আপনি পড়ছেন

মহান আল্লাহতা’লা বলেন, “হে প্রশান্ত চিত্ত! তুমি তোমার রবের নিকট ফিরে আস সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে, আমাদের বান্দারের অন্তর্ভুক্ত হও, আর আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।” (সুরা ফজর ৯০: ২৭-৩০)

new moon seen in bd sky

তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’লা আরো বলেন- “তোমরা সেই নারীর মতো হয়ো না, যে তার সূতা মজবুত করে পাকাবার পর তার পাক খুলে নষ্ট করে দেয়।” (সুরা নাহল ১৬: ৯২)

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত,

রসুলুল্লাহ (সা.) মদীনায় আসার পর দেখলেন, মদীনাবাসীরা দু’টি ঈদ পালন করে। তা দেখে তিনি বললেন, ‘(জাহেলিয়াতে) তোমাদের দু’টি দিন ছিল- যাতে তোমরা খেলাধুলা করতে, এখন ওই দিনের পরিবর্তে আল্লাহ তোমাদের দু’টি উত্তম দিন প্রদান করেছেন: ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহার দিন।’ (আবু দাউদ, নাসাঈ)

রোজার শেষে ঈদ এলো আবার

রোজা শেষ হয়ে এলো। আজকের দিন শেষেই ঈদ। ঈদ মানে আনন্দ, যে আনন্দ বছর ঘুরে বারবার ফিরে আসে। এজন্যই তো এর নাম ঈদ।

করোনার মধ্যে এটা আমাদের দ্বিতীয় ঈদুল ফিতর। করোনা আমাদের জীবন-পদ্ধতি ও চিন্তাধারাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। এলোমেলো না বলে নাড়িয়ে দিয়েছে বলাই বোধহয় ভালো। সম্ভবত মহান সৃষ্টিকর্তা তা-ই চান। আমাদের নতুন করে চিন্তা করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। প্রচলিত, অভ্যস্ত জীবন পদ্ধতির বাইরে ভেবে দেখতে বলছেন- Think out of this box. বৃত্তাবদ্ধ জীবনে তাই ছন্দপতন হিসেবে করোনা এসেছে।

আমরা যেন সে ব্যাপারে একমত হতে রাজি হচ্ছি না। ঈদ উপলক্ষে বাড়ি-ফেরা মানুষের ঢল ও হুড়োহুড়ি দেখে দেশে কোনো করোনা আছে বলে মনে হয় না। ঘরের পাশেই ভারতে করোনায় মৃতদের দাফন বা দাহ করার জন্য স্থান পাওয়া যাচ্ছে না। সে খবরেও যেন টনক নড়ছে না। চেতনা যেন ভোতা হয়ে গেছে আমাদের অধিকাংশের। ভোতা হয়ে গেছে না ভোতা করে দেয়া হয়েছে ভোতা করে রাখা হয়েছে- সেটা অবশ্য চিন্তার বিষয়।

“Education makes a people easy to lead but difficult to drive; easy to govern but impossible to enslave.” (Henry Peter Brougham)

অর্থাৎ একটা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে সহজে পথ দেখানো যায়, নেতৃত্ব প্রদান করা যায় কিন্তু তাদের গরু-ছাগলের মতো তাড়িয়ে বেড়ানো যায় না। একটা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে শাসন করা সহজ কিন্তু তাদের কোনো অবস্থায় গোলাম বানিয়ে ফেলা যায় না।

আমরা আমাদের ত্রুটিপূর্ণ স্বার্থতাড়িত রাজনীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থার ফল দেখছি সম্ভবত। মানুষকে শিক্ষিত, জ্ঞানী ও চরিত্রবান বানানোর কোনো উদ্যোগ আমরা নিতে পারিনি। সমস্ত উপায়-উপকরণ আর সুযোগ এনে ভর্তি করেছি রাজধানী শহরে। বাকী দেশে কোনো কিছুই গড়ে তুলিনি। ফলে দলে দলে লোক রিজিকের ধান্ধায় শহরমুখী হয়েছে। তাদের শিক্ষিত করার জন্য কোনো উদ্যোগ নেইনি। তাহলে তো মিছিল-মিটিং আর পিকেটিং-এর জন্য সস্তায় লোক পাওয়া যাবে না। দলবাজি করার জন্য অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত আবেগতাড়িত মানুষই যে বেশি দরকার। করোনার এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে বাড়ি যাওয়ার জন্য হুলুস্থুল আর ঈদ মার্কেটিং-এ ভিড় দেখে এমনটা মনে হওয়া স্বাভাবিক। সমাজ-চিন্তকরা ভেবে দেখা দরকার। কারণ পরিস্থিতি এখানেই থেমে থাকবে না। তা ক্রমশ আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। করোনা আমাদের যতটুকু বিপর্যস্ত করেছে বা করবে বলে আশঙ্কা করছি তার থেকে বহুগুণে ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে এই অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, স্যুট-টাই পরা কর্পোরেট মুর্খ ও উশৃঙ্খল জনগোষ্ঠী। বস্তিবাসী, নগরবাসী, সুখী মানুষেরা সাবধান!

রোজা ও আদর্শ জাতি গঠন

রোজা আসে একটা জ্ঞানবান, সুশৃঙ্খল ও চরিত্রবান জাতি গঠনের লক্ষ্য নিয়ে। দেখুন না রোজায় আমরা কি কি করি:

> সারাদিন ক্ষুধা ও কামতৃপ্তির লাগাম টেনে ধরি। ঠিকঠিক সময় মতো সেহেরী ও ইফতার করি। দীর্ঘ একটা মাস ধরে করি। সুশৃঙ্খল জাতি গঠনের কি সুন্দর ব্যবস্থা!

> দিন শেষে ক্লান্ত শরীরে পুনরায় রাত্রি জাগরণ করি। বাড়তি নামায আদায় করি। আরাম-আয়েশকে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা।

> রোজায় বেশি বেশি কুরআন অধ্যয়ন করি। আদর্শ মানুষ, পরিবার ও জাতি গঠনে রব্বুল আলামীনের হেদায়াতের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলি। জানবার ও উপলব্ধি করার চেষ্টা করি আমাদের জন্য কল্যাণকর বা ক্ষতিকর কাজ কোনগুলি। আর সেগুলো থেকে ফিরে থাকার জন্য রব্বে কারীমের তাওফীক চাই।

> সর্বোপরি রোজায় সারাটা মাস আল্লাহকে হাজির-নাজির জানার এবং তাঁর নাফরমানী থেকে, স্বেচ্ছাচারী আচরণ থেকে, খামখেয়ালী থেকে, অপরের জন্য ক্ষতিকর আচরণ থেকে বাঁচার জন্য জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করি।

> একটা আদর্শ জাতি গঠনের জন্য এর থেকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা কি হতে পারে? কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের মধ্যে এর ছাপ পাওয়া যাচ্ছে খুব কমই।

এর কারণ, আমরা দ্বীনের অনুষ্ঠানগুলি পালন করছি কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া। কেন এ বিধান তার উপলব্ধি ছাড়াই। কেন এ সব হুকুম দিলেন আল্লাহতা’লা? তাঁর সৃষ্টিতে খাওয়ার কমতি এজন্য মুসলমানদের এক মাস না খাইয়ে রাখা? বরং রমজানে আমরা অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশিই এবং ভালই খাই, যার যার সামর্থ মতো। তাঁর বান্দাদের কষ্ট দিয়ে তাঁর কি লাভ? উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো কাজ তো তিনি করেন না। রোজার শিক্ষা উপলব্ধি ও বাস্তবায়ন ছাড়া আদর্শ মানস, আদর্শ মানুষ, আদর্শ জাতি গঠন করা অসম্ভব।

কেউ কেউ জনগণের বর্তমান বেপরোয়া মনোভাবের জন্য ধর্মকে দোষী করতে চান। ধর্মের কারণেই নাকি মানুষ Fatalist- অদৃষ্টবাদী হয়ে গেছে। ‘যা হয় হবে’ – এ মনোভাব নাকি ধর্ম থেকে পেয়েছে মানুষ। কোন ধর্মের কথা বলছেন? ইসলামে এ রকম শিক্ষা নেই। উমর (রা.)-এর থেকে তো আর আজকের মানুষ মুত্তাকী হয়ে যায়নি। তিনি তো নবীর শিক্ষা অনুসরণ করে মহামারী আক্রান্ত এলাকায় গেলেন না। আবু উবাইদা ইবনুল জাররা (রা.), যাকে “আমীনুল উম্মাহ” নাম দিলেন রসুল (সা.)। তিনিও তো রসুলের শিক্ষা অনুযায়ী মহামারী কবলিত এলাকা থেকে বের হলেন না। তাহলে তারা কোন ইসলাম মেনেছেন? আমরা কি মানছি? তারা কোন নবীর অনুসারী ছিলেন? আমরা কার অনুসরণে এসব করছি? অজ্ঞ এই জনসাধারণ। ততোধিক অজ্ঞ এদের মধ্যে বিজ্ঞতার ভান করা চিন্তাবিদ ও প্রোপাগান্ডিস্টরা (প্রচারক গোষ্ঠী)।

ইসলাম সমস্যা নয়, সমাধান। এ অনুযায়ীই সমাধান খুঁজতে হবে। মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে নয়, ইসলামে এগিয়ে আনতে হবে। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা নিজেরা গ্রহণ করতে হবে। জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।

রোজার পর কি

রোজা চলে যাচ্ছে। এর পর আমাদের দায়িত্ব কি? এক মাসের এই তালীম, অভ্যাস এসব কি ঈদের দিনেই শেষ? বরং রোজার দাবী হল- রোজার শিক্ষা অনুযায়ী সারাটি বছর চলা। সারা বছর রোজাকে ধরে রাখা। তা কিভাবে সম্ভব?

> রোজার একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল ভাল ভাল গুণ- হঠাৎ করেই আয়ত্ত করা যায় না। ভাল ভাল শিক্ষা, বা ভাল চিন্তাগুলি সহসাই বাস্তবায়ন করা যায় না। হঠাৎ করেই নিজের চরিত্র আর অভ্যাসের দুর্বল দিকগুলি বদলে ফেলা যায় না। এজন্য দরকার নিরন্তর ও নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা।

> মানব রিপুগুলো যেমন- লোভ, পরশ্রীকাতরতা, হিংসা, মিথ্যাচারিতা, সন্দেহপ্রবণতা, কুধারণা, অহমিক, আমিত্ব প্রভৃতি হঠাৎ করে দূর করা যায় না। তেমনি মনে হল আর অমনি গীবত, চোগলখুরি, মিথ্যাচার, কথায় কথায়- রেগে যাওয়া, অশ্লীলতার প্রতি আকর্ষণ, অন্যের সম্পদের প্রতি অবৈধ লিপ্সা প্রভৃতি কর্মকাণ্ড বদলে ফেলাও সহসা সম্ভব নয়। অনেকের সমস্যা হলো, শুধুই অন্যের দোষ ধরেন। নিজের গুণ না বাড়িয়ে অন্যের দোষ গেয়ে সমাজ বদলাবে না। অন্যের দোষ আপনার গুণ নয়। কথায় কথায় কোনো কাজ না হওয়ার জন্য অন্যকে দায়ী করে নিজের কাজটা না করাকে justify করা যায় না।

> একইভাবে কল্যাণকার গুণগুলি যেমন সত্যবাদিতা ও সততা, ন্যায়নিষ্ঠতা, ক্ষমাশীলতা, চারিত্রিক পবিত্রতা ও শালীনতা, আদব ও সুশীলতা, সুন্দর চিন্তা ও সুন্দর ভাষা, সৎকাজে প্রতিযোগিতা, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা প্রভৃতি গুণগুলি আমরা মূল্যায়ন করলেও এগুলো অর্জন কিন্তু একদিনের বা এক রোজার কাজ নয়। প্রয়োজন নিয়মিত ও সচেতন আত্মসমালোচনা ও অনুশীলন।

> এ লক্ষ্যেই রোজা বছর ঘুরে আবার আসে। প্রত্যেক মুমিনকেই রোজা পালন করতে হয়। আল্লাহ জানেন বান্দা একবারে পারবে না, শয়তান তাকে ভুলিয়ে দিবে, ভুল করাবে। তাই রোজার এই বাৎসারিক বিধান।

> তবে রোজাকে সারা বছরের আমলে পরিণত করার সুন্দর ব্যবস্থা আল্লাহ পাক দিয়েছেন। যেমন-

১. শাওয়ালের ৬ রোজা: রমজান শেষে শাওয়াল মাসে ৬ দিন রোজা রাখার বরকতের কথা নবী (সা.) তার হাদীসে বলেছেন। ব্যাখ্যা করে বলেছেন এতে সারা বছর রোজা থাকার সওয়াব পাওয়া যাবে। এই বরকতময় ৬টি দিনের রোজা পালন করি। ঈদের পর দিন থেকেই এটা শুরু করা যায়। একনাগারে ৬ দিন বা ভেঙে ভেঙে ৬ দিন রাখতে পারি।

২. আইয়্যামে বিজ বা প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা।

৩. জিলহাজ্জ মাসের ৯ তারিখের রোজা। এদিনের রোজার ব্যাপক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে হাদীসে। যারা হজ্জে যাবেন না তারা জিলহাজ্জ মাসের ১-৯ তারিখ রোজা রাখতে পারেন। জিলহজ্জের প্রথম ১০ দিনের ফযীলতের কথা কুরআন-হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে।

৪. মহররমে আশুরার রোজা, মহররম মাসের ৯-১০ বা ১০-১১ তারিখে রোজা রাখা।

৫. প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোজা।

> মনে রাখতে হবে, এ সবই নফল রোজা। তবে রোজাকে সারা বছর অনুভূতিতে ও আমলে রাখার জন্য তা খুবই সহায়ক। নিজেকে সুশৃঙ্খল করা ও পরিবারে দ্বীনি পরিবেশ সৃষ্টিতেও তা সাহায্য করে।

> তাজাজ্জুদ আদায়: রমজানে একমাস ইশার পর অতিরিক্ত তারাবী আদায় করেছি আমরা। রাতে উঠে সেহরী খেয়েছি। তখন তাহাজ্জুদও আদায় করেছি। তাহাজ্জুদ দোয়া কবুলের সময়। নবী (সা.) মদীনায় এসে সর্বপ্রথম যে খুৎবা দেন তাতে বলেছিলেন-

“হে মানুষেরা, তোমরা বেশি বেশি সালামের প্রচলন কর: লোকদের আহার করাও। আর মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায আদায় কর (অর্থাৎ তাহাজ্জুদ পড়) তাহলে জান্নাতে যেতে পারবে।” (তিরমিযী)

> তাহাজ্জুদ আদায়ের অভ্যাসটা ধরে রাখি। যাদের বেশি কষ্ট হয় তারা ঘুমাতে যাওয়ার আগে অন্তত ২-৪ রাকাত নফল নামায পড়ি। তাহাজ্জুদ আদায়ের নিয়ত করি এবং এর জন্য আল্লাহর কাছে তাওফীক চাই।

> তাওবা-ইস্তেগফার-দোয়া: রোজা আমাদের বেশি বেশি তাওবা-ইস্তেগফারের তাগিদ দেয়। রোজার শেষ ১০টা দিন আমরা নবী (সা.)-এর শেখানো এই দোয়াই বেশি বেশি পড়েছি-

“হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে আপনি ভালবাসেন, আমাকে ক্ষমা করে দিন।”

বেশি বেশি তাওবা করি, ইস্তেগফার করি ও দোয়া করি:

# গুনাহ-খাতা মাফের জন্য

# বিশুদ্ধ ঈমান, ইলম ও আমলের জন্য

# নির্মল চরিত্রের জন্য

# সন্তান, রিযিক, স্বাস্থ্যের জন্য

# মুরুব্বীদের নাজাতের জন্য

# বিশ্ব মুসলিমের কল্যাণের জন্য

# বিশ্ব মানবের হেদায়াত ও কল্যাণের জন্য

> দান-সাদাকা: রমজান আমাদের দায়িত্বশীল জীবনযাপন শিক্ষা দেয়। তাই রমজানে আমরা যাকাত দেই, বেশি বেশি দান-সাদাকা করি, ফিতরা আদায় করি। এ আমলা রোজার পর সারাটা বছর ধরে রাখি। বিশেষত, বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে সর্ব সাধারণের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই। কত কিছুই না করছে মানুষেরা, আমিও শুরু করি। অন্যদের সাথে সামিল হই। যা পারি যতটুকু পারি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করি। তা বহুগুণে আল্লাহ আমায় ফিরিয়ে দিবেন।

> আচার-আচরণ: রমজানে যেরকম সুন্দর-শালীন ও পরিমিত আচরণ করেছি তা সারা বছর অব্যাহত রাখি। ঘরের মানুষ, কাজের মানুষ, নিকট মানুষ এরাই আমাদের সবচেয়ে কাছের। কিন্তু দুর্ভাগ্য কি দেখুন, এদের সাথেই সবচেয়ে বেশি খারাপ ব্যবহার করি আমরা। হাদীসে এসেছে, সুন্দর আচারণ সবচেয়ে বেশি মানুষকে জান্নাতে পৌঁছাবে। আমাদের পারিপার্শ্বিক মানুষদের সাথে সুন্দর ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুলি। এই মহামারীতে সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, পেরেসান, পরিশ্রান্ত। আপনি আমিও তার বাইরে নই। তবু একটু সাহস কর অন্যদের প্রতি ভাল ব্যবহার করি। তাদের প্রতি সহানুর্ভতির দু’টি বাক্য খরচ করি।

> ক্ষমা ও উপেক্ষা: রমজান শেখায় মূর্খতাসুলভ আচরণকে উপেক্ষা করতে। মানুষকে ক্ষমা করতে। অনেক সময় ক্ষমা করা কষ্টকর হয়ে পড়ে, সন্তানের অবাধ্যতা ও উপেক্ষা, আবার পিতামাতার অসদাচরণও মানুষকে কষ্ট দেয়। হ্যাঁ, এটা একটা বড় সমস্যা। অধিকাংশ সময় সন্তানের দায়িত্ব বড় করে দেখা হয়। কন্তিু ভুলে যাওয়া উচিত নয়, সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্বটাই আগে এবং পরবর্তী বিষয়ও তার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। নিকট ও বিশ্বাসভাজন মানুষদের থেকেই আমরা কষ্ট পাই বেশি। তাই মাফ করাটা অনেক সময় কষ্টকর। তবে মাফ করাতেই সবচেয়ে বেশি সওয়াব। “তোমরা যদি তাদের মাফ করে দাও, তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা কর এবং তাদের ক্ষমা কর, তবে জেনে রাখ আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।” (তাগাবুন ৬৪: ১৪) আমরাও তো চাই আল্লাহ আমাদের এত এত গুনাহ সত্ত্বেও মাফ করে দিবেন। তাই আমরাও ‘আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হই’, ক্ষমার অভ্যাস গড়ে তুলি। অপরাধী ও অন্যায়কে ভুলে যেতে বলছে না কেউ। রসুল (সা.) বলেন, ‘মুমিন কখনো এক গর্তে দুইবার পড়ে না।’ সাবধান থাকাতে দোষ নেই। তবে রাগ পুষে না রাখি। দূরে ঠেলে না দেই।

> কুরআন অধ্যয়ন: রমজানের আরেক বৈশিষ্ট্য-মণ্ডিত আমল কুরআন অধ্যয়ন। সারা বিশ্বে এ মাসে কুরআন মজীদ যত পড়া হয় বোধ করি আর কোনো মাসে এ রকমটা হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের যারা পড়ছি তারা অধিকাংশই না বুঝে খতম করছি। না বুঝে খতম করার জন্য কুরআন আসেনি। এটা আর সব ধর্মীয় কিতাবের মতো মন্ত্রের বই না। এটি জীবন বিধান। আমার আপনার জীবন পথের দিশা, জীবন সমস্যার সমাধান, অন্তরের রোগের ও মানসিকতার চিকিৎসা; পরিবার-সমাজ ও জাতির সংশোধন, সংস্কার, পরিশুদ্ধি, পবিত্রতার পথ ও পদ্ধতি। না বুঝে পড়লে তা কেমনে হাসিল হবে? তাই সারা বছর প্রতিদিন নিয়ম করে কুরআন পড়ার অভ্যাস করি। অর্থসহ, তাফসীরসহ পড়ি। সহীহ হাদীস পড়ি। নবীর জীবনী ও অন্যান্য সহায়ক গ্রন্থগুলি পড়ি। নিজের জীবনের সাথে মিলাই। কুরআনের আলোয় জীবন গড়তে এগিয়ে আসি।

> পবিত্র জীবনের জন্য পবিত্র সোহবত-সংসর্গ: মুমিন রোজা রাখে একা কিন্তু গোটা মুসলিম বিশ্ব কাজটা করে একই সাথে, একই মাসে, একই আমল ও আচরণে। আমাদের এই যে জাতি, একই জাতি মুসলিম উম্মাহ। উম্মাহ-কেন্দ্রীক অনুভূতি আমাদের মধ্যে জাগ্রত রাখার চেষ্টা করি। সেরকম নেককার-পবিত্র লোকদের সাথে উঠাবসা করি, পরস্পরের সোহবতে নিজেদের শুদ্ধ করি।

ঈদ ও ঈদ ভাবনা

ঈদ নিয়ে লিখতে বসে আবার করণীয় বিষয় নিয়ে ফিকির করছি। কেউ তাতে অন্যরকম ভাবতে পারেন। মুহাম্মাদ ইবনে ওয়াসী পূর্বকালের এক নেককার ব্যক্তি। ‘মুজিবুদ দাওয়াত’ (অর্থাৎ এমন ব্যক্তি যার দোয়া আল্লাহ অবশ্যই কবুল করেন) হিসেবে মানুষ তাকে জানতো। ইবাদত বন্দেগী, আল্লাহ ও মানুষের হক আদায়ে অত্যাধিক তৎপর মানুষ ছিলেন। জিজ্ঞাসা করা হলো একটু বিশ্রাম নেন না কেন? জবাব দিলেন- ‘বিশ্রাম করে নিরাপদ ব্যক্তি। আমি এখনো ভীত।’

আমি-আমরা এখনো নিরাপদ নই। নিরাপত্তা হলো যখন রহমতের ফিরিস্তা জান কবচ করতে আসবে। যখন মুনকার-নাকির কবরের প্রশ্ন শেষে বলবে এখন বিশ্রাম করো কিয়ামত পর্যন্ত; নিরাপত্তা হলো গুনাহ-খাতাগুলো গোপন করে আমাদের মালিক তাঁর রহমতের চাদর দিয়ে আমাদের ঢেকে দিবেন। বলবেন যাও বান্দা তুমি মুক্ত-

“হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার রবের নিকট ফিরে আসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে, আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও, আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।” (ফজর ৯০ : ২৭-৩০)

সারা মাস রোজা রেখে ঈদ হলো যেন একটা মাসের ইফতার। ইফতার যেমন- প্রশান্তিতে অন্তরটি ভরিয়ে দেয়, ঈদও যেন তেমনি আমাদের মনগুলো, প্রাণগুলো, ঘরগুলো প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেয়।

ঈদের আনন্দ তো মূলত: রোজাদারের। হাদীসে এসেছে, যে ঈদগাহে উপস্থিত হবে তার সারা মাসের মজুরী তার প্রভুর কাছ থেকে বুঝে নিতে। আল্লাহও তাঁর বান্দাদেরকে তাদের প্রচেষ্টার বিনিময়ে মাফ করে দিবেন। কিন্তু যে সব গাফেল নানা অজুহাতে রোজা রাখেননি তাদের কি হবে? তারা তাওবা করুন। গুনাহর জন্য মাফ চান। নামাযে পাবন্দ হয়ে যান। হারাম ত্যাগ করুন। হ্যাঁ, হারাম। ইসলাম বিরোধী হারাম চিন্তা, হারাম লালসা-অভিলাস, হারাম আয়-উপার্জন-সম্পর্ক এগুলোই তো আল্লাহর পথে বাধা। রোজার পথে বাধা, এগুলো ছাড়তে হবে প্রিয় ভাই ও বোনেরা আমার। দুনিয়ায় সামান্য সময়ের আরামের জন্য চিরদিনের কষ্ট ও শাস্তি কবুল করবেন কোন বুদ্ধিতে? জান্নাতের নেয়ামত হাতছাড়া করবেন কোন চিন্তায়?

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন-

“আমরা বললাম, “হে আল্লাহর রসুল আমাদের জান্নাত সম্পর্কে বলুন, তা কিসের তৈরি? উত্তরে তিনি (সা.) বললেন, সোনা ও রূপার ইটের তৈরি, তার গাঁথুনী হবে মিশক আম্বরের। তার নুড়ি ও কংকর হবে মনিমুক্তা ও ইয়াকুত পাথরের। আর তার মাটি হবে জাফরানের। যে তাতে প্রবেশ করবে সে (অশেষ) নিয়ামত প্রাপ্ত হবে। নিরাশ হবে না, বা অভাব বোধ করবে না, সেখানে সে চিরস্থায়ী হবে, মারা যাবে না। তার পোশাক কখনো পুরানো হবে না, তার যৌবন কখনো শেষ হবে না।” আহমদ, তিরমিযী)

এই জান্নাত, এই চির যৌবন, এই চিরশান্তি হারাবো কেন আমরা?

এই ঈদ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হচ্ছে না। তাই একটা আলাদা সতর্কতা জরুরী হবে। স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই মানি। শারিরীক দূরত্ব বজায় রাখি, সামাজিক নয়। বিশ্ব সংস্থাগুলো এক একটা বিভ্রান্ত, মানবতাবিরোধী সাম্রাজ্যবাদ ও ধনীদের তল্পিবাহক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। শারীরিক দূরত্বকে তারা বলে সামাজিক দূরত্ব। না, বরং শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সামাজিকভাবে আরো কাছাকাছি আসতে সচেষ্ট হব। মুরুব্বীদের খোঁজ নেই, ছোটদেরও। দুর্বলদের খোঁজ নেই। সাহস, দেই সান্ত্বনা দেই। ঈদের আনন্দ ঘরে ঘরে পৌঁছে দেই। আল্লাহ তাওফীক দিন। কবুল করে নিন এই ঈদ আপনার, আমার সবার জন্য। আমীন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর