আপনি পড়ছেন

নতুন বছর। নতুন সূর্য। নতুন আনন্দ। নতুন ইজতেমা। কয়েক বছর আগেও ইজতেমাপ্রেমী-ধর্মদরদীদের মন এভাবেই নতুনের আনন্দে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠত। হায় নতুন! তোর আলোয় কোন ব্যথার কালো জমেছে, এখন আর ইজতেমীপ্রেমীদের মনে কানাকড়িও খুশির ফুল ফোটে না। এক ফোটাও আনন্দের বৃষ্টি পড়ে না। একবিন্দুও হাসির জোসনা ঝরে না।

iztema 1

নতুন সূর্য ইজতেমার যে আনন্দের বার্তা নিয়ে আসত, আজ তা শুধুই বুক ফাটা কান্না, নীল বেদনার রঙ ছড়িয়ে যায়। ওই তো কদিন পরই ইজতেমা, কিন্তু কারো হৃদয়েই নেই সুকুন ও সাকিনা।

কয়েক বছর আগেও বাবা-ছেলে, ভাইবন্ধু মিলেমিশে গলাগলি করে ইজতেমায় আসত। জানা নেই চেনা নেই এমন মানুষকেও পরম আপন ভেবে বুকে জড়িয়ে নিতো। একসঙ্গে বাজার করত, রাধাভাড়া করে মুখে হাসি ছড়িয়ে খাওয়া-গোসল করত। বয়ানের মধু আহরণ করত। নামাজে-জিকিরে একে অন্যের সঙ্গে মিষ্টি করে লেগে থাকত। আহ! কলমের কালিও ব্যথায় গুমরে ওঠে। লেখা থামিয়ে জানতে চায়, সেই স্বপ্নের সোনালী ইজতেমা আজ কোথায়!

হাজী মো. মাসুদ- বিশিষ্ট শিল্পপতি এবং রাজনীতিবিদ। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ইজতেমার মেহনতের সঙ্গে লেগে আছেন। এবারও ইজতেমায় যাবেন নিয়ত করেছেন। কিন্তু ভাইয়ে ভাইয়ে গলাগলি করা সেই ইজতেমার কথা মনে পড়লেই নিজেকে আর মানাতে পারেন না।

বললেন, ‘এমন দিনও দেখতে হবে কখনো কল্পনাও করিনি। একই মহল্লায় থাকি, একই মসজিদে নামাজ পড়ি, একই সঙ্গে গাশতে বের হতাম, জামাতে যেতাম, কিন্তু আজ একজন আরেকজনের ছায়া মাড়ানোও গোনাহ মনে করছি। একজন তাবলিগের সাথীর কাছে এরচেয়ে কষ্টের, যন্ত্রণার আর কিছুই হতে পারে না। আমরা সাধারণ মানুষ মুরুব্বিদের পায়ে হাত রেখে অনুরোধ করছি, দয়া করে দ্বীনের স্বার্থে, ইসলামে স্বার্থে এক হয়ে যান। আবার একসঙ্গে ভাইয়ে ভাইয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইজতেমায় যাওয়ার জন্য, গাশতে বের হওয়ার জন্য সাধারণ সাথীরা অধীর আগ্রহে ব্যকুল হৃদয়ে অপেক্ষা করছে।’

নুরুল্লাহ মাহমুদ- রাজধানীর একটি শীর্ষস্থানীয় কওমি প্রতিষ্ঠানের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। দাদার আমল থেকে পুরো পরিবার তাবলিগের সঙ্গে জড়িত। এই তরুণ আলেম বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য! দুটি দলই সুন্নাত এবং কোরআনের সীমায় থাকতে পারেনি। সাধারণ সাথী তো বটেই মুরুব্বিরাও খান্নাসের ওয়াসওয়াসার চোরাবালিতে পড়ে দুনিয়া আখেরাত নষ্ট করে ফেলছেন। আমরা যে তাবলিগ করছি, গাশতে বেরুচ্ছে, ইজতেমা করছি এগুলো সবই সুন্নাত, মুস্তাহাব। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ থাকা, ভ্রাতৃত্ব রক্ষা করা, অন্য মুসলমানের সম্মান-মর্যাদা বজায় রাখা পবিত্র কোরআন এবং হাদিসের আলোকে সুস্পষ্ট ফরজ। অন্য দিকে গালাগালি করা, বিদ্বেষ ছড়ানো সাধারণভাবেই হারাম। আর ধর্মীয় মোড়কে বিদ্বেষ ছড়ানোতো আরো জঘণ্য। হায়! আর দেরি না করে এখনই বিভেদের দেয়াল তুলে নিন। নয়ত একদিন ইজতেমাপ্রেমীরাই দ্বীানের স্বার্থে এ দেয়াল ভেঙে ফেলবে। আমরা ব্যক্তির পূজা করি না, আল্লাহর গোলামি করি।’

iztema

সূরা হুজুরাতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘মুমিনদের দু’টি দল যদি মারামারি-বাড়াবাড়ি-বিদ্বেষে জড়িয়ে পড়ে, তাদেরকে মিলিয়ে দাও...।’ পবিত্র কোরআনের এ আয়াত সামনে রেখে সেগুনবাগিচার খতিব মাওলানা আবদুল কাইউম সোবহানি এবং বাংলাদেশ কওমি শিক্ষক সমিতির মহাসচিব মাওলানা আতাউর রহমান আতিকিসহ একদল আলেম দুই দলকে মিলিয়ে দেয়ার জন্য শুরু থেকেই মেহনত করছেন।

বিভিন্ন জায়গায় জোড়নেওয়ালা জামাত করে মানুষকে বুঝাচ্ছেন মিলে যাও ভাই...। মুরুব্বিদের হাতে পায়ে ধরছেন। ফলাফল যা পেয়েছেন তা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা বললেও খুব একটা ভুল হবে না। দুই দলের মুরুব্বিরাই ভাবছেন- ওরা বুঝি বিপক্ষ দলের ‘দালাল’ হয়ে কাজ করছে। কারো মাহফিল বন্ধ হয়ে গেছে। কারো চাকরি চলে গেছে। কেউ বিভিন্নভাবে হয়রানি এবং হেয়ও হয়েছেন।

মাওলানা আবদুল কাইউম সোবহানি বলেন, ‘এত কষ্ট, এত যন্ত্রণা জীবনে কখনো পেয়েছি বলে মনে পড়ছে না। তাবলিগের মত একটা পবিত্র ও নিঃস্বার্থ বিষয়ও আজ স্বার্থের কোন্দলে ভাগ হয়ে গেলো! মানুষের কাছে মুখ দেখানোর, বড় করে কিছু বলার সে সুযোগ আমাদের রইল না। দুই দলের মুরুব্বিরা যদি সহনশীল এবং ধৈর্যের পরিচয় দিতেন, মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতেন, তাহলে বিষয়টি এত অসুন্দর কখনোই হতো না। এখন তাবলিগের ভবিষ্যত ঘোর অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখছি না। হযরতজী মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) এর তিল তিল করে গড়ে তোলা এ জামাত ধ্বংসের জন্য ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।’

মাওলানা আতিকুর রহমান আতিকি বলেন, ‘ঐক্যছাড়া কখনোই বড় কোনো মাকসাদ হাসিল হয়নি। রাসুল (সা.) ইহুদি-খ্রিস্টানদের সঙ্গে তাদের অন্যায় শর্তগুলো মেনে নিয়েও ঐক্য করেছেন- শুধুমাত্র শান্তি এবং সফলতার জন্য। এর অল্প ক’দিনের মধ্যেই তাবলিগের মেহনত মদিনার গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। আজ বিশ্বজুড়ে বড় কঠিন সময় পার করছে মুসলমান। ভারত, মায়ানমার, ফিলিস্তিনসহ পৃথিবীর কোথাও মুসলমানদের জন্য সুখবর নেই। এমন অসময়ে যত বড় ঝড়ই আসুক ঐক্য ভেঙে ফেলা শিশুসুলভ আচরণ ছাড়া আর কিই বা বলা যায়। আমরা সবাই আল্লাহর জন্যই কাজ করি। সে আল্লাহই বলেছেন, ‘এক মুমিন আরেক মুমিনের ভাই, তোমরা মিলেমিশে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকো। সাবধান! কখেনোই দলাদলি-বিভেদ করো না’- তাহলে আল্লাহর এ নির্দেশ আমরা কেনো মানছি না। অবশ্যই আমাদের ভেতর দুনিয়া এবং স্বার্থ ঢুকে গেছে। ইতিহাস সাক্ষী! স্বার্থ এবং দুনিয়া ছাড়া মুসলমানদের মধ্যে আর কিছুই বিভেদ-ফাটল তৈরি করতে পারেনি।

এ দুই মাওলানাই এক বুজুর্গের উদাহরণ টেনে কথা শেষ করেছেন। মাওলানা হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) ঘোর দুর্দিনে মুসলমানদের কানে যে সবক বাতলে দিয়েছিলেন, আজ তাবলিগের দুঃসময়েও সে কথাই সমাধানের একমাত্র পথ। ‘নেক হও, এক হও, সুন্নাতের পথে চলো’- সুন্নাত হলো মিলে যাওয়া, জুড়ে যাওয়া। হায়! হাফেজ্জী হুজুরের মত দরদী অভিভাবক নেই বলেই কি আজ এক হয়ে নেক হওয়ার সবক মানুষ পাচ্ছে না...! 

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর