পুতিনের সিদ্ধান্তে উভয় সংকটে জাপান

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের একটি সিদ্ধান্ত উভয় সংকটে ফেলেছে জাপান সরকারকে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট গ্রুপ অব সেভেনের (জি৭) সঙ্গে একাট্টা থেকে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ অথবা অতি প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ অব্যাহত রাখতে মস্কোর সঙ্গে লেনদেন- দুইয়ের মধ্যে যে কোনো একটি পথ বেছে নিতে হচ্ছে জাপানকে।

শাখালিন-২ গ্যাসক্ষেত্রের পিলটুন-বি প্রোডাকশন প্ল্যাটফর্ম

বারমুডায় নিবন্ধিত শাখালিন এনার্জি ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের সব দায় ও সম্পত্তি রুশ সরকারের অধিকারে নিতে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। শাখালিন দ্বীপপুঞ্জের কাছে সমুদ্রবক্ষে রাশিয়ার শাখালিন-২ গ্যাসক্ষেত্রের মালিকানা বারমুডায় নিবন্ধিত এ কোম্পানির হাতে।

শাখালিন এনার্জি ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি থেকে গ্যাসক্ষেত্রটির সম্পদ ও দায় অধিগ্রহণ করে গ্যাজপ্রম শাখালিন হোল্ডিংস নামে নতুন একটি কোম্পানি গঠনের আদেশ দিয়েছেন পুতিন।

শাখালিন এনার্জি ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির ৫০ শতাংশ ও একটি শেয়ারের মালিক রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানি গ্যাজপ্রম। অন্য অংশীদারদের মধ্যে ব্রিটিশ কোম্পানি শেলের কাছে রয়েছে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশের চেয়ে একটি কম শেয়ার। এছাড়া জাপানের মিতসুই অ্যান্ড কোম্পানির কাছে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ ও মিতসুবিশি করপোরেশনের হাতে ১০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

পুতিনের নতুন আদেশের ফলে সমস্যায় পড়েছে শাখালিন এনার্জি ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির বিদেশি শেয়ারহোল্ডাররা। রুশ সরকার কোম্পানি অধিগ্রহণ করায় ব্রিটিশ ও জাপানি শেয়ারহোল্ডারদের মালিকানার অংশ অন্য কোনো কোম্পানির কাছে বিক্রির পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

ব্রিটিশ কোম্পানি শেল তাদের হাতে থাকা শেয়ার ভারতের রিলায়েন্স, চীনের সিএনপিসি, সাইনোপেকের কাছে বিক্রির আলোচনা অনেকটুকু এগিয়ে নিয়েছিল। পুতিন এবার সে পথ বন্ধ করেছেন।

নতুন আদেশ অনুযায়ী শাখালিন এনার্জির বিদেশি শেয়ারহোল্ডাররা তাদের মালিকানা অনুপাতে গ্যাজপ্রম শাখালিন হোল্ডিংসের শেয়ার নিতে চাইলে এক মাসের মধ্যে আবেদন করতে হবে। তবে তারা নতুন হোল্ডিংসের সব শর্ত মানতে আপত্তি করলে তাদের অংশের শেয়ার অন্যত্র বিক্রি করা হবে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, শেল ও জাপানি অংশীদাররা গ্যাজপ্রম হোল্ডিংসের প্রস্তাবে রাজি হলেও গ্যাজপ্রম তাদের শেয়ার অন্য রুশ কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিতে পারে। কেননা পুতিনের নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছে, কেবল যে কোনো রুশ কোম্পানি গ্যাজপ্রম শাখালিন হোল্ডিংসের শেয়ার কিনতে পারবে। সেক্ষেত্রে আম-ছালা দুটোই হারাবে শাখালিন এনার্জির বিদেশি অংশীদাররা।

শাখালিন এনার্জি কোম্পানির আকষ্মিক ভাগ্য পরিবর্তনে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে জাপান সরকার। জ্বালানি আমদানির ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল দেশটি এমনিতেই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকার কারণে উপর্যুপরি লোডশেডিং সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এতদিন জাপানের এলএনজি চাহিদার ৯ শতাংশ পূরণ হতো শাখালিন-২ থেকে। এবার হয়তো জ্বালানির সে উৎস বন্ধ হয়ে যাবে।

শাখালিন থেকে এলএনজি আসা বন্ধ হলে জাপানকে অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের মতো হন্যে হয়ে জ্বালানি বাজারে ঘুরতে হবে। রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কমাতে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ তেল ও গ্যাসের বিকল্প উৎস খুঁজতে আগে থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে তদবির ও দেন-দরবার করছে। এবার ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে জ্বালানি বাজারে নামতে হবে জাপানকেও।

ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পাশাপাশি জাপানও মস্কোর বিরুদ্ধে বেশকিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭ এর অংশ হিসেবেও জাপান রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে। শাখালিন গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি জাপানকে নিষেধাজ্ঞা ভুলে রাশিয়ার দ্বারস্থ হতে বাধ্য করবে বলে মনে করছেন অনেকে।

জ্বালানি বাজার বিশ্লেষক হিরোশি হাশিমোতো ব্লুমবার্গকে বলেছেন, শাখালিন-২ প্রকল্প থেকে প্রতিযোগিতামূলক দামে জ্বালানি পেত জাপান। সে উৎসটি বন্ধ হলে জাপানকে জরুরি ভিত্তিতে স্পট মার্কেটে যেতে হবে। এতে করে স্পট মার্কেটে বড় ধরণের অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।

পুতিনের নতুন সিদ্ধান্তের পর জাপান সরকার এরইমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া সরকারকে জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধির অনুরোধ জানিয়েছে।

জাপান সরকারের একজন কর্মকর্তা ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, গ্যাজপ্রম শাখালিন হোল্ডিংসের অধীনে আগের চেয়ে বেশি কর দিতে হলেও আমরা শাখালিনের মালিকানা-অংশ ধরে রাখবো।

শাখালিন এনার্জির মালিকানার ধরন পাল্টালেও সেখান থেকে জাপানে গ্যাস সরবরাহ আকষ্মিকভাবে বন্ধ হবে না বলে মতপ্রকাশ করেছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। কিয়েদো নিউজ এজেন্সিকে তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই গ্যাসক্ষেত্র অপারেটরের সঙ্গে যোগাযোগ করব এবং কী ধরণের পদক্ষেপ নিতে হয় সেটা চিন্তা করবো।