আপনি পড়ছেন

মহান আল্লাহ্ তা’লা বলেন- “অতঃপর যখন মহাসংকট উপস্থিত হবে, মানুষ যা করেছে তা সে-সেইদিন স্মরণ করবে, এবং জাহান্নামকে প্রকাশ করা হবে দর্শকদের জন্য। অতএব যে ব্যক্তি সীমালংঘন করে এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়, জাহান্নামই হবে তার আবাস। পক্ষান্তরে যে নিজ প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং প্রবৃত্তি হতে নিজেকে বিরত রাখে জান্নাতই হবে তার আবাস।” (সূরা নাযি’আত ৭৯: ৩৬ - ৪১)

ramadan abstain from liesফাইল ছবি

আমরা সবাই জান্নাত চাই। চাই জাহান্নাম থেকে বাঁচতে। তা পেতে হলে নিজের ইচ্ছা মতো বিশ্বাস বা কাজ করলে চলবে না। মনগড়া ধ্যান-ধারণা ও আমল করে যদি আমরা আশা করি আল্লাহ্ পাক তাতে রাজী-খুশী হয়ে যাবেন তাহলে তা হবে নিতান্তই শিশুসুলভ কাজ। আল্লাহ্ বলেন-

“তোমাদের নিকট কী কোন কিতাব আছে যাতে তোমরা অধ্যয়ন কর যে, তোমাদের জন্য তাতে রয়েছে যা তোমরা পছন্দ কর? তোমাদের কি আমার সাথে কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ এমন কোন অঙ্গীকার রয়েছে যে, তোমরা নিজেদের জন্য যা স্থির করবে তা-ই পাবে? তুমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর তাদের মধ্যে এ দাবির যিম্মাদার কে?” (সূরা কালাম ৬৮: ৩৭ - ৪০)

বস্তুত: আল্লাহর কোন কিতাবে তিনি এমন কোন কথা বলেননি। এরকম মনগড়া কোন পরিণামের কথার যিম্মাদারী আল্লাহর পক্ষ থেকে কেউই হবে না।

প্রিয় দ্বীনি ভাই ও বোনেরা, এই জীবন আমরা একবারই পাব। অতএব, বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। জান্নাতে ফিরে যাওয়া এবং জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য আমাদের করণীয় জানিয়ে দেয়ার লক্ষ্যেই আল্লাহ্ পাক কুরআন নাযিল করেছেন, নবী (স.)-কে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহর কিতাব ও নবীর সুন্নাহর বাইরে হেদায়াত ও নাজাতের পথ খোঁজা চরম নির্বুদ্ধিতা। অথচ বহু মানুষ আজ তা-ই করে যাচ্ছে। আমাদের এ ক্ষুদ্র পরিসরে আমরা আল-কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে জান্নাত লাভের উপায় ও জাহান্নাম থেকে বাঁচার পথগুলি সংক্ষেপে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি।

জান্নাত লাভের জন্য করণীয়: (গতকালের পর)

ফরয ইবাদাতগুলি যথাযথভাবে আদায় করা:

আল্লাহ্ তা’লা তাঁর বান্দাদের ঈমানী জিন্দেগী যাপনের অনুশীলন এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ও আনুগত্যের মাধ্যম হিসেবে কতগুলি কাজ ফরয করে দিয়েছেন। যেমন- পাঁচ ওয়াক্ত নামায, রমজানের রোজা পালন ইত্যাদি।

জান্নাত লাভের জন্য ফরয ইবাদাতগুলি আদায়ে অবশ্যই যত্নবান হতে হবে। আমাদের অনেকেই দেখা যায় ফরয কাজগুলিতে খুবই গাফেল কিন্তু নফল বা দলিলবিহীন আমলে খুবই তৎপর। কেউ আছেন ৫ ওয়াক্ত ফরয নামায আদায় করেন না কিন্তু শবেবরাতের বা শবে মেরাজের মনগড়া নামাযে খুবই তাগিদ তাদের। কেউ তো এমনও আছেন ফরয রোজা করেন না শবেবরাতের দলিল বিহীন রোজায় খুবই আগ্রহী। কেউ সারা বছর ফরয নামায আদায় করেন না বা করলেও যেন-তেন শিথিলভাবে, কিন্তু তারাবীর ব্যাপারে খুব তৎপর। সবাই বুঝি নফল বা মনগড়া আমল দিয়ে ফরযের স্থান পূরণ হবে না। ফরয আদায় করে অতঃপর সত্যিকার নফল কাজগুলি করলে ফায়দা পাওয়া যাবে। এক হাদীসে কুদসীতে এসেছে- ফরয কাজগুলির মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে। অতঃপর সে যখন নফল কাজগুলি করতে থাকে তখন আল্লাহপাক তাকে ভালবাসতে থাকেন। (বুখারী)

নিয়তের বিশুদ্ধতা:

সব কাজের ফলাফল নিয়তের বা উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে (বুখারী)। শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য ছাড়া যে কাজই করা হোক তা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। লোক দেখানো নামায আল্লাহ্ কবুল করেন না (সূরা মাউন)। লোক দেখানো কাজকে রিয়া বলা হয়। রিয়া এক ধরনের শিরক। রসূল (স.) বলেন-

“যে লোক দেখানোর জন্য নামায পড়লো সে শিরক করলো, যে লোক দেখানোর জন্য রোজা রাখলো সে শিরক করলো, যে লোক দেখানোর জন্য দান করলো সে শিরক করলো।” (আহমদ)

অতএব, আল্লাহর ইবাদাত যেমন করতে হবে তেমনি তা করতে হবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। কিয়ামতের দিন সবার আগে বিকৃত উদ্দেশ্যে আমলের বিচার করা হবে। ৩ ধরনের মানুষ যারা খ্যাতি ও সুনামের আশায় দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করেছে, আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে এবং দান-সাদাকা করেছে। আল্লাহ্ তাদের বলবেন, “তোমরা যা চেয়েছে পৃথিবীতে তা পেয়েছ। সুতরাং আজ আমার কাছে তোমাদের কোন প্রাপ্য নেই।” (মুসলিম)

মানুষের অধিকারসমূহ আদায়ে যত্নবান হওয়া:

বান্দার হক নষ্ট হলে আল্লাহ্তা’লা তা মাফ করবেন না। এরকম ব্যক্তি কিয়ামতের দিন সবচেয়ে দুর্ভাগা হবে। কারণ তার নেক আমলগুলি থেকে অধিকার বঞ্চিতদের নেকী দিয়ে দেয়া হবে। তার নেকী ফুরিয়ে গেলে হকদারদের গুনাহগুলি তার আমলনামায় যোগ করা হবে। এভাবে নেকি বঞ্চিত এবং নিজের ও অপরের গুনাহ মাথায় নিয়ে এ ব্যক্তি জাহান্নামী হবে। নবী (সা.) এমন ব্যক্তিকে সবচাইতে দুর্ভাগা আখ্যায়িত করেছেন। অতএব, অপরের অধিকার আদায়ে সচেতন হতে হবে। অধিকার নষ্ট হলে দুনিয়াতেই তার নিকট ক্ষমা চেয়ে নিতে ও অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে, এবং এর জন্য মহান আল্লাহ্ তা’লার নিকট তাওবা ও ইসেতগফার করতে হবে।

প্রসঙ্গত, একটি বিষয়ে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমাদের সমাজে ওয়ারিশদের সম্পত্তি নিয়ে ব্যাপক নয়-ছয় করা হয়। নারীদের তাদের হক দেয়া হয় না। ভাই, ভাইয়ের হক মেরে দেয়। অথচ আল্লাহ্ সম্পত্তি বণ্টনের নীতিমালা বর্ণনা করে বলেন-

“এইগুলি আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করলে আল্লাহ্ তাকে দাখিল করবেন জান্নাতে যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং ইহা মহাসাফল্য। আর কেউ আল্লাহ্ ও রসূলের অবাধ্য হলে এবং তাঁর নির্ধারিত সীমা লংঘন করলে তিনি তাকে আগুনে নিক্ষেপ করবেন, সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি রয়েছে।” (সূরা নিসা: ১৩-১৪)

বহু নামাযী মানুষ, হাজী মানুষ সম্পত্তি বণ্টনে নানা খেয়ানত করেন। মেয়েদের তাদের হক না দেয়া, ভাই-বোনকে সম্পত্তি বণ্টনে সমান দেয়া ইত্যাদি বিভিন্নভাবে আল্লাহর সীমা লংঘন করা হয়। জান্নাতের প্রত্যাশীকে বান্দাদের যাবতীয় হক-অধিকার আদায়ে সচেতন ও তৎপর হতে হবে।

দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করা:

রসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন,

“জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নারী-পুরুষের জন্য ফরয।” (ইবনে মাযা)

বস্তুত: জ্ঞান ছাড়া ইসলামের উপর চলা সম্ভব নয়। কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান ছাড়া আল্লাহর হুকুমসমূহ জানা এবং যথাযথভাবে তা পালন করা সম্ভব নয়। এ জন্য আল-কুরআনের প্রথম নির্দেশ হল-

“পড়, তোমার প্রভুর নামে।” (সূরা আলাক: ১)

ইসলামে জ্ঞান অর্জন করার গুরুত্ব দুদিক থেকে:

প্রথমত: দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করা নিজেই একটা ফরয ইবাদাত।

