ঢাকা-দিল্লি বন্ধুত্বে উত্থান-পতন!

প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। যার শুরুটা হয়েছিলো বাংলাদেশর জন্মলগ্ন ১৯৭১ সালে। বন্ধুত্বের প্রতিদান স্বরূপ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি করা হয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। দুইদেশের বিভিন্ন নেতার বক্তব্যেও বন্ধুত্বের গভীরতার বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়। এতদসত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সামনে আসছে নানা প্রশ্ন। এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জার্মান গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ফাইল ছবি

সেখোনে উল্লেখ করা হয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গেই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে ভারতের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্ধিরা গান্ধীর হাত ধরে এর যাত্রা শুরু হয় হয় বাংলাদেশর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। পরবর্তীতে এই সম্পর্ক নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে আজকের এই পর্যায়ে এসেছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আমলে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল বলে প্রতিবেদেনে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে গত ১২ বছরে সম্পর্কের তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি ঘটে। 

তারপরেও দ্বিপাক্ষিক এই সম্পর্ককে ঘিরে নানা অভিযোগ-অনুযোগ আছে, সাথে রয়েছে উদ্যোগ ও প্রতিশ্রুতি রাখার মতো গুরুতর সমস্যা। সঙ্গত কারণেই বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ব্যাপারে ভারতকেই উদ্যোগী হতে হবে।

ভারত, চীন ও বাংলাদেশের পতাকা

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে চীনের বিষয়টি। সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে তা আরো পরিষ্কার হয়। বাংলাদেশ কোয়াডে যোগ দিলে বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হবে বলে সতর্ক করে দেন তিনি। কেননা ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার এই জোটকে চীন বিরোধী হিসেবে বর্হিবিশ্বে বিবেচনা করা হয়।

পরে চীনা রাষ্ট্রদূত তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন বলে জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমের আক্রমণাত্মক প্রশ্নের জেরে খেই হারিয়ে ওই মন্তব্য করেছেন চীনা রাষ্ট্রদূত। যদিও লি জিমিংয়ের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

পরবর্তীতে কোয়াড নিয়ে বাংলাদেশর অবস্থান আরো পরিষ্কার করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন। ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি  বলেন, আমরা (বাংলাদেশ) কোনো সামরিক চুক্তি বা জোটে নেই। আমরা কোনো সামরিক চুক্তিতে যাবো না। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো মানুষের মঙ্গল, দেশের উন্নয়ন। আমাদের অবকাঠামো, অর্থনৈতিক উন্নয়নে কেউ যদি সহায়তা করে, আমরা তাদের সঙ্গে যাব।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ফাইল ছবি

কোয়াডে (বাংলাদেশে যুক্ত হওয়া নিয়ে) নিয়ে চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য প্রসঙ্গে ভারতীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বিবেকানন্দ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সেন্টার হেড শ্রীরাধা দত্ত বলেন, রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের পর দিন একই ধরনের বক্তব্য আসে চীন সরকারের গ্লোবাল টাইমসের এক নিবন্ধে। ফলে বিষয়টি নতুন করে ভাবিয়ে তোলে ভারতকে।

মোদির ঢাকা সফরে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে ভারতের প্রস্তাবিত হাইওয়েতে বাংলাদেশকে যুক্ত করার আগ্রহ দেখান শেখ হাসিনা। তারপর কোয়াডে ঢাকা ঢুকে গেলে বেইজিংয়ের জন্য তা মুশকিল হবে, এটা ভাবা অস্বাভাবিক নয় বলে মনে করেন শ্রীরাধা দত্ত।

তবে ভারতের পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞ প্রণয় শর্মা বলছেন, যেকোনো দেশ নিজেদের স্বার্থে কেবল একটি নয়, অনেক দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখে। ফলে ভারতের সঙ্গে বিশেষ বন্ধুত্ব থাকায় চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্কে তো দোষের কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে ঢাকার অগ্রাধিকার ও দিল্লির লাভ বুঝতে হবে উভয় দেশকেই।

শুধু তাই নয়, যথাসময়ে করোনার টিকা পাওয়া নিয়েও ভারত-বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে কথা দেয়া-নেয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও চুক্তি অনুযায়ী টিকা হাতে পায়নি।

উল্লেখ্য, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত এবং ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত করোনা টিকার ৩ কোটি ডোজ পেতে সেরামের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। চুক্তি অনুযায়ী অগ্রীম টাকা পরিশোধ করা হলেও দিল্লির রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে মাত্র ৭০ লাখ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার দ্বিতীয় ডোজের ঘাটতি টিকা পেতে কয়েকটি দেশের সাথে যোগাযোগ করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এখনও নিশ্চয়তা মেলেনি।

এতে টিকাদান কর্মসূচি আটকে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে বিকল্প দেশ থেকে দ্রুত টিকা আনার চেষ্টা শুরু করে ঢাকা। এতে সাড়া দেয় চীন-রাশিয়া। বিশেষ করে বেইজিং দুই দফায় সিনোফার্মের ১১ লাখ ডোজ টিকা উপহার দেয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনকে ফোন করে এই উপহারকে ‘বন্ধুত্বের নিদর্শন’ বলে বর্ণনা করেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই।

এ ছাড়া দেড় কোটি ডোজ চীনা কেনার অনুমোদন দেয়া হয় গত ২৭ মে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায়। এসব টিকার প্রথম চালান আগামী জুন-জুলাই নাগাদ দেশে আসবে বলে জানানো হয়েছে। দেশটির সঙ্গে যৌথভাবেও টিকা উৎপাদনের বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছে বাংলাদেশ।

এ থেকে স্পষ্ট টিকা কূটনীতিতে ভারতের চেয়ে বেশ এগিয়ে আছে চীন। সমানের দিনগুলোতে যা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।