আপনি পড়ছেন

ইংরেজি 'ওপেন একসেস' শব্দ দু’টির পরিচিতি মুলক অন্তর্নিহিত অর্থটি আমাদের দেশের শিক্ষা ও গবেষণার প্রেক্ষিতে অনেকের কাছেই নতুন মনে হতে পারে। বর্তমান উন্নত বিশ্বে এটি গবেষণা ও তথ্য ব্যবস্থাপনায় বহুল প্রচলিত নতুন ধারার এক আন্দোলনের নাম। বাংলা তর্জমা করে ‘উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার’ বলা গেলেও; যেহেতু বাংলায় অনেক অনেক ইংরেজি শব্দকে হুবহু নিজের করে নেয়ার নজির আছে, সেহেতু আন্তর্জাতিক অভিন্নতা এবং কারিগরি দিক বিবেচনা করে একে ‘ওপেন একসেস’ নামেই বাংলা ভাষায় স্থান দিলে সুবিধা হবে।

open access

আগামী ২১ অক্টোবর থেকে ২৭শে অক্টোবর বিশ্বব্যাপী ওপেন একসেস সপ্তাহ পালিত হতে যাচ্ছে। এ বছর ওপেন একসেস সপ্তাহ দ্বাদশতম বছরে পদার্পন করছে। মুক্ত গবেষনা, মুক্ত তথ্য ও মুক্ত শিক্ষার সুবিধাগুলি ভিন্ন ভিন্ন দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়কে জানানো এবং উদ্বুদ্ধ করার মহৎ চেষ্টা থেকেই ‘ওপেন একসেস সপ্তাহের’ এই অগ্রযাত্রা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৭ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ‘স্টুডেন্টস ফর ফ্রি কালচার’ এবং ‘অ্যালায়েন্স ফর ট্যাক্সপেয়ারস’ এর সহযোগিতায় ওপেন একসেস আন্দোলনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক Scholarly Publishing and Academic Resources Coalition (স্পার্ক) এর উদ্দ্যোগে প্রথমবারের মতো ওপেন একসেস দিবস পালন করা হয়। শুরুতে এটি ছিল সম্পূর্ণ অনানুষ্ঠানিক একটি আয়োজন। ২০০৮ সালে তারিখটিকে ওপেন একসেস দিবস হিসেবে নামকরণ করা হয় এবং ধীরে ধীরে এই দিবসটি আনুষ্ঠানিক ও বৈশ্বিক হয়ে ওঠে। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠানটি সপ্তাহব্যপী বর্ধিত হয়, যা সেবার ১৯-২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয়; ২০১০ সালে এটি ১৮-২৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ২০১১ সাল থেকে এটি প্রতি বছর অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে পালিত হয়ে আসছে। এবার ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক এই সপ্তাহটির বাংলা প্রতিপাদ্য হল ‘সমতার জন্য মুক্ত জ্ঞান’।

উল্লেখ্য একটি গবেষণা বা সৃষ্টিশীল কাজের পুরোটা প্রান্তিক ব্যবহারকারী সম্পূর্ণ বিনামুল্যে পেলে, কপিরাইট বা গ্রন্থস্বত্বের বাধাবিহীন অনলাইনে বিতরণযোগ্য হলেই কেবলমাত্র তাকে ওপেন একসেস বলা যায়। গবেষণা নিবন্ধ, রিপোর্ট, কনফারেন্স পেপার, মনোগ্রাফ, প্রি-প্রিন্ট, বই, অডিও, ভিডিও, সফটওয়্যার, মাল্টিমিডিয়াসহ যে কোন মৌলিক কাজই ওপেন একসেসের আওতাভুক্ত। মূলতঃ গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে ইন্টারনেট যোগাযোগ সহজ লভ্য হলে শিক্ষা, তথ্য ও গবেষণা পত্রের অনলাইন প্রকাশনা যখন একটি প্রথা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে তখনই ‘ওপেন একসেস’ আন্দোলন ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ‘ওপেন একসেস’ আন্দোলন অনলাইনে বিনামূল্যে তথ্য, গবেষণাপত্র সমূহ ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশের জন্য কাজ করে থাকে। এটি একই সাথে প্রাপ্ত তথ্য এবং গবেষণাপত্র সমূহ ‘অবাধে ব্যবহারের অধিকার’ নিশ্চিত করতেও কাজ করে।

আমরা জানি আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি হচ্ছে দক্ষ তথ্য ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা এবং গবেষণা। আবার একটি গবেষণার সাফল্য নির্ভর করে এটির ফলাফলের সব তথ্য সকলের কাছে ঠিকঠাক ভাবে অতি দ্রুততার সাথে সময়মত পোঁছানোতে। উদাহরণ স্বরূপ ধানের নতুন জাত উদ্ভাবন, নতুন ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা আবিস্কার কিংবা উবার/অ্যামাজনের মতো ই-ব্যবসার ক্ষেত্রে নতুন নতুন পদ্ধতির প্রয়োগের মতোই সৃষ্টিশীল সকল ক্ষেত্রেই এই যথাযথ ও দ্রুততার সাথে জনগণের কাছে পোঁছানোর শর্তটি প্রযোজ্য।

আবার অন্যদিকে একটি দেশে নতুন নতুন আবিস্কার ও গবেষণা কার্যক্রমের চালিকা শক্তি এবং পূর্বশর্ত হলঃ সম্পর্কিত সর্বশেষ গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে দেশের গবেষকদের জ্ঞান অর্জনের পর্যাপ্ত সুবিধা থাকা। কিন্ত প্রথম শ্রেনীর গবেষণাপত্রগুলোর উচ্চমূল্য আমাদের দেশের মতো স্বল্পন্নোত বা মধ্যম আয়ের দেশগুলোর গবেষকদের গবেষণা পত্র সংগ্রহ ও গবেষণার বিষয়ে সর্বশেষ জ্ঞান অর্জনের পথে বড় বাধা। একেতো নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খাওয়া বাংলাদেশের মতো দেশে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ বা বরাদ্দ করা কঠিন; অপর দিকে আর্থিক সঙ্গতির অভাবে দেশের গ্রন্থাগার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও প্রয়োজনীয় গবেষণাপত্র সংগ্রহ করতে পারে না। এরকম পরিস্থিতিতে ওপেন একসেস আন্দোলন বাংলাদেশ তথা স্বল্পন্নোত বা মধ্যম আয়ের দেশগুলোর গবেষণা উন্নয়নে আশীর্বাদ স্বরূপ ভুমিকা রাখতে সক্ষম। কেননা এই প্রক্রিয়ায় একজন গবেষক বিনা খরচে পুর্বে হয়ে যাওয়া সকল ওপেন একসেস গবেষণাপত্রগুলোতে প্রবেশ এবং ব্যবহারের অধিকার পান। ওপেন একসেসের কপিরাইট লাইসেন্স বা স্বত্ব সুরক্ষার আওতায় একজন লেখক, শিল্পী বা গবেষক তাঁর মৌলিক কাজটির ব্যবহারের সীমারেখা নির্ধারণ করে দিতে পারেন। সেটি হতে পারে ব্যবহারকারীদের বাধ্যতামুলক প্রাপ্তি-স্বীকার শর্ত, মৌলিক কাজটির যে কোন রকম পরিবর্তনে নিষেধাজ্ঞা অথবা বানিজ্যিক ব্যাবহারে নিষেধাজ্ঞা প্রদানের মাধ্যমে।

এ প্রসঙ্গে আরও বলে রাখা ভালো- প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের সরকার ও সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই গবেষণার সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক এবং অর্থদাতা। বছরে শত শত মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিভিন্ন গবেষণার পেছনে বরাদ্দ থাকে এবং খরচ হয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে জনগণের মঙ্গলের উদ্দেশ্যে,জনগণেরই করের টাকায় এই গবেষণাগুলো করা হলেও শুধুমাত্র পদ্ধতিগত প্রকাশনার কারণে জনগণকে পুনরায় এই গবেষণাপত্র গুলো পড়তে ও ব্যবহার করতে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হয়। অধিকিন্তু প্রায় সকল ক্ষেত্রেই গবেষক এবং সম্পাদকেরা কাজ করেন প্রকাশিত গবেষণা পত্রের জন্য নামমাত্র পারিশ্রমিকে বা ক্ষেত্র বিশেষে পারিশ্রমিক ছাড়াই। এভাবে প্রচলিত শতাব্দী প্রাচীন গবেষণা/ প্রকাশনা পদ্ধতি জনসম্পৃক্ততা থেকে মুক্তভাবে তথ্য আহরণ, শিক্ষা প্রদান/ গ্রহণ এবং গবেষণার মতো উন্নয়নের পূর্বশর্ত কার্যক্রম গুলোকে আলাদা করে রেখেছে। গবেষণাকে আপামর জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে এবং গবেষণাকে একটি ভীতিকর, জটিল ও দুঃসাধ্য কাজ হিসেবে সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মনের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে। 

আমরা জানি, থিয়োরি অফ রিলেটিভিটির মত জটিল এবং দুর্বোধ্য আবিষ্কার এসেছে পেটেন্ট অফিসের কেরানি আইনস্টাইনের কাছ থেকে। বৈদ্যুতিক বাল্ব কিংবা উড়োজাহাজের মত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার এসেছে একেবারে অপ্রচলিত গবেষক এডিসন কিংবা রাইট ব্রাদার্সের কাছ থেকে। একটি গবেষণার মুল সাফল্য আসে তার ব্যবহার উপযোগীতা এবং জন সম্পৃক্ততার মাধ্যমে। জনসম্পৃক্ততার মতো গবেষণা কার্যক্রমের মৌলিক অপরিহার্যতা এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রসারের মাধ্যমে সহজেই অর্জন করা সম্ভব। এখন ডিজিটাল প্রযুক্তির হাত ধরে তথাকথিত কুলীন ভালো ছাত্র থেকে শুরু করে হরি-ধানের জনক হরিপদ কাপালীর মত প্রান্তিক জনগণেকেও গবেষণা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত ও স্বীকৃতি প্রদান করা সম্ভব। ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে মানবিক উন্নয়ন ও জ্ঞানের উৎকর্ষের জন্য জনগণের বিনিয়োগকৃত অর্থের সুফল দ্রুততার সাথে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য ওপেন একসেস আন্দোলন কাজ করছে। 

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো এবারে বাংলাদেশেও সপ্তাহটি পালিত হবে। এ বছরের ওপেন একসেস সপ্তাহে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য একটি ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। এবারই সর্ব-প্রথম শতাধিক বৈশ্বিক ভাষার মধ্য থেকে বাংলায় দিবসটির প্রতিপাদ্য অনূদিত হয়েছে।“ সমতার জন্য মুক্ত জ্ঞান” বাংলা ভাষাভাষী গবেষক/পাঠকের জন্য নিঃসন্দেহে অতীব তাৎপর্যময়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এবং গবেষণামনস্ক জাতি গঠনে ওপেন একসেস আন্দোলনের অগ্রযাত্রা এদেশে জোরদার করতে হবে; জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করতে এর বিকল্প সত্যিই নেই।

লেখক: এম এম আসাদুল্লাহ ও কনক মনিরুল ইসলাম। ওপেন একসেস বাংলাদেশের কর্মী।

প্রিয় পাঠক, ভিন্নমতে প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু, রচনারীতি ও ভাবনার দায় একান্ত লেখকের। এ বিষয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার কোনোভাবে দায়বদ্ধ নয়। ধন্যবাদ।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর