বিপিএল ঘিরে সারা দেশে চলছে ভয়ঙ্কর জুয়াবাজি

বাঙালি জাতির এক আবেগের নাম ক্রিকেট। তবে এক ধরনের অসাধু চক্র ক্রিকেটে প্রতিনিয়তই হাজার হাজার টাকার ফলাফল বাজি, ওভার বাজি, রান বাজিসহ বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলছে। জুয়াবাজির ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকেই। প্রকাশ্য দিবালোকেই জুয়াবাজি চলছে রাস্তার মোড়ের দোকানসহ সারাদেশে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে বা গোয়েন্দা নজরদারিতে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করলেও বন্ধ হচ্ছে না জুয়াবাজি। বিপিএলকে ঘিরে ব্যাপক সক্রিয় হয়ে উঠেছে জুয়াড়িরা। জুয়াবাজি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব লিখেছেন— যাকারিয়া ইবনে ইউসুফ।

শুরু হয়েছে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঘরোয়া টি-২০ আসর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল)। এবার বিপিএল অনুষ্ঠিত হচ্ছে সিলেট, ঢাকা এবং চট্টগ্রামে। এর মধ্যে সিলেট অংশের খেলা শেষ। ১১ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ঢাকা অংশের খেলা। এরপর চট্টগ্রাম হয়ে আবারো ঢাকায় ফিরবে দেশের জনপ্রিয় এই ক্রিকেট টুর্নামেনট। ১২ ডিসেম্বর মিরপুরে ফাইনালের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের বিপিএল। বিপিএলে এবারের আসরে অংশ নিচ্ছে মোট ৭টি দল। প্রতি ম্যাচে প্রতিটি দলে খেলতে পারবেন পাঁচজন বিদেশি খেলোয়াড়। ফলে বিপিএলে যোগ হয়েছে বাড়তি উন্মাদনা।

ইতোমধ্যে জমে গেছে বিপিএল। জমজমাট এই আসরকে ঘিরে রাজধানীসহ সারাদেশে সক্রিয় হয়ে উঠছেন বাজিকররা। হাজার হাজার টাকা খুয়ানোর পাশাপাশি জুয়াবাজিতে প্রাণহানি বা হতাহতের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীর মধ্য বাড্ডায় বিপিএল নিয়ে বসা জুয়ার আসরে বাধা দেয়ার জেরে সোমবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএ বিভাগের ছাত্র নাসিম আহমেদ ইমাদুদ্দিন (২৩) খুন হয়েছেন।

শুক্রবার বিপিএলের দুপুরের ম্যাচের পর এক সংবাদ সম্মেলনে বিপিএল পরিচালনা পরিষদের সদস্য সচিব ইসমাঈল হায়দার মল্লিক জানান, বিপিএলের পঞ্চম আসরে এখন পর্যন্ত মোট ৭৭ জনকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৫ জন বাংলাদেশি। বাকি ১২ জন বিদেশি নাগরিক। তাদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানি এবং ১০ জন ভারতীয় দুষ্কৃতিকারী।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, 'জুয়াড়িদের ধরতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পাড়া-মহল্লা এমন কি অলিগলিতে যেসব স্থানে টিভিতে খেলা দেখানো হয় সেসব স্থানেও সাদা-পোশাকে গোয়েন্দা মোতায়েন করা হয়েছে। বিপিএল নিয়ে কোনো বাজি বা জুয়ার সঙ্গে কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে অবশ্যই তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।'

কয়েকটি ম্যাচের বাজির দর: বিপিএল এবারের আসরে ঢাকা পর্বের প্রথম দিনের খেলায় শনিবার মুখোমুখি হয়েছিল রংপুর রাইডার্স ও রাজশাহী কিংস। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সেদিন রংপুর-রাজশাহীর বাজির দর ছিল ১৩/১৫। অর্থাৎ কেউ যদি রংপুর নিয়ে বাজি লাগাতে চান তাহলে তাকে প্রতি হাজারে ১৫০০ টাকা দিতে হবে। অন্যদিকে কেউ রাজশাহী নিলে প্রতি হাজারে পাবেন ১৩০০ টাকা। একইভাবে পরে ওই দিন ঢাকা ডায়নামাইটস ও সিলেট সিক্সার্সের ম্যাচে রেট ছিল ২০/২৫; যেখানে ঢাকার দর বেশি। পরের দিন রোববারের ম্যাচে চিটাগাং ভাইকিংস আর খুলনা টাইটানসের ম্যাচের রেট ছিল খুলনা বড় ১৪/১৬। এভাবে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস আর রাজশাহী কিংসের ম্যাচের রেট ছিল ১৬/১৯; যেখানে কুমিল্লা বড়। গতকাল শুক্রবারের প্রথম খেলায় সিলেট বনাম রাজশাহীর বাজির দর ছিল ১২/১৪, যেখানে রাজশাহী বড়। দিনের অন্য খেলা খুলনা বনাম চট্টগ্রামের বাজির দর ছিল ১৬/১৮, যেখানে খুলনা বড়।

সাম্প্রতিক সময়ে ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম কলুষিত বিষয় স্পট ফিক্সিং এবং জুয়াবাজি। আন্তর্জাতিক বা ঘরোয়া বিভিন্ন ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচকে ঘিরে বাজিকরদের চলে দর কষাকষি। দুর্বল টিমের সঙ্গে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের খেলা হলে দেয়া হয় লোভনীয় সব অফার। দেশের আনাচে-কানাচে বাজির ঘোড়া লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। সবখানেই চলে জুয়াবাজির রমরমা ব্যবসা। শুধু বিপিএল নয় আইপিএল, বিশ্বকাপ, বিগব্যাশ, আফ্রিকান লিগ, ক্যারিবিয়ান লিগ, পিএসএল এমনকি দেশ-বিদেশের ঘরোয়া লিগগুলোকে ঘিরেও চলে রমরমা বাজির ব্যবসা। পরিসংখ্যান বলে, প্রতিবেশি ভারত এবং পাকিস্তানে স্পট ফিক্সিংসহ বাজির প্রভাবটা অনেক বেশি। বিশ্বে পাঁচটি বাজিকর বা জুয়াড়ি অধ্যুষিত দেশের মধ্যে শীর্ষে আছে এ দুই দেশ।

আন্তর্জাতিক পরিসরের বাজিকরদের আনাগোনা আমাদের দেশে অনেক কম। তবে স্থানীয় বাজিকরদের বিচরণ সবচাইতে বেশি। ম্যাচে কিংবা টিভি মনিটর দেখে চলে বাজি। বিপিএলের মৌসুমে রাস্তার মোড়ের দোকানগুলোতে ভালোভাবে চোখ রাখলেই দেখা যায় সেখানে চলছে জুয়াবাজির দর কষাকষি। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তথ্য হলো বাজিকরদের অধিকাংশই তরুণ। বেশির ভাগেরই বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছর। আর যাদের বয়স বেশি কিন্তু বাজি ধরেন তারাই হলেন ঘরোয়া বাজির মাফিয়া ডন বা ডিলার।

রাজধানীর মধ্যে মিরপুর, পুরান ঢাকা, আজিমপুর, বাড্ডা, টঙ্গী এবং কামরাঙ্গীর চরে বাজিকরদের বিচরণটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। জুয়ার নতুন ধান্দায় পিছিয়ে নেই নগরীর অভিজাত এলাকাগুলো। ধনীর দুলালরা বাজি ধরেন বিভিন্ন বার এবং অভিজাত হোটেলে গিয়ে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাড়া বা মহল্লার বিভিন্ন মোড়ের দোকানগুলো এখন জুয়াবাজির আখড়া। জয়-পরাজয় নির্ধারণ বাজির পাশাপাশি এখন চলে ওভার বাই ওভার, বল বাই বল, রান বাজি।

[চলবে...]