ব্রাজিলের ইউরোপিয়ান ‘দুঃখ’

প্রতিটি বিশ্বকাপে ফেভারিটের তকমা গায়ে জড়িয়ে খেলতে আসে ব্রাজিল। শক্তিশালী দল নিয়ে বেশ আশা জাগিয়ে দারুণ সূচনাও হয় তাদের। কিন্তু শেষটা ভালো হয় না। শেষটা হয় হতাশায় মোড়ানো। বিদায় নিতে হয় ইউরোপের কোনো জায়ান্টের হাত ধরে। সবশেষ পাঁচ আসরে এটাই যেন চিরায়ত রীতি হয়ে উঠেছে। এবার যেমন গতকাল শুক্রবার রাতে ক্রোয়েশিয়ার কাছে স্বপ্ন জমা দিয়ে এসেছে সেলেকাওরা।

ব্রাজিলের ইউরোপিয়ান 'দুঃখ'

বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দল ব্রাজিল। সর্বোচ্চ পাঁচবার শিরোপা জিতেছে হলুদ শিবির। পঞ্চম শিরোপা জয়ের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে আট বছর। কিন্তু ষষ্ঠ শিরোপা ব্রাজিলের জন্য হয়ে উঠেছে বড় একটা রহস্য। ২০ বছর পেরিয়ে গেলেও 'হেক্সা' মিশন আর সফল হচ্ছে না রোনালদো-পেলের দেশের। সেটা না হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ ইউরোপিয়ান 'জুজু'। এই বৃত্তটা কোনোভাবেই ভাঙতে পারছে না ব্রাজিল।

প্রতিবারই কোনো না কোনো ইউরোপিয়ান প্রতিনিধির কাছে 'হেক্সা' স্বপ্ন দিয়ে আসতে হচ্ছে। এবার অন্তত ইতিহাসের এই ইউরোপিয়ান দেয়াল ভাঙার মজবুত এক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ব্রাজিল। কিন্তু প্রতিপক্ষ পাল্টালেও ভাগ্যের আর পরিবর্তন করতে পারেনি সেলেকাওরা। তাদের একই পরিণতি দিলো গত আসরের ফাইনালিস্ট লুকা মডরিচের ক্রোয়েশিয়া।

এই পাঁচ আসরের চারটিতেই আবার ব্রাজিল বিদায় নিয়েছে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। ব্যতিক্রম হয়েছিল ২০১৪ বিশ্বকাপ। ঘরের মাঠে ওই আসরের সেমিফাইনালে উঠেছিল সাম্বার দেশটি। সেই বিশ্বকাপ আবার ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসে আরেক ভয়ংকর ট্রাজেডি। নিজেদের মাঠে ৭-১ গোলে চূর্ণ হয় নেইমার-থিয়াগো সিলভাবিহীন ব্রাজিল।

সেবার সেলেকাওরা শেষ আটের গন্ডি পাড়ি দিয়েছে। এর নেপথ্য কারণ হতে পারে, সেমির আগ পর্যন্ত কোনো ইউরোপিয়ান দলের সামনে মুখোমুখি হতে হয়নি তাদের! তাই জার্মানির সামনে পড়তেই ইউরোপিয়ান জুজুতে আটকে যায় তারা। এর আগের দুই বিশ্বকাপে ব্রাজিল বিদায় নেয় নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্সের হাত ধরে।

ল্যাটিন আমেরিকান জায়ান্টদের রাহুর দশাটা লেগেছিল ২০০৬ সালে জিনেদিন জিদানের ফ্রান্সের কাছে হেরে। এবারের কাতার বিশ্বকাপে লুকা মডরিচের ওপর যেন 'বুড়ো' জিদানের আত্মা ভর করেছে। এই আসরেও যেন অভিজ্ঞতার মূল্য চুকাচ্ছেন তিনি। বলতে গেলে প্রায় একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন ক্রোয়েশিয়াকে। দলটিকে উঠিয়েছেন সেমিফাইনালে।

প্রায় সাড়ে চার বছর আগে সম্ভাব্য সেরা দল নিয়ে সোনালি প্রজন্মের বেলজিয়ামের কাছে হেরেছিল ব্রাজিল। সেই হারটা মেনে নেওয়া যতটা সহজ ছিল, ততটাই কঠিন হয়ে উঠল ক্রোয়েশিয়ার কাছে হারটা। এই ম্যাচে তো জয়ের খুব কাছেই ছিল হলুদ শিবির। নেইমারের গোলের লিড নিয়ে ম্যাচ শেষের অপেক্ষাতেই ছিল তিতের দল।

কিন্তু ১১৭ মিনিটে প্যাটকোভিচের গোল কেড়ে নেয় ব্রাজিলের মুখের গ্রাস। দুই ঘণ্টার স্নায়ুযুদ্ধ শেষে ফল দাঁড়ায় ১-১। ম্যাচ গড়ায় ভাগ্য নির্ধারণীর খেলা টাইব্রেকারে। সেখানেই ক্রোয়েশিয়ার বাজিমাত। ৪-২ গোলে জিতে উৎসবে মেতে ওঠেন মডরিচরা। কান্নায় ভেঙে পড়েন নেইমাররা। এই কান্নার রঙ হলুদ।

হতাশার এই হারের জের ধরে শেষ হয়ে গেল ব্রাজিলের অর্ধ যুগের এক অধ্যায়। প্রধান কোচের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন তিতে। তার উত্তরসুরি এখন খুঁজতে হচ্ছে ব্রাজিল ফুটবলের নীতি নির্ধারকদের। হয়তো সেটা দ্রুতই পেয়ে যাবেন তারা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন কোচ এসে কি ব্রাজিলের ভাগ্য বদলে শিরোপা জেতাতে পারবেন?

এর চেয়েও বড় প্রশ্ন, ল্যাটিন আমেরিকান পরাশক্তিরা কি ইউরোপিয়ান ভুত তাড়াতে? ব্রাজিলের 'হেক্সা' মিশনে এটাই যে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে!

একনজরে ব্রাজিলের সবশেষ পাঁচ বিশ্বকাপ

২০০৬ বিশ্বকাপ
কোয়ার্টার ফাইনাল
ফ্রান্স ১-০ ব্রাজিল

২০১০ বিশ্বকাপ
কোয়ার্টার ফাইনাল
নেদারল্যান্ডস ২-১ ব্রাজিল

২০১৪ বিশ্বকাপ
সেমিফাইনাল
ব্রাজিল ১-৭ জার্মানি

২০১৮ বিশ্বকাপ
কোয়ার্টার ফাইনাল
ব্রাজিল ১-২ বেলজিয়াম

২০২২ বিশ্বকাপ
কোয়ার্টার ফাইনাল
ব্রাজিল ১-১ (অতিরিক্ত সময়)
টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে জয়ী ক্রোয়েশিয়া। বিদায় ব্রাজিল।