‘বেনু’ ও তার ‘মাসী’ এবং বিষধর সাপের দংশন
- Details
- by ডা. পলাশ বসু
প্রশ্নফাঁস করে মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার কথা আমরা বিভিন্ন সময়ে শুনেছি। ২০১৪-১৫ সালের দিকে এটা নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক হৈ চৈ হয়। তখন বিষয়টিকে অস্বীকার করে একরকম ধামাচাপা দিয়ে কথিত ভাবমূর্তি ধরে রাখাটাকেই কর্তৃপক্ষ সঠিক কাজ বলে মনে করেছে। ফলে এ নিয়ে কোনোরকম তদন্তও হয়নি। এখন সিআইডির অভিযানে যখন প্রশ্নফাঁস চক্রের হোতাদেরকে ধরা হচ্ছে তখন এ প্রশ্নটি সামনে এসেই যায়- কেন তাহলে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগকে বিভিন্ন সময়ে অস্বীকার করা হলো? এর উত্তর কি? যারা এ সময়ে একটা গ্রহণযোগ্য এবং দুর্নীতিমুক্ত পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন তারা কিভাবে এর দায় এড়াবেন? তারা কি জেনে-বুঝে অস্বীকার করার কাজটি করতেন? নাকি সত্যি সত্যিই প্রশ্নফাঁস যে হতো সেটা তারা জনতেনই না?
আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই চক্র স্বীকার করেছে ২০০৩ সাল থেকেই নাকি তারা মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছে। এরা সত্যিকার অর্থেই বিষধর সাপের চেয়েও ভয়াবহ। কারণ বিষধর সাপের কামড়ে যথাযথ চিকিৎসা দিলে রোগী বেঁচে যায়। আর এরা যা করেছে তাতে সমাজ এবং রাষ্ট্রের মর্মে মর্মে বিষ ঢেলে দিয়েছে। এমনিতেই আমাদের দেশে ভুয়া ডাক্তারের অভাব নেই। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে প্রশ্নফাঁস করে বনে যাওয়া চিকিৎসক বা হবু চিকিৎসক। হবু চিকিৎসক বলতে বুঝাচ্ছি যারা এখনও মেডিকেল কলেজে পড়ালেখা শেষ করে চিকিৎসক হয়ে ওঠেনি।
প্রশ্নফাঁসের এহেন যজ্ঞ করে চিকিৎসা ব্যবস্থার পিঠে ছুরি মারার সকল আয়োজন যারা সম্পন্ন করেছে তাদের প্রত্যেককে শাস্তির আওতায় আনা দেরিতে হলেও ভীষণ জরুরি ছিল। দেশের আপামর জনসাধারণের মতোই কোনো চিকিৎসক ব্যক্তিগতভাবে বা চিকিৎসক সংগঠনগুলোও এরকমের পদক্ষেপের বিরোধিতা তো করবেই না; বরং সর্বোতভাবে সহযোগিতা করবে। তারা দারুণ খুশি হবে। কারণ এরকম জালিয়াতি করে যারা চিকিৎসক হয়েছে তাদের সঙ্গে যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসকবৃন্দ একসঙ্গে থাকতে মোটেই ইচ্ছুক হবেন না। এটা একদম নিশ্চিত। সোশ্যাল মিডিয়াতে আমরা সেটা দেখতেও পাচ্ছি। যারা নিজ নিজ যোগ্যতা দিয়ে চিকিৎসক হয়েছেন বা চিকিৎসক হওয়ার পথে তারা এসব চিকিৎসককে ভুয়া চিকিৎসক হিসেবেই দেখছেন। ফলে চিকিৎসা পেশায় এরকম ভুয়া, দুর্নীতিগ্রস্থ কেউ থাকুক সেটাকে সমর্থন করার তো কোনো কারণই নেই।
শুধু তাই নয়; আমাদের চাওয়া এটা নিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হোক। সেই তদন্তে সন্দেহাতীত যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে তারা এর মধ্যে চিকিৎসক হয়ে গেলেও তাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে হবে। যারা এখনও ছাত্র আছে তাদের ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে আমি দাবি জানাব, যে সকল অভিভাবক প্রশ্নফাঁস করে তাদের ছেলে-মেয়েকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন তাদেরকে সবার আগে আইনের আওতায় আনা উচিত। কারণ এসব ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কিনতে যে পরিমাণ টাকার প্রয়োজন হয়েছে তা নেহায়তই কম নয়। সেই অর্থ তো তারাই দিয়েছেন। তারা যদি এই অর্থ না দিতেন, নিজেরা সৎ হতেন তাহলে তাদের সন্তান কী এভাবে জালিয়াতি করে সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারত?
