ঢাবির হলগুলোতে লাগাম ছাড়া চুরি-ছিনতাই

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে অব্যাহতভাবে বেড়েছে চুরি-ছিনতাইয়ে ঘটনা। এক শ্রেনির সংঘবদ্ধ চক্রের খপ্পরে পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা হারাচ্ছেন ল্যাপটপ, মোবাইল, টাকাসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছু। বিশেষ করে গণরুমগুলোতে এই ধরণের অপতৎপড়তা বেশি দেখা যাচ্ছে।

সম্প্রতি এক গণমাধ্যম কর্মীর ফোন চুরি হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গতকাল ৪ এপ্রিল মঙ্গলবার দৈনিক যুগান্তরের নিয়মিত ফিচার লেখক ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল পূর্বপশ্চিম বিডির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম খানের মোবাইল ফোনটি হারিয়ে যায়। তিনি বলেন, 'ভোর রাত ৪টার দিকেও আমার মোবাইল দেখেছি। এরপর ঘুমিয়ে পড়লে, ঘুম থেকে উঠে অনেক খোঁজা-খুঁজির পরও মোবাইলটি পাইনি। মোবাইলে অপ্রকাশিত প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন তথ্য ছিল। এই ধরণের মোবাইল-ল্যাপটপ চুরির ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে।' এই ঘটনায় সাইফুল ইসলাম রাজধানীর শাহবাগ থানায় বুধবার সন্ধ্যায় একটি সাধারণ ডায়েরি (২৯৮ নং) করেছেন।

একই হলের ৪০৬ নং রুম থেকে আরেকটি চুরির ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘটনার ভুক্তভোগী ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মাদ আব্দুল খালেক। তিনি বলেন, 'সকাল ৬টার কিছু পরেও আমি আমার মোবাইলে টাইম দেখে আমার বেডে বালিশের নিচে রাখছি। সকাল আটটার দিকে ক্লাশে যাওয়ার সময় বালিশের নিচে হাত দিয়ে দেখি ফোন নেই। ড্রয়ার খুলে দেখি মানিব্যাগও নেই। আমার মানি ব্যাগে বিশ্ববিদ্যালয় ও লাইব্রেরির আইডি কার্ড ছিল, নগদ টাকা ছিল সাড়ে চার হাজার আর ডাচ বাংলা ও প্রাইম ব্যাংকের দুটি এটিএম কার্ড ছিল, ছিল কয়েকটি বন্ধ সিমও।'

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চুরি বা ছিনতায়ের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে গত বছর একই হল থেকে ১ মে সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী আফসার হাসান রানার, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ফরিদ হাসানের ফোন চুরি গেছে। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী তানজিন আল আলামিনের ফোন চুরি গেছে তার নিজ বিভাগে অবস্থান করার সময়।

গত বছরের ২০ এপ্রিল হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হল থেকে লাভলু মিয়া নামের এক শিক্ষার্থীর ফোন চুরি হয়। একই হলের ৪৪০ নম্বর রুম থেকে ৪ টা ল্যাপটপ, আরো ৬ টা ফোন এবং ১ টা ডিএসএলআর চুরি হয়। মুহসীন হলের শুধু মাত্র ৪/ক গণরুম থেকে গত এক বছরে ৫-৬টি ফোন চুরি হয়েছে। একই হল থেকে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ঢাবি প্রতিনিধি কবির কাননের পরপর দুটি ফোন চুরি যায়। সার্জেন্ট জহুরুল হক হল থেকে চুরি গত বছর একই তারিখে চুরি হয় ইব্রাহীম জাকারিয়ার ফোন। ইব্রাহীম জাকারিয়ার বলেন, 'জিডি করলেও কোন কজ হয় না। ফোন উদ্ধার হয় না। তাই জিডি করিনি।'

জহুরুল হক হলের ২০০৮ নাম্বার রুম থেকে চুরি হয় নিজাম উদ্দিন শেখের মোবাইল। জগন্নাথ হলের অক্টোবর স্মৃতি ভবনের ৪৭৮ নং রুম থেকে সুবর্ণ শিকদার জানান, তাদের ‍রুম থেকে দুইটা স্মার্টফোন চুরি গেছে। এমন প্রায় সময়ই চুরি হয়। চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি বিজয় একাত্তর হলের যমুনা ব্লকের ৮০০৩ রুম থেকে আবু সালেহ মাসুম আহমেদের স্যামসাং গ্রান্ড নিও প্লাস ফোনটি চুরি যায়। আর সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বারান্দা থেকে প্রতিবছর ৮-১০টি ফোন চুরি হয়।

গত বছরের ২১ জানুয়ারি শামসুন্নাহার হলের ২১৭ নং রুম থেকে সুস্মমিতা নন্দির মোবাইল চুরি যায়। তিনি জানান, ভোর রাত ৫টার দিকে রুমে ঢুকে তার ফোন চুরি করে একটি মেয়ে। আমি জেগে গেছিলাম, তখন বারান্দা দিয়ে লাফ দিয়ে পালিয়ে যায়।

শুধু ক্যাম্পাস বা আবাসিক হলের রুম থেকেই না। চোর চক্রের দৌরাত্ম আছে মসজিদেও। গত বছেরের শেষ দিকে সূর্যসেন হলের শিক্ষার্থী তাহসান ইসলামের মোবাইল চুরি হয় এফ রহমান হলে মসজিদে থেকে। ওই ঘটনায় শাহবাগ থানায় জিডিও করা হয়েছিল। কিন্তু কোন ফল আসে নি। সূর্যসেন হলের অমিত ইমতিয়াজ জানান, হল থেকে এপর্যন্ত তার একারই তিনবার মোবাইল চুরি হয়েছে। ২০১২, ২০১৪ ও সর্বশেষ ২০১৭তে তার ফোন চুরি হয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, 'চুরির ঘটনাগুলো নিশ্চয়ই ভালো নয়। আমি শিক্ষার্থীদের বলবো, চুরির ঘটনা ঘটলে অবশ্যই যেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবহিত করে।' বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আমজাদ আলী বলেন, 'হলে এসব ঘটনা ঘটলে সেটা অবশ্যই দু:খজনক। আমাদের কাছে অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেই। প্রতিটি হলের রুমে রুমে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করাটাও কঠিন। চোরদের রুখে দিতে সচেতন হবে ছাত্রদেরও। '

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও হল থেকে মোবাইল চুরির ঘটনাকে ছোট-খাটো অপরাধ হিসেবে দেখে তার কোন তদন্ত করে না থানা পুলিশ। ফলে চোর এবং ছিনতাইয়ের সাথে জড়িতরা থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। শাহবাগ থানা সূত্রে জানা যায়, প্রতি মাসেই শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন চুরির ঘটনায় জিডি করতে আসেন। তবে আইডি কার্ড হারানো এবং ফোন চুরির ঘটনায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জিডি জমা পড়ে।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের সামনে প্রকাশ্যে ছিনতাইকারীরা একজনকে গুলি করে পালিয়ে যায়। ওই ঘটনায় মনিরুজ্জামান মাসুম নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের একজন সাবেক শিক্ষার্থী আহত হন। ঘটনার বর্ণনায় সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এম আমজাদ আলী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, দু’টি মোটরসাইকেলে চারজন আরোহী এসে মাসুমকে ঘিরে ধরেছিল এবং তার সাথে থাকা পাসপোর্টের ব্যাগ টানাটানি করে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। এ সময় চার দিকে লোকজন জড়ো হয়ে গেলে ব্যাগটি না নিয়ে ছিনতাইকারীরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায়।

গত ২৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার প্রকাশ্য দিবালোকে বেলা ১০টার সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের সামনে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইমারত হোসেন ইমু শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। তার ডায়েরি নং ১৯১১। তবে জড়িত কাউকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করেনি পুলিশ।

এ ব্যাপারে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হাসান বলেন, 'আবাসিক হলের ভেতরে এই ধরনের চুরির ঘটনাগুলো উদ্বেগজনক। আমাদের পক্ষে সার্বক্ষণিকভাবে হলগুলোতে পাহাড়া বা টিম পাঠানো সম্ভব নয়। হলগুলোর ভেতরে পর্যবেক্ষণ করাও কঠিন। কর্তৃপক্ষ চাইলে এ ব্যাপারেও পুলিশের পক্ষ থেকে কাজ করা হবে। এর বাইরে কেউ যদি মোবাইল-ল্যাপটপ চুরির ব্যাপারে অভিযোগ করেন তাহলে আমরা অবশ্যই রিকভার করার চেষ্টা করি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের টহল টিম সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।'