আদালতে শুনানির ৫ ঘণ্টা আগেই গণমাধ্যমে রায়ের খবর!

আদালতে শুনানি শুরুর সাড়ে চার ঘণ্টা আগেই পুলিশের বরাত দিয়ে রায়ের খবর বেরিয়েছে পত্রিকায়-টিভিতে। গতকাল শনিবার নজিরবিহীন এ ঘটনা ঘটেছে ভারতে। অল্ট নিউজের প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক মোহাম্মদ জুবায়েরের জামিন আবেদন নাকচ করে আদালত তাকে ১৪ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে বলে দুপুরে খবর প্রকাশ করে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম। পরে সন্ধ্যায় হুবহু একই রায় দেয় দিল্লীর পাতিয়ালা হাউস ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট!

সাংবাদিক মোহাম্মদ জুবায়েরকে ১৪ দিনের বিচারিক রিমান্ডে পাঠিয়েছে দিল্লীর ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট

ফ্যাক্ট-চেকিং পোর্টাল অল্ট নিউজের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ জুবায়েরের জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে ১৪ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে নয়াদিল্লীর পাতিয়ালা হাউস ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট। গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় জুবায়েরের জামিন আবেদনের শুনানি শুরু হয়। প্রায় ৩০ মিনিট শুনানি শেষে আদালত এ রায় দেন।

এর আগে দুপুর আড়াইটায় এএনআই, জি টিভিসহ বিজেপিপন্থী কয়েকটি টিভি, নিউজ পোর্টাল ও সংবাদ সংস্থা জুবায়েরের জামিন আবেদন নাকচ ও ১৪ দিনের রিমান্ডের খবর প্রকাশ করে। দিল্লী পুলিশের ডেপুটি কমিশনার কেপিএস মালহোত্রার বরাতে সবার আগে খবরটি ছাপে সংবাদ সংস্থা এএনআই। এরপর অন্যরাও একই খবর পরিবেশন করে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও টিভিতে জামিন আবেদনের খবর দেখে বিষ্ময় প্রকাশ করেন মোহাম্মদ জুবায়েরের আইনজীবী সৌতিক ব্যানার্জি।

গতকাল দুপুরে আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী সৌতিক ব্যাানর্জি সাংবাদিকদের বলেন, মধ্যাহ্নভোজের বিরতির পর বিচারক এখনও এজলাসে আসেননি। কিন্তু এরইমধ্যে হতবাক হয়ে দেখছি ডিসিপি কেপিএস মালহোত্রা গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমাদের আবেদন নাকচ করে ১৪ দিনের বিচারিক রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।

তিনি বলেন, বিচারিক হাকিম আসন গ্রহণের আগেই রায়ের খবর পুলিশ জেনে যাচ্ছে এবং সাংবাদিকদের জানাচ্ছে। এটা চরম কেলেঙ্কারি ছাড়া আর কিছুই নয়! দেশে আইনের শাসনের কী অবস্থা হয়েছে তা এখন স্পষ্ট। এ ঘটনা আমাদের সবার গুরুতর আত্মানুসন্ধানের দাবি রাখে।

সাংবাদিকদের সামনে জুবায়েরের আইনজীবীর বক্তব্যের কিছুক্ষণ পর কয়েকটি পোর্টালে খবরটি কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করা হয়। এতে বলা হয়- ‘পুলিশের ডেপুটি কমিশনার মালহোত্রা বলেছেন, আমি আমার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছিলাম। চারপাশের আওয়াজের কারণে কি বলেছে ঠিকভাবে শুনতে পাইনি। এ কারণে অসতর্কতাবশতঃ ভুল খবর প্রচার হয়ে গেছে।’

এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রথিতযশা আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ এক টুইটে লিখেছেন, ‘দিল্লীর আদালত মোহাম্মদ জুবায়েরের জামিন আবেদন নাকচ করার পাঁচ ঘণ্টা আগে পুলিশ গণমাধ্যমে রায়ের খবর ফাঁস করেছে। এ ঘটনায় আদালতের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। রায় ঘোষণার পাঁচ ঘণ্টা আগে ডিসিপি কীভাবে সেটা জানেন? হাইকোর্টকে অবশ্যই বিষয়টি তদন্ত করতে হবে।’

গত সপ্তাহে মোহাম্মদ জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করে দিল্লী পুলিশ। ২০১৮ সালে মোহাম্মদ জুবায়ের হৃষিকেষ মুখার্জির ছবি ‘চুপকে চুপকে’র একটি স্থিরচিত্র পোস্ট করেন। ১৯৮৩ সালে ভারতের সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পাওয়া বহুল জনপ্রিয় ছবিটিতে দেখানো হয়, ফারুখ শেখ তার নবপরিণীতা স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে গেছেন। তিনি ‘হানিমুন হোটেল’ নামে একটি হোটেল খুঁজতে গিয়ে দেখেন সেটির নাম পাল্টে ‘হনুমান হোটেল’ করা হয়েছে। 

ভারতে বিজেপি সরকার যেভাবে সবকিছুর নাম পাল্টাচ্ছে, তার প্রতি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত করেই জুবায়ের ‘হনুমান হোটেল’ লেখা সাইনবোর্ডের স্থিরচিত্র পোস্ট করেন। রামভক্ত হনুমান নামে একটি সন্দেহজনক টুইটার অ্যাকাউন্ট কিছুদিন আগে জুবায়েরের পুরানো টুইটটি পোস্ট করে উপরে লিখে- ‘হনুমানজি’র নামের সঙ্গে হানিমুন যোগ করায় আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি ক্ষুণ্ন হয়েছে। রামভক্ত হনুমানের টুইটটি দেখে দিল্লী পুলিশ স্বপ্রণোদিত মামলা দায়ের করে মোহাম্মদ জুবায়েরকে আটক করে। 

মজার ব্যাপার হলো, রামভক্ত হনুমান নামের টুইটার অ্যাকাউন্টটি ২০২১ সালে খোলা হয়। এর কোনো ফলোয়ার ও ফলোয়িং ছিল না। প্রোফাইলে কোনো মানুষের ছবিও ছিল না। অ্যাকাউন্ট পরিচালনাকারীর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। মোহাম্মদ জুবায়েরকে গ্রেপ্তারের একদিন পর অ্যাকাউন্টটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

ভারতীয় সাংবাদিক ও এনডিটিভির উপস্থাপক রবীশ কুমার বলেছেন, ভুয়া সংবাদ প্রচার ও জনমতকে ভুল পথে প্রভাবিত করা ভারতের ক্ষমতাসীন দলের কোটি কোটি টাকার শিল্পে পরিণত হয়েছে। বিজেপির রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে অবিরাম ভুয়া সংবাদ প্রচার করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় মোহাম্মদ জুবায়েরকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে এ বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে ভুয়া সংবাদের বিরুদ্ধে বেশি কথা বললে বিপদে পড়তে হবে।