৭ ভুলে শেষ ব্রাজিলের 'হেক্সা' স্বপ্ন

প্রান্তসীমায় আসা কাতার বিশ্বকাপের হট ফেভারিট ছিল ব্রাজিল। কিন্তু ফেভারিটের তকমা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারল না সেলেকাওরা। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হলো তাদের। এ নিয়ে ৫ বিশ্বকাপের ৪টিতেই শেষ আট থেকে ছিটকে গেল ব্রাজিল।

টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হলুদ শিবিরের নাটকীয় হার

অতিরিক্ত সময়ে নেইমার জুনিয়রের গোলে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে লিড নিয়েও জয় পায়নি তিতের দল। ম্যাচ শেষে হারের হতাশায় ডুবতে হয়েছে তাদের। ম্যাচের অন্তিম প্রহরে অবিশ্বাস্য গোলে সমতায় ফেরা ক্রোয়াটরা টাইব্রেকারে বাজিমাত করে।

কোয়ার্টার ফাইনালের নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষ হয়েছে গোলশূন্য ড্র‍য়ে। অতিরিক্ত সময়ের দুই অর্ধে দুই গোল করে দুইদল। এরপর টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হলুদ শিবিরের নাটকীয় হার। কেন এভাবে এগিয়ে থেকেও হারল ব্রাজিল? কেন বিদায় নিতে হলো নেইমারদের? নেপথ্য সাতটি কারণ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য:

ডি-বক্সে ছোটছোট পাস: ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে পুরো ম্যাচে ২১টি শট নিয়েছে ব্রাজিল। যার ১১টি ছিলো গোলমুখে। কেবল নেইমারের শটেই এসেছে সাফল্য। বাকি ১০টি শট ক্রোয়াট গোলরক্ষক ডমিনিক লিভাকোভিচ ঠেকিয়ে দেন। এর কারণ বেশির ভাগ শট নেয়ার আগে ডি-বক্সে ছোট পাস খেলেছে ব্রাজিল এবং গোলকিপারের খুব কাছ থেকে শট নিয়েছেন খেলোয়াড়রা। যার খেসারত দিতে হয়েছে। ডি-বক্সে অমন ছোট ছোট পাস ধরে আক্রমণে না গিয়ে দূর থেকে কিংবা বক্সের বাইরে থেকে গোলে শট নিলে হয়তো একাধিক গোল পেতে পারতো ব্রাজিল। আগের ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে তিতের কৌশল কাজে লাগলেও এদিন তা বুমেরাং হয়ে গেছে।

একাধিক গোলের নেশা: দেড় ঘণ্টার লড়াই অমীমাংসিত থাকে গোলশূন্য ড্রয়ে। পরে অতিরিক্ত সময়ের ১৫ মিনিটে নেইমারের গোলে লিড নেয় ব্রাজিল। জয়ের জন্য যা যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু ব্রাজিলকে পেয়ে বসে বাড়তি গোলের নেশা। আক্রমণ শানিয়েই যায় সেলেকাওরা। যার মূল্য চুকাতে হয়েছে প্রতি আক্রমণে গোল হজম করে। ওই সময় দ্বিতীয় গোলের জন্য মরিয়া না হয়ে জমাটবাধা রক্ষণের আশ্রয় নেওয়া উচিত ছিলো ব্রাজিলের। এই ভুলটা না করলে হয়তো লিড নিয়েই অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের খেলা শেষ করতে পারতো তারা। ম্যাচটা তখন টাইব্রেকেও যেত না।

সিলভাদের আলগা রক্ষণ: এবারের বিশ্বকাপে ব্রাজিল তিনটি ম্যাচে গোল হজম করেছে। এর কারণ আলগা রক্ষণ। ক্রোয়েশিয়া ম্যাচেও তা দেখা গেছে। মূলত ম্যাচজুড়ে ব্রাজিলকে আক্রমণাত্মক মেজাজে দেখা গেছে। দলটির ডিফেন্ডাররাও প্রায়শই আক্রমণে যোগ দিয়েছেন। এতে করে রক্ষণে ঘাটতি দেখা যায়। ক্রোয়েশিয়ার গোলের সময় ব্রাজিলের ডি-বক্সে তিনজনকে দেখা যায়। অথচ আক্রমণের সময় ক্রোয়াটদের বাড়তি দুজন ছিল। ফলে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের প্রত্যেককে মার্ক করা সম্ভব হয়নি। যার খেসারত ব্রাজিল দিয়েছে গোল হজম করে।

টাইব্রেকারে কোচের ভুল সিদ্ধান্ত: টাইব্রেকার মূলত ভাগ্যের খেলা। কিন্তু নিজেদেরও করণীয় কিছু থাকে। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা এবং পেনাল্টি শটে পারদর্শী কাউকে প্রথম শট নিতে পাঠানোটাই শ্রেয়। অথচ তিতে পাঠালেন রদ্রিগোকে। তার প্রতিভা নিয়ে অবশ্য সংশয় নেই, কিন্তু অমন স্নায়ুচাপের মুহূর্তে ভুল করে বসেন অনভিজ্ঞ রিয়াল ফরোয়ার্ড। পরে সুযোগ কাজে লাগিয়ে জয়ের দিকে এগোতে থাকে ক্রোয়েশিয়া। ক্রোয়াটরা যেহেতু প্রথম শটেই লিড নিয়েছে তাই ব্রাজিল কোচের উচিত ছিল ক্যাসেমিরো, থিয়াগো সিলভা কিংবা নেইমারের মতো অভিজ্ঞ কোনো খেলোয়াড়কে প্রথম পেনাল্টি নিতে পাঠানো। গত বছর ইতালির বিপক্ষে প্রায় একই ভুলটা করেছিলেন ইংল্যান্ড কোচ গ্যারেথ সাউথগেট। সেই ভুলটা তিতের মতো পোড়খাওয়া কোচ কীভাবে করলেন তা ছিল বিস্ময়ের।

অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস: ব্রাজিলের বিদায়ের আরেক কারণ অতিমাত্রার আত্মবিশ্বাস। যা ডুবিয়েছে দলকে। আসরের শিরোপা জয়ের প্রতিশ্রুতি শুরু থেকেই দিয়ে এসেছে তারা। ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে এসে বারবার গোলের সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় প্রত্যাশার বাড়তি চাপে পড়ে যায় তারা। এ ছাড়া নিজেদের অনেক শক্তিশালী দল হিসেবে জাহির করেছে সেলেকাওরা। এতে করে ক্রোয়েশিয়াকে নিজেদের তুলনায় দুর্বল ভেবেছে তারা। মোট কথা ফেভারিটের ফাঁদে পা দিয়ে বড় ভুল করেছে তারা।

মাঠের বাইরের ইস্যুতে মনোযোগ: ব্রাজিলের হারার আরেকটা কারণ হতে পারে মাঠের খেলা থেকে মনোযোগ সরানো। ম্যাচে লিড নেওয়ার পর দলটির খেলোয়াড়দের গোল হয়ে নাচতে দেখা যায়। আরেকটি গোল করে সাম্বা নাচের আরেকটি ধরন দেখানোর চেষ্টা ছিলো সেলেকাওদের। কিন্তু দ্বিতীয়বার আর উদযাপনের সুযোগ পায়নি তারা। বরং লিড বাড়াতে গিয়ে তাদের হজম করতে হয় গোল। এছাড়া ম্যাচের আগে নানা রকম নাচ অনুশীলনের কথা জানায় ব্রাজিল শিবির। এই সময়ে নাচের অনুশীলন না করে পেনাল্টি চর্চা বাড়াতে পারতো ব্রাজিল।

দুর্ভাগ্যজনক গোলহজম: নিঃসন্দেহে এবারের বিশ্বকাপের সম্ভাব্য সেরা এবং শক্তিশালী দল ছিল ব্রাজিলের। কিন্তু বিশ্বকাপের এই একটা রহস্য- সেরা দলের ট্রফি জেতার ঘটনা বিরল। সিংহভাগ ক্ষেত্রেই স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় সেরা দলের। এর নেপথ্য বড় কারণ, শক্তিশালী দল হওয়ার পাশাপাশি ভাগ্যের আনুকূল্যেরও দরকার পড়ে। যেটা ব্রাজিল পায়নি। বরং দুর্ভাগ্যক্রমে ম্যাচের শেষ দিকে গোল হজম করে তারা। তা না হলে প্যাটকোভিচের শটটা কেন ব্রাজিল অধিনায়ক ও ডিফেন্ডার থিয়াগো সিলভার পায়ে লেগে বলের গতিপথ পাল্টে অমনভাবে জালে ঢুকে যাবে! এতে বিভ্রান্ত হন ব্রাজিল গোলরক্ষক এলিসন বেকার। ঝাপ দিয়েও বলের নাগাল পাননি তিনি।