১৯৭০ বিশ্বকাপ: পেলে ও ব্রাজিলের হ্যাটট্রিক

প্রথম আটটি বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকা মহাদেশের সঙ্গে ভালোই লড়াই হয়েছে। নবম আসরে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। প্রথমবারের মতো টুর্নামেন্ট বসে উত্তর আমেরিকায়। স্বাগতিক স্বত্ব পায় মেক্সিকো। প্রতিযোগাটি অনেক কারণেই স্মরণীয় হয়ে আছে। এই আসর নিয়েই টিভি সম্প্রচারের যুগের প্রবেশ করে বিশ্বকাপ। বিলুপ্ত হয় শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক ‘জুলে রিমে ট্রফি’। লাল কার্ড ও হলুদ কার্ডের প্রথা চালু হয়। সবশেষ মেক্সিকো বিশ্বকাপ দিয়ে বিদায় নেন মহাতারকা পেলে। তার বিদায়টাও হয়েছে রাজসিক। প্রথম ও একমাত্র ফুটবলার হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ বিরল রেকর্ড গড়েন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি।

১৯৭০ বিশ্বকাপ

১৯৭০ বিশ্বকাপটা ছিল একেবারে পরিপূর্ণ। প্রথমবারেরে মতো পাঁচ মহাদেশের প্রতিনিধি অংশ নেয় প্রতিযোগিতায়। কিন্তু সবচেয়ে বড় অঘটনের শিকার হলো ল্যাটিন পরাশক্তি আর্জেন্টিনা। বাছাইপর্বের গণ্ডি পাড়ি দিতে পারেনি ম্যারাডোনা-মেসির দেশ। মূলপর্বের টিকিট পায়নি হাঙ্গেরি, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগালের মতো ইউরোপিয়ান জায়ান্টরাও। চমক হয়ে এলো ইসরায়েল এবং এল সালভাদরের বিশ্বকাপের টিকিট পাওয়াটা।

কিন্তু দুই দলেরই মূলপর্বের জায়গা নিয়ে দুটো ঘটনা আছে। এল সালভাদর ও হন্ডুরাস প্লে-অফ ম্যাচ হয়েছিল চার দিনব্যাপী! কিন্তু প্লে-অফের অন্য ম্যাচটা মাঠেই গড়ায়নি। রাজনৈতিক শীতল সম্পর্কের জের ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে খেলতে অস্বীকৃতি জানায় দক্ষিণ কোরিয়া। তাতেই খুলে যায় ইসরায়েলের স্বপ্নের দুয়ার।

বিশ্বকাপ যতই সামনে এগিয়েছে ততই বেড়েছে এর জনপ্রিয়তা। বাছাইপর্বে অংশ নেওয়া দলগুলোর সংখ্যাও বেড়েছে ক্রমাগতভাবে। মেক্সিকো বিশ্বকাপ খেলার জন্য ৭৬টি দেশ আগ্রহ প্রকাশ করে। সেখান থেকে বাছাইয়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয় ১৪ দল। স্বাগতিক ও ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের জন্য আলাদা দুটো টিকিটের বরাদ্দ অবশ্য আগে থেকেই করা ছিল।

কিন্তু বিশ্বকাপটা হয়ে থাকল শুধুই ব্রাজিলময়। আগের আসরে গ্রুপ পর্বে বিদায় নেওয়া ব্রাজিল মেক্সিকো বিশ্বকাপে ফিরেছে বীরদর্পেই। পুরো আসরে সেলেকাওরা ছিল অপ্রতিরোধ্য। ‘কালো মানিক’ খ্যাত পেলে পুরো টুর্নামেন্টেই ছিলেন দুর্দান্ত। আগের আসরে নেতিবাচক ফুটবলের শিকার হওয়ায় এবং শেষ বিশ্বকাপ বলেই কিনা এবার শুরু থেকেই তেতে ছিলেন এই মহাতারকা।

গ্রুপপর্ব থেকে শুরু করে ফাইনাল পর্যন্ত- পেলের ব্রাজিলের সামনে দাঁড়াতেই পারল না কেউ। ফাইনালে ওঠার পথে পেরু এবং উরুগুয়েকে উড়িয়ে দিয়েছে সেলেকাওরা। শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা পায় ইতালিকে। ভালো ফর্মে ছিল আজ্জুরিরাও। দুইবারের দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের লড়াইটা উত্তেজনার রেণু ছড়াবে, এমনটাই আশা ছিল।

অথচ ফাইনালটাকে বড্ড একপেশে বানিয়ে স্বপ্নের তৃতীয় শিরোপা জিতে যায় ব্রাজিল। ইতালিকে তারা বিধ্বস্ত করে ৪-১ গোলে। কার্লোস আলবার্তো ও পেলের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে স্বপ্নভঙ্গ হয় ইতালির। তবে মেক্সিকো বিশ্বকাপের আলোচিত ম্যাচ হয়ে থাকল ইতালি-পশ্চিম জার্মানির সেমিফাইনাল যুদ্ধটা। সাত গোলের ‘থিলার’ ম্যাচটা জার্মানি হেরেছে ৪-৩ গোলে।

শুরুতে পিছিয়ে পড়েও দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ে সমতায় (১-১) ফেরে জার্মানরা। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত ত্রিশ মিনিটে। ওই ত্রিশ মিনিটেই পাঁচ গোলের স্নায়ুঠাসা একটা লড়াই উপহার দেয় ইতালি ও জার্মানি। ইতালির স্বপ্নযাত্রা থমকে যায় ব্রাজিলের কাছে। আজ্জুরিদের হারিয়ে জুলে রিমে ট্রফির আজীবনের মালিকানা পেয়ে যায় সেলেকাওরা।

কিন্তু ট্রফিটা অক্ষত রাখতে পারেনি সাম্বার দেশটি। রিও ডি জেনিইরো থেকে ঠিকই চুরি হয়ে যায় ট্রফিটা। যেটি আর উদ্ধার হয়নি। পরের বিশ্বকাপের জন্য বানানো হয় নতুন এক শিরোপা। সোনায় মোড়ানো ট্রফিটাও এখন আছে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের কাছে। ট্রফিটা এবার নিশ্চয়ই ছিনিয়ে আনতে চাইছেন পেলের উত্তরসূরিরা।

একনজরে ১৯৭০ বিশ্বকাপ

স্বাগতিক: মেক্সিকো
চ্যাম্পিয়ন: ব্রাজিল
রানার্সআপ: ইতালি
তৃতীয়স্থান: পশ্চিম জার্মানি
অংশগ্রহণ: ১৬টি

ভেন্যু: ৫টি (৫ শহর)
মোট ম্যাচ: ৩২টি
মোট গোল: ৯৫টি
ম্যাচ প্রতি গোল: ২.৯৭টি
গোল্ডেন বুট: জার্ড মুলার (১০ গোল; পশ্চিম জার্মানি)

উদীয়মান সেরা: টিফিলো কুবিলাস (পেরু)
ফেয়ার প্লে পুরস্কার: পেরু
মোট দর্শক: ১৬০৪০৬৫
ম্যাচ প্রতি দর্শক: ৫০১২৭