দল পর্যালোচনা: সোনালি অতীত ফেরানোর স্বপ্ন উরুগুয়ের

বিশ্বকাপ ফুটবলের সূচনালগ্ন থেকেই জড়িয়ে আছে উরুগুয়ের নাম। প্রথম বিশ্বকাপের মঞ্চ বসেছিল ল্যাটিন এই দেশটিতেই। নিজেদের উঠোনে স্বপ্নের আসরটা উরুগুয়ানরা অবিস্মরণীয় করে রেখেছিল চ্যাম্পিয়ন হয়ে। আর্জেন্টিনাকে কাঁদিয়ে ৪-২ গোলে প্রথম বিশ্বজয়ী দল হিসেবে নাম লেখায় উরুগুয়ে।

কিন্তু চ্যাম্পিয়ন দলটিই বিশ্বকাপ থেকে হারিয়ে গেল হঠাৎ করে। তাদের মাটিতে অনুষ্ঠিত আসর থেকে ইউরোপিয়ান প্রায়সব দল মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় কঠিন প্রতিবাদ জানায় উরুগুয়ে। ইউরোপে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্বকাপের মঞ্চ বসায় দুটো আসরই বয়কট করে ব্লু-স্কাইরা। কুড়ি বছর পর ফুটবল মহাযজ্ঞে ফেরে উরুগুয়ানরা ১৯৫০ ব্রাজিল বিশ্বকাপ দিয়ে।

ফেরার আসরটা স্বপ্নের মতোই শেষ করে ল্যাটিন জায়ান্ট দলটি। প্রতিবেশী ব্রাজিলের আসরে ফিরেই বাজিমাত করে তারা। স্বাগতিক দেশটিকে স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ ‘মারাকানা ট্রাজেডি’ উপহার দিয়ে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় শিরোপা জিতে নেয় উরুগুয়ে।

শুরুতে পিছিয়ে পড়েও অলিখিত ফাইনালকে সেলেকাওদের ২-১ গোলে কাঁদিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় আকাশী-নীলরা। আর তাতেই লাখেরও বেশি উপস্থিত দর্শকের সামনে রচিত হয় ‘মারাকানা ট্রাজেডি।’ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও সেই দুঃস্মৃতির ভূতটা এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ব্রাজিলিয়ানদের।

উরুগুয়ের সোনালি ফুটবলের সমাপ্তি হয়েছে সেখানেই। এরপর শিরোপা জেতা দূরে থাক, আর কখনোই ফাইনালে উঠতে পারেনি ফোরলান-সুয়ারেজদের দেশ। নিজেদের তৃতীয় বিশ্বকাপে অবশ্য শেষ চার পর্যন্ত টিকে ছিল উরুগুয়ে। দেশটির ফুটবলে চূড়ান্ত রাহুর দশাটা লাগল সেখান থেকেই।

দুইবারের চ্যাম্পিয়নরা টিকিট পায়নি ১৯৫৮ বিশ্বকাপে। বাছাইপর্বেই থমকে যায় তাদের স্বপ্নটা। পরেরবার ফিরলেও নিয়তি তাদের থামিয়ে দেয় গ্রুপপর্বেই। বিশ্বকাপে উরুগুয়েনদের আসা-যাওয়ার সেই শুরু। এর মাঝে ১৯৭০ সালে সেমিফাইনালে নাম লিখিয়েছিল তারা। এরপর আবার সীমিত হয়ে আসে উরুগুয়ের ফুটবল সক্ষমতা।

কয়েক দশক পর ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছিল উরুগুয়ে। হারানো শ্রেষ্ঠত্ব উদ্ধারের পথে অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার পরও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে ফিরতে হয়েছিল তাদের। আট বছর আগের বিশ্বকাপে প্রায় এককভাবে দেশকে সেমিফাইনালে পৌঁছে দেন ডিয়েগো ফোরলান। লুইস সুয়ারেজের তারকা হয়ে ওঠা এই টুর্নামেন্ট দিয়েই।

