশেষজ্ঞ এবং মুফাসসির হাফেজ ইমাদুদ্দিন ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘বিলাল (রা.) যে আজান দিতেন তা ছিল ঘুমন্ত মানুষদের জাগানোর জন্য আর তাহাজ্জুদে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের সেহেরিতে ফেরানো বা ডাকার জন্য। তাই তিনি একটু রাত থাকতেই আজান দিতেন।’ ইবনে কাসির; তাফসিরে কোরআনুল আজিম, ২য় খণ্ড, ৫২১ পৃ.।

অর্থাৎ হজরত বিলালের আজান ছিলো মানুষকে সেহেরির সময় হয়েছে এ কথা মনে করিয়ে দেয়ার আজান। কেউ কেউ বলেছেন, হজরত বিলালের আজান ছিলো তাহাজ্জুদ নামাজের আজান। এ আজান এখনো মক্কা-মদিনায় প্রচলিত আছে।

আর উম্মে মাকতুমের ব্যাপারে এই হাদিসের অপর রাবি ওমর (রা.)-এর ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘তিনি ছিলেন অন্ধ। সুবহে সাদিক হয়েছে- এ কথা বলে দিলে তিনি আজান দিতেন।’ কাজী সানাউল্লাহ; তাফসিরে মাজহারি, ১ম খণ্ড, ৩৮৩ পৃ.।

আবু দাউদে বর্ণিত হাদিসটির বর্ধিত অংশসহ মুসনাদে আহমাদের বর্ণনাটি হলো-

عن أبي هريرة قال قال رسول الله ﷺ "إذا سمع أحدكم النداء والإناء على يده فلا يضعه حتى يقضي حاجته منه"
قال وكانوا يؤذنون إذا بزغ الفجر

অর্থ: হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন আজান শোনে, তার হাতে খাবারের প্লেট থাকে, সে যেন আজানের কারণে খাবার বন্ধ না করে, যতক্ষণ না সে পেট ভরে খেয়ে নেয়।

এরপর আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মুয়াজ্জিন এ আজান দিতেন ফজর উদয় হওয়ার পরই।’ মুসনাদে আহমাদ; ২য় খণ্ড, হাদিস নং ৫১০, বায়হাকি, সুনান, ৪র্থ খণ্ড, হাদিস নং ২১৮, আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবনে জারির আত তাবারি, তাফসিরে তাবারি, ৩য় খণ্ড, ২৬১ পৃ.।

সুতরাং ফজরের আজান হলে রোজাদারের খিদে থাকলে সে প্রয়োজন মতো খেয়ে নেবে। এটাই হাদিসের বাহ্যিক অর্থ এবং রাসুলের (সা.) উদ্দেশ্য।’ মুখতাসারে মুনযিরির ওপর শায়েখ আহমদ শাকেরের টিকা; ৩য় খণ্ড, ২৩৩ পৃ.। 

এ সম্পর্কে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দিন আলবানি (রহ.) বলেন, ‘এটা বান্দার জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ এবং ছাড়। তামামুল মিন্নাহ লিল আলবানি, ৪১৭-৪১৮ পৃ.।

বাংলাদেশের মুয়াজ্জিন সমাজের কাছে আবেদন রাখতে চাই, ‘সেহেরি খাওয়ার সময় শেষ’ আপনাদের ঘোষণার মধ্যে এতটুকুই সীমাবদ্ধ রাখুন। ‘আর কেউ সেহেরি খাবেন না’ অতিরিক্ত এতটুকু বলার প্রয়োজন নেই। কারণটি হানাফি মাজহাবের প্রখ্যাত আলেম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) মুখেই শুনুন।

তিনি বলেন, ‘ফতোয়ায়ে আলমগিরিতে উল্লেখ রয়েছে, রমজান মাসের সেহেরির শেষ সময় সুবহে সাদিকের শুরু ধরা হবে না শেষ ধরা হবে- এ নিয়ে প্রথম থেকেই উম্মাহর উলামাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের একটি দল মনে করেন, সুবহে সাদিক শুরু হওয়া মাত্রই সেহেরির সময় শেষ হয়ে যায়। অপর একটি দল মনে করেন, সকালের আলো ভালোভাবে ছড়িয়ে না পড়া পর্যন্ত সেহেরি খাওয়ার অবকাশ থাকে। এখানে প্রথম মতটি সতর্কতামূলক আর দ্বিতীয় মতটি সহজ ও প্রশস্ততামূলক। তবে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই দ্বিতীয় মতটি সমর্থন করেছেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ, আল মুসাবভা।

বিশিষ্ট মুফাসসির এবং তাবেয়ি কাতাদা (রহ.) পবিত্র কোরআনের সেহেরি-সংক্রান্ত একমাত্র আয়াত

وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ

অর্থ: ‘আর পানাহার করতে থাক যতক্ষণ না রাতের কালো রেখার বুক চিরে ভোরের সাদা আলো সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৭।)- এর ব্যাখ্যায় বলেন,

فهما علمان وحدان بينان فلا يمنعكم أذان مؤذن مراء أو قليل العقل من سحوركم فإنهم يؤذنون بهجيع من الليل طويل

অর্থ: আয়াতে বর্ণিত দুটি নিদর্শনই শরিয়তের সুস্পষ্ট সীমারেখা। কাজেই, মুয়াজ্জিনের আজান যেন তোমাদের সেহেরি খাওয়া থেকে বিরত না রাখে। তারা তো রাতের কিছু অংশ ঘুমিয়েই আজান দিয়ে বসে। আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জারির আত তাবারি; তাফসিরে তাবারি, ৩য় খণ্ড, ২৫৫পৃ.।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর