দল পর্যালোচনা: চ্যাম্পিয়ন জার্মানির শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ন রাখার মিশন

বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দল ব্রাজিল। সর্বোচ্চ পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সেলেকাওরা। সাফল্যের বিচারে এরপরই অবস্থান জার্মানি ও ইতালির। দুটো দলই ঘরে তুলেছে চার চারটি ট্রফি। তবে জার্মানদের শেষ ট্রফিটা এসেছে চার বছর আগে, ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে। রাশিয়াতে স্বপ্নের সেই শিরোপা অভিযান শুরু হচ্ছে মুলার-ওজিলদের।

বিশ্বজয়ী সেই দলের অনেকেই এখন নেই জার্মানি দলে। ফিলিপ লাম, বাস্তিয়েন শোয়েনস্টাইগার, মিরোস্লাভ ক্লোসার মতো বিশ্ব মাতানো তারকারা বিদায় জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক ফুটবলকে। সোনালি প্রজন্মের বড় একটা অংশ বিদায় নিলেও ধীরে ধীরে দলটাকে আবারো গুছিয়ে নিয়েছেন জার্মান কোচ জোয়াকিম লো।

তবে ব্রাজিল সবচেয়ে বেশিবার ট্রফি জিতলেও সবচেয়ে বেশিবার ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা জার্মানদেরই। আটবার ফাইনাল খেলেছে তারা। কাকতালীয় বিষয় হচ্ছে জার্মানি শেষ যে তিনটি ফাইনাল খেলেছে সবকটিতেই তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েছে আর্জেন্টিনাকে। চার বছর আগের মারাকানা ফাইনালে লিওনেল মেসিদের ১-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় লো’র দল।

স্বপ্নের সেই যাত্রাতেই স্বাগতিক ব্রাজিলকে ৭-১ গোলে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল জার্মানরা। এরপর তো আরেক ইতিহাস সৃষ্টি করেন লোর দুর্বার শিষ্যরা। প্রথম ইউরোপিয়ান দল হিসেবে ল্যাটিন আমেরিকা মহাদেশ থেকে শিরোপা নিয়ে দেশে ফেরে জার্মানি। এবার রাশিয়া থেকে দেশে ফেরার পরও ট্রফিটা সঙ্গে নিয়ে যেতে মরিয়া লোর দল।

আজ থেকে শুরু হওয়া বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে দুর্দান্ত পারফর্ম করে জার্মানি। ইউরোপিয়ান অঞ্চলে ‘সি’ গ্রুপের বাছাইয়ের লড়াইয়ে জার্মানদের সামনে কেউ দাঁড়াতেই পারেনি। আর তাতেই ১৮ বারের মতো চ্যাম্পিয়নশিপ নিশ্চিত হয়ে যায় তাদের। যা বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর মতো দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এখানেও তাদের চেয়ে এগিয়ে ব্রাজিল, সেলেকাওরা খেলেছে আগের ২০টি আসরেই।

জার্মানির সাফল্যের ইতিহাস অবশ্য পশ্চিম জার্মানি নামে। কারণ দেশটি আগে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। পূর্ব জার্মানি মাত্র একবারই বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল। তাই পশ্চিম জার্মানিকেই মূল দল হিসেবে ভাবা হতো। এই দলটা ১৯৩০ বিশ্বকাপের প্রথম আসরে সুযোগ পেয়েও তা বর্জন করেছিল।

পরেরবার আসরেই তৃতীয় সেরা দল হিসেবে বিশ্বকাপ শেষ করে পশ্চিম জার্মানি। অভিষেক আসরে তারা হারায় বেলজিয়াম ও সুইডেনকে। কিন্তু চেকোস্লোভাকিয়ার কাছে ২-১ গোলে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়ে জার্মানরা। কিন্তু শুরুর এই বর্ণিল পথচলাটা ধারাবাহিক করতে পারেনি হিটলারের দেশ।

১৯৩৮ বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়ে জার্মানি। চতুর্থ অর্থাৎ ১৯৫০ বিশ্বমঞ্চের আসরে দর্শক সারিতে থাকতে হয় তাদের। যুদ্ধবাজ দেশ বলে ফুটবল মহাযজ্ঞ থেকে জার্মানদের নিষিদ্ধ করে ফিফা। ১৯৫৪ সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপে ফিরেই দাঁতভাঙা জবাবটা দেয় জার্মানি। হাঙ্গেরিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে স্বপ্নের প্রথম শিরোপা জিতে নেয় তারা।

জার্মানির সোনালি দিনের ইতিহাসের শুরু সেখান থেকেই। এরপর আরো সাতবার ফাইনালে উঠেছে জার্মানি। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টানা তিনবার ফাইনালে খেলেছিল তারা। মাঝের ১৯৮৬ বিশ্বকাপের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচেই হেরেছে জার্মানি। সাম্প্রতিক কয়েকটি বিশ্বকাপে তো সেমিফাইনাল খেলাটাকে এক প্রকার নিয়মে পরিণত করে ফেলেছে তারা।

২০০২ থেকে ২০১৪ বিশ্বকাপের সবকটি আসরেই অন্তত সেমিফাইনাল খেলেছে জার্মানি। গতবার সেমিফাইনালে তো অবিশ্বাস্য একটা ম্যাচই খেলেছিল হিটলারের দেশ। স্বাগতিক ব্রাজিলকে ৭-১ গোলে চূর্ণ করে জোয়াকিম লোর দল জায়গা করে নেয় স্বপ্নের মঞ্চে।

ওই ম্যাচে সাত গোলের উৎসবে স্কোরারশিটে নাম ছিল মিরোস্লাভ ক্লোসারও। চার বিশ্বকাপ খেলে সর্বোচ্চ ১৬টি গোল করেছেন তিনি। ক্লোসা ছাড়িয়ে গেছেন ‘দ্য ফেনোমেনম’ খ্যাত ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদোকে (১৫ গোল)। ওই বিশ্বকাপ দিয়েই পূর্বসুরি জার্ড মুলারকে (১৪ গোল) পেছনে ফেলেন ক্লোসা।

ক্লোসা এখন জার্মানি দলে নেই। তার শূন্যতাটা পুষিয়ে দিচ্ছেন মার্কো রিউস, জুলিয়ান ড্র্যাক্সলারের মতো তারকা ফুটবলাররা। তাদের দাপুটে পারফরম্যান্সে জার্মানি উঠেছে র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে। এখনো সিংহাসনেই আছে তারা। তিনবারের ইউরো চ্যাম্পিয়ন এবং কনফেডারেশনস কাপ জয়ী দলটি শুধু র‌্যাঙ্কিং নয়, রাশিয়া বিশ্বকাপের সিংহাসনেও বসতে চায়।

কিন্তু এমন একটা আসর সামনে রেখে প্রস্তুতিটা মোটেও প্রত্যাশিত হয়নি জার্মানির। সবশেষ ছয় ম্যাচের মাত্র একটিতে জয় পেয়েছে জার্মানরা। সেটাও আবার সর্বশেষ ম্যাচে। তাও আবার সৌদি আরবের মতো খর্বশক্তির দলের কাছে জয়ের জন্য কী কাঠখড়ই না পোড়াতে হয়েছে।

কিন্তু এনিয়ে উদ্বিগ্ন নয় জার্মানি। কারণ তাদের দলে আছে একঝাঁক তারকা ও অভিজ্ঞ ফুটবলার। রাশিয়া যাত্রায় জার্মানির সঙ্গে আছেন আগের বিশ্বকাপ খেলা ক্রুস, ওজিল, মুলার, নুয়্যার, বোয়াটেং, এবং সামি খেদিরার মতো অভিজ্ঞরা। সঙ্গে তরুণরা তো আছেই। ভারসম্যপূর্ণ এই দলটিকে অবশ্য বড় পরীক্ষা দিতে হবে গ্রুপপর্বেই।

কারণ বিশ্বকাপের ড্র যে মৃত্যুকূপে ফেলে দিয়েছে তাদের। ‘এফ’ গ্রুপে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ইউরোপিয়ান পরাশক্তি সুইডেন, এশিয়ান জায়ান্ট দক্ষিণ কোরিয়া ও উত্তর আমেরিকার ফুটবলের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন মেক্সিকো। শেষ দলটির বিপক্ষে ১৭ জুন এবারের আসরে নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলবে জার্মানি। তাদের মিশন ব্রাজিলকে ছোঁয়া, ইতালিকে ছাড়িয়ে রেকর্ড সর্বোচ্চ ৫ বার শিরোপা জেতা।