ছোটবেলায় আমরা বেনুর গল্প পড়েছি। পাঠক মনে আছে সে গল্প? ওই যে, বেনু স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের কলম, পেন্সিল, খাতা চুরি করে আনত। তার মাসী এসব জেনেও তাকে কখনও চুরি করতে নিষেধ করেননি। ফলে মাসীর এ প্রশ্রয় পেয়ে একসময় বড় রকমের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে বেনু। এক সময় তার ফাঁসির আদেশ হয়। ফাঁসির আগে বেনু তার মাসীর সঙ্গে কানে কানে কথা বলতে চায়। মাসী কান আগালে বেনু মাসীর কান কামড় দিয়ে কেটে নেয়। কারণ হিসেবে ভর্ৎসনা করে বেনু বলে ‘মাসি! তুমিই আজ আমার এই ফাঁসির কারণ। মনে করে দেখ যখন আমি প্রথম চুরি শুরু করেছি, তুমি তা জেনেও আমাকে শাসন করনি। বরং প্রশ্রয় দিয়েছ। সেটা না করে যদি তুমি আমাকে শাসন করতে তাহলে আজ আমার এ দশা হতো না। এজন্য তোমার সাথে কানে কানে কথা বলতে চেয়ে তোমার কান কেটে নিলাম।’
শিশুতোষ এ গল্পে বেনু নিজেই চুরি শুরু করেছিল। আর মাসি ছিল তার নীরব সমর্থক। কিন্তু বাস্তবে প্রশ্নফাঁসে যারা সরাসরি জড়িত, যারা টাকা দিয়ে তা কিনেছে তারা একাধারে বেনু এবং মাসী -এ দুই ভূমিকাই পালন করেছে। ফলে এই ‘বেনু’ আর ‘মাসী’- অর্থাৎ প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে যারা জড়িত আর সেই প্রশ্ন ক্রয় করে যারা নিজেদের ছেলে-মেয়েকে ডাক্তার বানাতে বিপুল টাকা ঢেলেছে তাদের শাস্তি হওয়া উচিত সবার আগে। এই ‘বেনু’ আর ‘মাসীদের’ সম্পদের হিসেব নেওয়া উচিত। প্রশ্নফাঁস এবং তা কেনার জন্য যেমন শাস্তি হওয়া উচিত একই সঙ্গে তাদের গড়ে তোলা অবৈধ সম্পদও বাজেয়াপ্ত করা উচিত। এর ফলে সমাজে যথাযথ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে। তাহলে হয়ত আর কোনো অভিভাবক এরকম জালিয়াতি কাজের মাধ্যমে শুধু মেডিকেল নয়; অন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নিজ নিজ সন্তানদের ভর্তি করাতে ইচ্ছুক হবেন না।
এটাও সত্য যে, প্রশ্নফাঁসের এই ভয়ংকর ব্যধি শুধু মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা নয়; বিশ্ববিদ্যালয়ও হয়েছে। আমাদের পাবলিক পরীক্ষা যেমন এসএসসি, এইচএসসি, বিসিএসেও হয়েছে। হয়েছে চাকরির পরীক্ষাতেও। এমনকি প্রাথমিক স্কুলে অনুষ্ঠিত হওয়া সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে! এ সবই আমাদের জানা কথা। মূলতঃ কোনো ধরনের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না থাকাতেই এরকম জালিয়াতি চক্র অবাধে এবং প্রকাশ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং চাকরি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করতে পেরেছে। এর ফলে মেধাবীরা হতাশ হয়েছে। কারণ তারা মেধাবী হয়েও চাকরি পায়নি। এতে করে জাতিও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। নিশ্চয় এই ক্ষতি আমাদেরকে বয়ে চলতে হবে বহুদিন।
যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা আর পূরণ করা না গেলেও এই জালিয়াতি চক্রকে নির্মূল করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে দেরিতে হলেও আমি বলব -তা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। একই সঙ্গে যারা জালিয়াতি করে মেডিকেলসহ অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে, চাকরিতে ঢুকেছে- তাদের এবং তাদের অভিভাবকদেরকেও চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করাটাও সময়ের দাবি। আশাকরি আমরা এভাবেই ‘বেনু’ এবং তার ‘মাসীদের’ নির্মূল করে সমাজকে বিষধর সাপের ছোবল থেকে মুক্ত করতে পারব।
ডা. পলাশ বসু
অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ
এনাম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর