‘শুয়া চান পাখি আমার, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি, তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি।’ উকিল মুন্সী (১১ জুন ১৮৮৫-১২ ডিসেম্বর, ১৯৭৮) নামক একজন বাউল সুরকার ও গীতিকার এই গানের স্রষ্টা। তবে গানটি আমাদের কাছে জনপ্রিয় করেছেন সদ্য প্রয়াত সুর সাধক বারী সিদ্দিকী (১৫ নভেম্বর ১৯৫৪-২৩ নভেম্বর, ২০১৭)।

bari siddique famous singer

উকিল মুন্সির লেখা ও বারী সিদ্দিকীর গাওয়া এই গানটির করুণ সুরের শব্দমালার একটি বেদনার কাহিনী আছে। এখানে আসলে বলা হয়েছে 'শোয়া চান পাখি'। মানে, যে পাখি শুয়ে আছে।

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস মধ্যহ্ন (অন্যপ্রকাশ); মাহবুব কবিরের সংগ্রহ ও সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘উকিল মু্ন্সির গান’ (ঐতিহ্য প্রকাশনী); সাংবাদিক ওয়াহিদ সুজনের ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে' (ঐতিহ্য প্রকাশনী)-তে উকিল মুন্সির জীবনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

উকিল মুন্সির প্রকৃত নাম ছিল আব্দুল হক আকন্দ। নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলার নূরপুর বোয়ালী গ্রামে তার জন্ম। কথিত আছে, উকিল মুন্সীর স্ত্রীর মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে এই গানটি রচিত হয়েছে। তবে গানের কথা নিয়ে প্রচলিত এই তথ্যের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায়নি। ফলে উপরোক্ত বইগুলোতেও এ ঘটনা স্থান পায়নি। ঐতিহাসিক কোন প্রমাণ পাওয়া না গেলেও মানুষের মুখে মুখে এই গানের কাহিনী নানাভাবে বর্ণিত হয়েছে। সেই কাহিনীটি এ রকম-

''উকিল মুন্সী মোহনগঞ্জ থানার জালালপুর গ্রামের সাধারণ এক কৃষকের মেয়ের প্রেমে পড়েন। ১৯১৬ সালে আত্মীয়স্বজনের নিষেধ সত্ত্বেও অনেকটা গোপনে তিনি প্রিয়ংবদা হামিদা খাতুনকে বিয়ে করেন। এরপর তাদের কেটেছে দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন। ১৯৭৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে উকিল মুন্সীর স্ত্রী হামিদা খাতুন অসুস্থ হয়ে পড়েন।

মুন্সী সে সময় দূরের গ্রামে গান করতে গেছেন৷ গানের অনুষ্ঠান চলাকালীন খবর আসলো তার স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ৷ দূরের পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরে এসে গুরু উকিল মুন্সী দেখলেন প্রিয়তমা স্ত্রী আর নেই। প্রিয় মুখখানা মলিন হয়ে পড়ে আছে। তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে উঠানে।

সে সময় অল্প বয়সেই ছেলে-মেয়েদের বিয়ে হত। আমরা এখন যাকে বলি 'বাল্যবিবাহ'। একটা মানুষ যে তার প্রায় সারাটা জীবন আরেকটা মানুষের সাথে কাছাকাছি বসবাস করেছে, সে হঠাৎ করে নেই! এই নশ্বর মায়ার পৃথিবীতে আর কোন দিন তার দেখা মিলবে না। সে হারিয়ে গেল কোন এক দূর অজনায়!

ভাঙ্গা গলায় ডুকরে কাঁদো কাঁদো হয়ে উকিল গাইলেন-
'শুয়া চান পাখি আমার,
আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি,
তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি,
আইজ কেন হইলে নীরব, মেল দুটি আঁখি রে পাখি...

বুলবুলি আর তোতা ময়না কত নামে ডাকি
শিকল কেটে চলে গেলে কারে লইয়া থাকি রে পাখি
আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি।

তোমার আমার এই পিরীতি চন্দ্র সূর্য সাক্ষী
হঠাৎ করে চলে গেলে বুঝলামনা চালাকি
আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি।’

স্ত্রী চলে যাওয়ার পর কয়েক মাসের মাথায় উকিলকে ছেড়ে পরপারে চলে যান তার পুত্র সাত্তার মুন্সী। জীবন সাথী ও ছেলেকে হারিয়ে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়লেন উকিল। প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুর বছরই তিনিও পা বাড়ান না ফেরার দেশে। কথিত এই কাহিনী সত্য হোক কিংবা মিথ্যা হোক উকিল মুন্সীর সেই বেদনার সুর আজো যেন প্রিয়জন হারা মানুষের মুুখে মুখে। যে গানের শব্দ জুড়ে আছে ভালবাসার মানুষের উপস্থিতি। তাকে ডেকে তোলার আকুতি...

অভিমান করে যিনি চলে যান, তার সুর আমরা শুনতে পাই না। শুধু অনুভব করি তিনি যেন গাইছেন লাকী আখান্দের সেই গান- 'আমায় ডেকো না.. ফেরানো যাবে না ফেরারী পাখিরা কুলায় ফেরে না...'