সেই সুয়ারেজই এবারের উরুগুয়ে দলের স্বপ্ন সারথি। গত আসরে ফোরলান-সুয়ারেজ-কাভানি ত্রিমুখি জুটি আপ্রাণ চেষ্টা করেও দলকে দ্বিতীয় রাউন্ডের বেশি টানতে পারেনি। নতুন স্বপ্নে বিভোর উগুরুয়ে আবারো শিরোপা জয়ের নেশায় ডুবে আছে। এ যাত্রায় ফোরলান নেই, আছেন শুধু সুয়ারেজ ও এডিনসন কাভানি।

ক্লাব মৌসুমে ফ্রেঞ্চ ফুটবলের ট্রেবল উপহার দিয়ে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি সেরেছেন কাভানি। মৌসুমজুড়ে স্প্যানিশ ফুটবল মাতিয়ে বার্সেলোনাকে লা লিগা শিরোপা উপহার দিয়ে জাতীয় দলে ফিরে এসেছেন সুয়ারেজ। ক্লাব ক্যারিয়ারে অনেককিছু জেতা এ মানিকজোড় উরুগুয়ের আশার পালে দিচ্ছেন ঝড়ো হাওয়া। হাওয়াটা দমকা হাওয়া কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়াটা এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা।

অবশ্য বিশ্বকাপের মঞ্চে নিজেদের হারিয়ে খুঁজলেও মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে সফল দল উরুগুয়ে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মতো পরাশক্তিদের ছাপিয়ে সর্বোচ্চ ১৫বার কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতেছে উরুগুয়ানরা। অথচ সেই দলটাই ফিফার টুর্নামেন্টে ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে কয়েক দশক ধরে। ফিফার আরেক টুর্নামেন্ট ১৯৯৭ ও ২০১৩ কনফেডারেশনস কাপে অংশ নিলেও ফাইনালে ওঠার স্বাদটা আর পায়নি উরুগুয়ে।

এনিয়ে ১৩বারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে ল্যাটিন আমেরিকার দলটি। এ যাত্রায় প্রস্তুতিপর্বটাও দারুণভাবে সেরে নিয়েছে তারা। বিশ্বকাপের তিনটি প্রস্তুতি ম্যাচেই জয়ের নিশ্ছিদ্র পথে হেঁটেছে র‌্যাঙ্কিংয়ে ১৪ নাম্বারে থাকা দলটি। রাশিয়ার মঞ্চে অভিযান শুরুর আগে এর চেয়ে দারুণভাবে প্রস্তুতিটা সারতে পারতেন না সুয়ারেজ-কাভানিরা।

দারুণ ফর্মে থাকা উরুগুয়ে এবারও খেলবে পুরনো ও স্বদেশি কোচ কোচ অস্কার তাবারেজের অধীনে। এক যুগ ধরে এই কোচই দায়িত্ব পালন করে আসছেন উরুগুয়ের। তার অধীনেই দ্বিতীয়বারের মতো টানা তিনটি বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে ল্যাটিন দলটি। তারুণ্য এবং অভিজ্ঞতার মিশেলে ভারসাম্যপূর্ণ দল গঠন করেছেন তাবারেজ। এই দল নিয়েই উরুগুয়ানদের তিনি স্বপ্ন দেখাচ্ছেন দারুণ একটা বিশ্বকাপের।

মিশন রাশিয়ায় উরুগুয়ে কোচের দুই অস্ত্র সুয়ারেজ এবং কাভানি। এর সঙ্গে ছোট ছোট কয়েকটা ট্রাম্প কার্ডও আছে তাবারেজের হাতে। যারা কিনা সদ্য বিদায়ী ইউরোপিয়ান ক্লাব মৌসুম মাতিয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন জাতীয় দলের তাঁবুর নিচে। মাঠে এসব ফুটবলারকে নেতৃত্ব দেবেন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ অধিনায়ক ডিয়েগো গোডিন।

সোনালি অতীত ফেরানোর মিশনে গ্রুপপর্বে অবশ্য বড় কোনো পরীক্ষায় পড়ার কথা নয় উরুগুয়ের। তবে ‘এ’ গ্রুপের ম্যাচে তাদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে মোহাম্মদ সালাহর মিশর। ১৫ জুন এই দলটার বিপক্ষেই নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলবে তাবারেজের দল। গ্রুপপর্বে উরুগুয়ের অন্য দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আসরের স্বাগতিক রাশিয়া এবং সৌদি আরব।