দ্বিতীয়ত: কুরআন-হাদীসের যথাযথ জ্ঞান ছাড়া ইসলামে ঈমান আনা থেকে শুরু করে ইবাদাত বন্দেগীসহ দ্বীনের কোনো কাজই সঠিকভাবে করা সম্ভব নয়।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশ তো বটেই, গোটা বিশ্বের মুসলমানরা এ ব্যাপারে আজ অত্যন্ত গাফিল। যারই পরিপ্রেক্ষিতে আজ তাদের এই অধঃপতন। নবী (সা.) বলেন “যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে কোন পথে চলবে আল্লাহ্ তা’লা তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দিবেন।” (তিরমিযী)

দ্বীনি জ্ঞান অর্জনের কথা বললেই, কেউ কেউ নামায-রোজার মাসলা-মাসায়েলের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ করে ফেলেন। বরঞ্চ মুসলিম হিসেবে জীবন-যাপনের জন্য যে জ্ঞান প্রয়োজন তা অর্জন করাই ফরয। তাই ইবাদত বন্দেগীর সাথে সাথে পরিবার গঠন, রিজিক অন্বেষণ, নেতৃত্ব ও আনুগত্য, সমাজে দায়িত্ব পালন, হালাল-হারাম, মাহরাম-অমাহরাম প্রভৃতি বিষয়ে একজন মুমিন মুমিনাকে অবশ্যই কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে।

দ্বীন ইসলামের বাস্তবায়নে সাধ্যমতো সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা:

একজন মুসলমানের জীবন ব্যবস্থার ভিত্তি শরীয়ত। শরীয়তের বিধিনিষেধ না মেনে মুসলিম থাকা সম্ভব নয়। তাই একজন মুমিনের জন্য শরীয়তের বিধি ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত।

আল্লাহ বলেন-

“হে মুমিনগণ! আমি কি তোমাদের এমন এক ব্যবসার কথা বলবো যা তোমাদের কঠিন শাস্তি হতে নাজাত দিবে? (তা এই যে) তোমরা আল্লাহ্ ও রসূলের উপর ঈমান আনবে এবং তোমাদের জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম। যদি তোমরা উপলব্ধি করতে পর।” (সূরা সফ: ১০-১১)

তাই একজন মুমিনকে সার্বিক জীবনে দ্বীনের অনুসরণ ও দ্বীনকে সামগ্রিকভাবে বাস্তবায়নে অবিরাম সংগ্রাম করতে হবে। কারণ যে কাজ জাহান্নাম থেকে বাঁচার শর্ত সে কাজ অবশ্য ফরয। তবে এ বিষয়ে নবী (সা.) এর সুন্নাহর অনুসরণ করা অতীব জরুরি। জীবনের সব কাজের মতো এক্ষেত্রেও সুন্নাহর অনুসরণ করতে হবে। অন্যথায় বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বর্তমান মুসলমানদের মধ্যে এ ব্যাপারে নানা বিভ্রান্তি রয়েছে। কেউ দ্বীন বাস্তবায়নের নামে উগ্র-সন্ত্রাসের আশ্রয় নিচ্ছেন। অথচ সেটা নবীর সুন্নাত নয়। আর নবী (সা.)-এর সুন্নাত বর্জন করলে কার্যত ঈমানই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায় (সূরা নিসা: ৬৫)।

আবার অনেকেই দ্বীনের দাওয়াত প্রচার ও প্রসারে কাজ করতে অনাগ্রহী। সামষ্টিক নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে সবরের সাথে ধারাবাহিকভাবে দ্বীনের কাজ করাকে তারা বোঝা মনে করেন। কিন্তু সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে আস্তিক-নাস্তিক, মুসলিম-অমুসলিম সবার সাথে মিলে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কাজ করতে তাদের তৎপরতায় ঘাটতি নেই। এরা নামায-রোজা করেন। কিন্তু ভুলে যান হারাম উপার্জনের ইবাদাত আল্লাহ্পাক কবুল করেন না। আর সমাজে বিদ্যমান হারামের সয়লাবে হালাল উপার্জন যে সম্ভব নয় তা বুঝার জন্য মহাজ্ঞানী হওয়ার তো প্রয়োজন নেই। হারাম আয় দিয়ে নামায-রোজা, হজ্জ-যাকাত, মসজিদ-মাদ্রাসা কি আল্লাহ্ কবুল করবেন? আপামর মুসলিম জনগণকে এই অজ্ঞতা ও নির্লিপ্ততার মধ্যে রেখে দ্বীনের বিধানসমূহ বাস্তবায়নই কিভাবে সম্ভব বা দ্বীনি ব্যক্তিত্বগণ, ইসলামী চিন্তাবিদগণ, ইসলামী দল-সংগঠন নির্বিশেষে সবার গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর