সিলেট সুনামগঞ্জের বন্যার আদ্যোপান্ত

বসত ঘরের টিনের চালের একেবারে উপরে বসে আছে ছোট শিশু। চোখে মুখে তার ভয়ের ছাপ। পুরো বাড়িসহ বসতঘর ডুবে গেছে বন্যার পানিতে। একটি উঁচু ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে নিজের টিনের ঘর পানিতে ভেসে যেতে দেখে চিৎকার করে কাঁদছেন বৃদ্ধা মা।

সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি

শেষ সম্বল গোয়ালের একটি গরুকে টেনে হেঁচড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে গেছেন কোনো বৃদ্ধ বাবা। তিল তিল করে কেনা ঘরের আবাসপত্র পানিতে ফেলে কোলের শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বুক পানিতে হেঁটে চলছেন কোনো বাবা-মা। ছোট বোনটিকে ঘাড়ে তুলে কোমড় পানিতে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে চলেছে স্কুল পড়ুয়া বড় ভাই।

এসব করুণ দৃশ্য নাড়া দিয়েছে দেশ-বিদেশের হাজারো মানুষকে। নিজেদের সাধ্যমতো বানভাসিদের পাশে দাঁড়নোর চেষ্টা করছে অনেক ব্যাক্তি, সংগঠন।

সবার দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের সিলেট বিভাগে। এ বিভাগের ৪ জেলাতেই বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। সিলেট শহরের ৮০ ভাগ বন্যার পানিতে ডুবে গিয়েছিল। সব থেকে ভয়ানক পরিস্থিতিতে পড়েছিল সুনামগঞ্জ জেলার মানুষ। এ অঞ্চলের ৯০ ভাগ বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল।

শুধুমাত্র নিচু জমি নয়, উঁচু জমিসহ বসত বাড়ি, রাস্তাঘাট সবই তলিয়ে গেছে পানিতে। বন্ধ ছিল পুরো জেলার বিদুৎ সংযোগ। মোবাইলের নেটওয়ার্কও কাজ করেনি কিছু কিছু এলাকায়। ভেঙে গেছে ব্রীজ, সংযোগ সড়কসহ মুল সড়ক সবই বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।

সড়ক পথে সুনামগঞ্জে সকল প্রকার বাস, ট্রাক, সিনএনজিসহ যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চলাচলের একমাত্র বাহন ছিল নৌকা।

সরকারি তথ্য যা বলছে

বর্তমানের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারের বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিনস্ত বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, দেশের সকল প্রধান নদ-নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয়, হিমালয় ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকাজুড়ে ভারী বৃষ্টি এবং অতি ভারী বৃষ্টির ফলে নদীতে পানির সমতল বৃদ্ধি পায়।

কানাইঘাটের সুরমা নদীর পানির সমতল ১৩.৮৩ মিটার, যা বিপদসীমার ১০৭ সে. মি. উপরে। সিলেটে সুরমা নদীর পানি ছিল ১১.৫০ মিটার যা বিপদসীমার ৭০ সে. মি. উপরে। এছাড়াও সুনামগঞ্জের লরেরগড়ের যাদুকাটা নদীতে পানি ছিল ৯.৫৯ মিটার, যা বিপদসীমার ১৫৪ সে. মি. উপরে।

রেকর্ড ভেঙেছে বাংলাদেশের বিগত বছরের

সিলেট বিভাগের চলমান বন্যা পরিস্থিতি বাংলাদেশের বিগত বছরের বন্যার সব রেকর্ড ভেঙেছে। বাংলাদেশ সৃষ্টিরও আগে ১৯৭০ সালের তৎকালীন পাকিস্তানি শাসন আমলে এ দেশে মহাপ্রলয়ঙ্করী বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে হয়েছিল। তৎকালীন সরকারি হিসেবেই প্রায় ৫ লাখ মানুষ মারা যায়।

দেশ স্বাধীনের পরও অনেক বার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। ১৯৮৭ এবং ১৯৮৮ সালের বন্যা ছিল বড় আকারের। ১৯৮৭ সালে দেশের প্রায় ৫৭ হাজার ৩০০ বর্গ কিলোমিটার এবং ১৯৮৮ সালে প্রায় ৮২ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা বন্যার পানিতে ডুবে গিয়েছিল।

এরপর ১৯৯৮ সালের বন্যা এখনও এদেশের মানুষের মনে দাগ কেটে রয়েছে। এই বন্যা ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা। দেশের এক লাখ ২৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্রবেশ করেছিল বন্যার পানি।

ঠিক তার ২ বছর পর অর্থাৎ ২০০০ সালের বন্যাও ছিল বেশ বড় । তারপর ২০০৭ সালেও বন্যার কবলে পড়েছিল দেশ। এরপর ২০১৭ সালে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো পড়েছিল ভয়াবহ বন্যার কবলে।

তবে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সুত্র জানায়, সিলেট অঞ্চলে ১৯৯৮ সালের বন্যায় এত বেশি এলাকা ডুবে যায়নি। সর্বশেষ  ২০১৯ সালেও  সুনামগঞ্জ ও সিলেট শহরে হঠাৎ বন্যা হয়েছিল। সেই সময়ও এত এলাকা প্লাবিত হয়নি৷ শুধুমাত্র নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছিল।

বন্যা সম্পর্কে যা বলছে বিদেশি সংস্থা

সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূ-উপগ্রহভিত্তিক সংস্থা ইসিএমডব্লিইউর জানিয়েছে, বাংলাদেশের উজানে ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এর আগেও ওই এলাকায় ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। 

এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাইটে বাংলাদেশের বন্যা পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী জানানো হয়েছে, সুনামগঞ্জ জেলার  সুরমা নদীতে সেকেন্ডে ১২ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। পানির উচ্চতা বিপদসীমার বেশ উপরে ছিল।

বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

সিলেটে সৃষ্টি হওয়া বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তারা সকলেই কিছু বিষয়ে একমত হয়েছেন। সিলেট বিভাগের বেশির ভাগ নদ-নদী পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। সে কারণে বৃষ্টির পানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তা ধরে রাখতে পারছে না নদ-নদীগুলো। ফলে নদীর পানি উপচে আশেপাশের জনবসতি, গ্রাম, শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে।

ক্ষতিগ্রস্ত ৩০ লাখ মানুষ, বাড়তে পারে সংখ্যা

সিলেটের দুই জেলায় বন্যার কারণে ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লাখ লাখ মানুষ আটকে পড়েছিল বন্যার পানিতে। সে সকল মানুষকে উদ্ধারে বিষয়টি প্রথমে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও জানিয়েছেন, ভারতের মেঘালয়ে  ভারী বর্ষণের কারণে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকেই হঠাৎ বাড়তে শুরু করে পানি। মাত্র ১২ ঘন্টার মধ্যেই সুনামগঞ্জে চার ফুট পানি বেড়ে যায়। জেলা শহরেও সব রাস্তায় পানিতে তলিয়ে যায়।

সুনামগঞ্জের পাঁচটি এবং সিলেটের তিনটি উপজেলায় সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী, বিজিবি, ফায়ার ও কোস্ট গার্ডেরসদস্যরা পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারে কাজ শুরু করেছেন এবং ত্রানসামগ্রী বিতরণ করছেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক।

বিপদ বাড়ছে, বন্যা আরও ১৭ জেলায়

সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও মধ্যে নতুন করে বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, ভারতের মেঘালয় মানে উজানের দিকে অতি ভারী বৃষ্টির কারণে সিলেট বিভাগে বন্যা দেখা দেয়।

তিনি আরও জানান, দেশের আরও ১৭টি জেলায় বন্যা হতে পারে। পদ্মা নদী গঙ্গার উজানের দিকে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ফলে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর ও ফরিদপুরে নিম্নাঞ্চলে বন্যা হতে পারে।

এছাড়া ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা কুড়িগ্রাম দিয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। যার কারণে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও পাবনায় বন্যার পানি প্রবেশ করতে পারে। তিস্তা অববাহিকার কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও রংপুরের কিছু এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে।