আপনি পড়ছেন

মহান আল্লাহ তা’লা বলেন, “দু’টি দলের পরস্পর সম্মুক্ষীন হওয়ার মধ্যে তোমাদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে। একদল আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছিল; অন্যদল ছিল কাফির; তারা তাদেরকে (অর্থাৎ মুমিনদেরকে) চোখের দেখায় দ্বিগুণ দেখছিল। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন। নিশ্চয়ই এতে অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন লোকের জন্য শিক্ষা রয়েছে।” (সূরা আলে-ইমরান ৩: ১৩)

the badar day 17 ramadan১৭ রমাদান, ঐতিহাসিক বদর দিবস, ফাইল ছবি

আয়াতে কারীমায় বদরের যুদ্ধের দিকে মহান আল্লাহ্ তা’লা ইঙ্গিত করেছেন। বদরের যুদ্ধ ইসলাম ও কুফরের প্রথম সশস্ত্র দ্বন্দ্ব। মুসলমানরা এ যুগে আল্লাহর রহমতে বিজয় লাভ করে।

বিজয়ের মাস রমাদান

দিনটি ছিল ১৭ রমজান। দ্বিতীয় হিজরী সন। মক্কার কুরাইশরা এক হাজার সৈন্যের সুসজ্জিত এক বাহিনী নিয়ে মদীনার উপর হামলা করার জন্য অগ্রসর হল। রসূলুল্লাহ্ (সা.) ৩১৩ জন্য সাহাবী নিয়ে তাদের মোকাবেলা করার জন্য উপস্থিত হলেন। কুরাইশ বাহিনীতে ছিল ১০০ ঘোড়সাওয়ার, ৬০০ বর্মধারী সৈন্য এবং বহুসংখ্যক উট। আর মুসলিম বাহিনীতে ছিল মাত্র ২টি ঘোড়া এবং ৭০টা উট।

পার্থিব শক্তিমত্তার দিক দিয়ে এই দুর্বল বাহিনী তাদের থেকে প্রায় তিনগুণ সৈন্যের সুসজ্জিত হানাদারদের পরাজিত করে। আবু সুফিয়ান ছাড়া তাদের সব নেতা নিহত হয়। বাহিনীর ৭০ জন নিহত হয় এবং ৭০ জন হয় আটক -

“ আল্লাহর হুকুমে কত ক্ষুদ্র দল কত বৃহৎ দলকে পরাজিত করেছে।” (বাকারা ২: ২৪৯)

এই রমাদান মাসেই সংঘটিত হয় বিরোধী শক্তির উপর ইসলামের চূড়ান্ত বিজয়- মক্কা বিজয়। এটি ছিল হিযরতের ৮ম বছর ২০ রমাদান।

পরবর্তীকালের ইতিহাসেও রমাদান মুসলমানদের জন্য বিজয়ের বার্তা নিয়ে এসেছে।

শক্তির উৎস রামাদান

স্বাভাবিক চিন্তা হল, দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকায় মানুষের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা সৃষ্টি হবে। কিন্তু এর বিপরীত চিত্র দেখি আমরা বদরে বা মক্কা বিজয়ের ঘটনায়।

বদরের যুদ্ধের বছর মুসলমানদের উপর প্রথমবারের মতো রোজা ফরজ করা হয়। ১৩/১৪ দিন রোজার পর মুসলমানরা জানতে পারলো, ইসলাম বিরোধী শক্তির মোকাবেলা করতে হবে তাদের। আর ১৭ রমাদান তো বদরই সংঘটিত হল। মূলত: শক্তির উৎস হল- বিশ্বাসের যথাযর্থতা এবং নৈতিকতা ও চরিত্র। দৈহিক শক্তি, টাকা-পয়সা, অস্ত্র-শস্ত্র বা দল-বল-জোট নয়।

প্রথমত: শক্তির উৎস সঠিক বিশ্বাস। সঠিক বিশ্বাস মানুষকে দেয় লক্ষ্যের দৃঢ়তা। যে মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তি হল সর্বময় ক্ষমতার মালিক মহান আল্লাহ্ তা’লার তাওহীদের উপর, সে জানে জীবন-মৃত্যু, জয়-পরাজয়, সাফল্য-ব্যর্থতা, দুনিয়া-আখিরাত সব কিছুর মালিক একমাত্র তিনিই। সে নিশ্চিন্তভাবে দ্বীন ইসলামের অনুসরণ করে। কারণ সব কিছুর স্রষ্টা, সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী ও সব মানুষের প্রভু মহান আল্লাহ্ তা’লা এ দ্বীন মানুষকে দান করেছেন।

- এতে কোনো ভুল নেই, কারণ সব বিষয়ের জ্ঞান যাঁর করায়ত্ত তিনিই এই দ্বীন, এই বিধি-ব্যবস্থা এবং এই নিয়ম-আইন-বিধান দান করেছেন।

- আর এতে পক্ষপাতিত্বের কোনো অবকাশ নেই। কারণ তিনি সব মানুষের প্রভু। সব মানুষই তাঁর বান্দা, তাঁর সামনে সবাই সমান। সাদারা একটু বেশী তাঁর প্রিয় আর কালোরা একটু কম- এমনটির কোনো স্থান নেই এখানে। কোনো বিশেষ জাতি-গোষ্ঠীকে তিনি বেশী ভালবাসেন তাদের জাতীয়তা, বর্ণ বা ভাষার কারণে এমনটির কোনো সুযোগ নেই। তাঁর ভালবাসার ভিত্তি নীতি-নিষ্ঠতা, সত্য ও সততা ও সর্বোপরি তাঁর প্রতি আনুগত্যে একনিষ্ঠতা ও অবিচলতা-

“ইন্না আকরমাকুম ই’নদাল্লহি আতক্বা-কুম” অর্থাৎ “নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট সে-ই সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মুত্তাকী বা পরহেজগার।” (সূরা হুজুরাত ৪৯: ১৩)

মুত্তাকী বা পরহেজগার বলতে আমাদের সামনে একটি বিশেষ ছবি ভেসে উঠে। দাঁড়ি-টুপি পরিহিত জুব্বা বা হিযাবধারী কোনো পুরুষ অথবা নারী। যারা বাহ্যিকভাবে তো খুব ধার্মিক। কিন্তু বাস্তব জীবনে পরিবারের প্রতি দায়-দায়িত্ব, দুনিয়ার প্রতি দায়-দায়িত্বে বিমুখ। বরং এমন অনেকেই আছেন লেবাসে-পোশাকে তো খুব পরহেজগার কিন্তু লেন-দেনে দুনিয়াদারের চেয়েও বেশী নীতিহীন। (আল্লাহ্ আমাদের এমন লোকদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করুন)। বর্তমানে তাকওয়ার পোশাকধারী মানুষের অনেকের মধ্যেই এ ধরনের ত্রুটি বিদ্যমান। হাদীস অনুযায়ী অসদাচারী মানুষের বাহ্যিক সুরত ও আনুষ্ঠানিক আমল তাকে তার অসৎ স্বভাবের ক্ষতিকারতা (তথা আখিরাতে শাস্তি) হতে রক্ষা করতে পারবে না। রসূল (সা.) বলেন, “যার হাত ও মুখ হতে অন্য মানুষ নিরাপদ নয় সে মুসলিম নয়।” (বুখারী)

- হাত হতে মানে হাত দিয়ে মানুষের যে ক্ষতি হয় তা হতে অর্থাৎ অত্যাচার-জুলুম, ক্ষমতার ক্ষতি হতে।

- আর মুখ হতে মানে মুখ দিয়ে অপরের যে ক্ষতি করা হয় তা হতে। যেমন- মিথ্যা কথন, মিথ্যা সাক্ষ্য, গীবত, মিথ্যা অপবাদ, গালি-গালাজ, কটাক্ষ, খোঁটা দেয়া ইত্যাদি।

দ্বিতীয়: মানুষের শক্তির দ্বিতীয় উৎস নৈতিক চরিত্র।

রসূল (সা.) বলেন, শক্তিমান বীর পুরুষ সে নয় যে কুস্তিতে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দিতে পারে, বরং প্রকৃত বীর শক্তিমান সে, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। (বুখারী)

চরিত্রহীন, অসংযমী দুর্বল চরিত্রের মানুষ দিয়ে কোন মহৎ কাজ হয় না। ওহুদে মুসলমানদের বিপর্যয়ের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ্পাক বলেন-

“সেই দিন তোমাদের মধ্যে যারা পালিয়ে গিয়েছিল, তাদের কোন কোন কৃতকর্মের জন্য শয়তানই তাদের পদস্খলন ঘটিয়েছিল।” (আলে-ইমরান ৩: ১৫৫)

রমজান মানুষের মধ্যে এ দুই ধরনের শক্তি ও যোগ্যতা সৃষ্টি করে এবং জোরদার করে:

- রোজা মানুষের মধ্যে ঈমানী মজবুতী তৈরী করে। রোজাদার সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত না খেয়ে থাকে তার সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য। ক্ষুধার কষ্ট, পিপাসার কষ্ট, নফসের আকুতি সব কিছুর উপর সে সবর করে, সংযম অবলম্বন করে। এমনকি লোক চক্ষুর অন্তরালেও। কেন? আর কেউ না দেখুক আমার মালিক দেখছেন। আমি তাঁর দৃষ্টির সম্মুক্ষেই আছি, সর্বাবস্থায়। দীর্ঘ এক মাস রোজাদার তার নিজের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার প্রতি এই সচেতনতা (God Consciousness) বাড়ানোর অনুশীলন করে। “রোজা আমারই জন্য এবং আমিই এ পুরস্কার দিব।” এই হাদীসে কুদসীতে উল্লিখিত আল্লাহর এ উক্তির শিক্ষা এটাই। রোজা শুধু তাঁর জন্য এজন্য রব্বুল আলামীন নিজ হাতে এর পুরস্কার বান্দাকে দিবেন। কিন্তু আজকে আমরা কি এই চেতনায় রোজা রাখছি? আল্লাহ্ আমায় দেখছেন প্রতিটি মুহূর্তে এই চিন্তা কি লালন করছি নিজের মধ্যে, নাকি শুধুই না খেয়ে থাকছি? রাত জেগে রেলি হাফেজদের অস্বাভাবিক ও অনৈসলমিক পন্থায় নামায ও কুরআন খতম করছি? শুধুই কি অনুষ্ঠান পালন করছি? যেমন ছিলাম তেমনি থাকছি। হাদীস অনুযায়ী কিছু লোক রোজায় না খেয়ে থাকার ও রাত্রি জাগরণের কষ্ট ছাড়া কিছুই পায় না। আমরা এদের মধ্যে সামিল হয়ে যাচ্ছি না তো?

- রোজা মানুষের মাঝে নৈতিক শক্তির উন্মেষ ঘটায়, তাকে আরো মজবুত করে। হাদীস অনুযায়ী রোজার উদ্দেশ্যেই হল:

- মিথ্যা কথন
- মিথ্যার উপর আমল এবং
- জাহেলী তথা মুর্খতামূলক কাজ কর্ম বর্জন করা (বুখারী)

এখন রোজার মাসে যারা গোডাউন ভর্তি করে, স্টক করে অন্যায়ভাবে মালের দাম বাড়ায়, ভেজালের কারবার করে, মিথ্যা কথা বলে, মিথ্যা ওয়াদা করে বেড়ায়, কাজে ও দায়িত্বে ফাঁকি দেয় তাদের রোজার কি হালত হল?

রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, কর্মজীবী, আমরা যারা দ্বীনের কথা বলি-লেখি আমাদের সামনে একথাগুলি বারবার আনা দরকার। নিজেদের কুরআন-সুন্নাহর আয়নায় মিলিয়ে দেখা প্রয়োজন।

বিশ্বময় মুসলমান রোজা রাখছে। গুটি কয়েক ব্যতিক্রম বাদে সর্বত্র তারা আজ নির্যাতিত। চিন্তার বিষয় না? সাহাবীরা রোজা রেখে শক্তি অর্জন করলেন, তিন সাড়ে তিনগুণ শত্রুকে হারিয়ে দিলেন। আল্লাহর শত্রু, নবীর শত্রু, দ্বীনের শত্রু, ইসলাম ও মুসলমানের শত্রুদের হারিয়ে দিলেন আর আমরা বিশ্বময় পালিয়ে বেড়াচ্ছি, সমুদ্রের ফেনার মতো ভাসছি কেবল এদিক থেকে ওদিক।

বদর দিবসের আজকের দিনে সবাই বিষয়টি ভেবে দেখি। ঈদ কেনা কাটা, বাড়ি যাওয়ার টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়ানোর চেয়ে অনেক জরুরি কাজ আছে মুসলমানের। ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া, চারিত্রিক গুণাবলীগুলি অর্জন ও জোরদার করা রোজার মূল উদ্দেশ্য। অর্ধেকের বেশি রোজা চলে গেল। সে পথে কতদূর আগালাম সবাই ভেবে দেখি।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর