আপনি পড়ছেন

ভারতে স্বল্প দূরুত্বে যাতায়ত করতে রিকশা এখনও আমাদের অতি উপকারি একটি বাহন। কারণ সহজলভ্য এবং আরামদায়ক। শহরের মোট যানবাহনের ৩০ শতাংশই এই রিকশার দখলে। অথচ এর চালকরা সমাজের সবচেয়ে নিগৃহীত, বঞ্চিত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী। শীত, গ্রীষ্ম অথবা বর্ষা; সব প্রতিকূল পরিবেশেই হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে এরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন। দয়াবশত কখনও কখনও আমরা এদের কিছু টাকা বেশি দিয়ে থাকি। আর এতকাল রিকশাচালকদের জন্য আমাদের সমাজ এতটুকুই করেছে বা করতে পেরেছে।

whose business model has changed the lives of poor rickshaw pullersযার ব্যবসায়িক মডেল বদলে দিয়েছে দরিদ্র রিকশাচালকদের জীবন

কিন্তু এই গণ্ডির বাইরে গিয়ে বঞ্চিত এই শ্রমজীবীদের জন্য আরও বেশি করতে চেয়েছিলেন ভারতের বিহারের ইরফান আলম। রিকশাচালকদের ভাগ্য উন্নয়নে কিশোর বয়সেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘সম্মান ফাউন্ডেশন’। প্রথমে শুধু বিহারে কার্যক্রম চললেও এখন তা সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে।

শুরুটা যেভাবে

এক সাক্ষাৎকারে ইরফান জানান- তখন তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন। এক গ্রীষ্মের দুপুরে রিকশায় বাড়ি ফিরছিলেন। পথিমধ্যে প্রচণ্ড জল তেষ্টা পায়। তিনি রিকশাচালকের কাছে জল চাইলেন। পরক্ষণে তার মনে হলো- ওই চালকের তো এরচেয়ে বেশি জল তেষ্টা পাওয়ার কথা। ইরফান পরের দিন কিছু রিকশাচালককে খুঁজে তাদের হাতে পানির বোতল ধরিয়ে দিলেন।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, তখন আমার ততটুকুই সামর্থ্য ছিল। কিন্তু বড় হয়ে তাদের জন্য কিছু করব এমন সংকল্প করলাম। এরপর আমার এই প্রতিষ্ঠান, আজ যার বয়স ১৫ বছর।

তিনি দেখলেন রিকশাচালকরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও রিকশার মালিক তাদের আয়ের বড় একটি অংশ ভাড়াবাবদ নিয়ে নেয়। এটা দেখে তিনি ভাবলেন- রিকশাচালকদেরও নিজস্ব রিকশা হওয়া উচিত। এতে তাদের দুর্ভোগ অনেকটাই কমবে।

শুরু হলো রিকশাচালকদের অধিকারের জন্য ইরফানের লড়াই। মহাজনরা যদি রিকশার মালিক মালিক হতে পারেন, তাহলে রিকশাচালকরা কেন পারবেন না? প্রশ্ন করেন তিনি। বিষয়টি মাথায় রেখে কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করেন তিনি। তবে রিকশাচালকরা টাকা পরিশোধ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে শুরুতে ব্যাংকগুলো শঙ্কায় ছিলো।

এ বিষয়ে ইরফান বলেন, ‘আমি রিকশাচালকদের ক্ষমতায়ন করতে চেয়েছিলাম। তাই ব্যক্তিগতভাবে টাকা ফেরত দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। অর্থ পরিশোধ করার জন্য, আমরা এই রিকশাগুলোতে (কিস্তির টাকায় কেনা রিকশায়) পণ্য এবং বিজ্ঞাপন বিক্রি শুরু করি।’

এক ডিস্ট্রিবিউটরের সঙ্গে চুক্তি করেন তিনি। তাদের কাছ থেকে মিনারেল ওয়াটার কিনে রিকশায় যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি সেই পানি বিক্রির দায়িত্ব দেন (কমিশন-সহ) রিকশাচালকদের।

এ বিষয়ে ইরফান বলেন, ‘তারা এক মাস ধরে প্রতিদিন তিনটি বোতল বিক্রি করেছে।’

প্রতিবন্ধকতা

এভাবে রিকশাচালকদের নিয়ে কাজ করায় পড়াশুনায় ঠিকমতো মনযোগ দিতে পারছিলেন না ইরফান। বিষয়টি তার বাবা-মায়ের নজর এড়ায়নি। তারা পড়াশুনা শেষ করে পরে এ কাজে নামার কথা বলে। বাবা-মায়ের চাপে তাকে সাময়িক এ কাজ থেকে কিছুটা দূরুত্ব বজায় রাখতে হয়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (আইআইএম)- আহমেদাবাদ থেকে পড়াশুনা শেষ করেছেন তিনি। তবে মাঝখানের সময়টাতেও তার প্রকল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা চালিয়ে গেছেন ইরফান।

ইরফান বলেন, ‘ভারতের দুই হাজার রিকশাচালকের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করি আমি। দেখতে পাই- এখানকার ১০ লাখ রিকশাচালকের মধ্যে ৯০ শতাংশেরই নিজের কোন রিকশা নেই। রিকশা প্রস্তুতকারীরাও রিকশাচলাকদের মতোই বিচ্ছিন্ন। এই বিষয়টি মাথায় রেখে আমি ভবিষ্যৎ বিজনেস মডেল দাঁড় করাই।’

চালকদের সহায়তা করার জন্য ইরফান রিকশায় সঙ্গীত, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র, প্রাথমিক চিকিৎসা কিট, জলখাবার এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে সজ্জিত করার ধারণা উদ্ভাবন করেন। ২০০৬ সালে একটি টেলিভিশন রিয়েলিটি-শোতে আহ্বান পান তিনি। যা তার ব্যবসাকে দ্রুত সম্প্রসারণের পথ তৈরি করে দেয়। কিন্তু ৫০ লাখ টাকার পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন ইরফান। কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘স্পন্সররা কোম্পানির বেশিরভাগ শেয়ারের চেয়েছিল, যা আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল।’

একই বছর উত্তর প্রদেশের নইডা শহরে ৫০ জন রিকশাচালককে নিয়ে একটি পাইলট প্রকল্প পরিচালনা করেন ইরফান। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য বীমা এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মতো প্রণোদনা দেওয়ায় তারা এতে অংশগ্রহণ করতে রাজি হয়। এ সময়ই তিনি ব্যতিক্রমী একটি বিষয় আবিষ্কার করেন। ইরফান বুঝতে পারেন যে এই রিকশাগুলো চলন্ত বিলবোর্ড হিসেবে কাজ করতে পারে, যা বিজ্ঞাপনের দারুণ একটি ক্ষেত্র।

তিনি বিভিন্ন কোম্পানির বিপণন বিভাগে যোগাযোগ শুরু করে দেন। ইরফান বলেন এ জন্য ‘আমি দুই মাসে শতাধিক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেছি।’ অবশেষে এইচটি মিডিয়া এবং বিসলেরি রাজি হয়। এ ছাড়া রিকশাচালকরাও ফলের জুস, পানি ও স্ন্যাকস বিক্রি করতে রাজি হন। চালকরা যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া ছাড়াও যা বিক্রি করত তার উপর কমিশন এবং বিজ্ঞাপনের আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশও পেতো।

ইরফানের ‘সম্মান ফাউন্ডিশন’ ২০০৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে ভারতের পাঁচ লাখ রিকশা এই ফাউন্ডিশনে রেজিস্টেশন করেছে। ব্যবসা সম্প্রসারণে ২০০৭ সালে বোধগয়ার মতো স্থানে রিকশা ব্যবহার করতে বিহার পর্যটনের সঙ্গে জোট করে সম্মান ফাউন্ডিশন। যা রিকশাচালকরা সুন্দরভাবে উপার্জনের পথ তৈরি করে দিয়েছে।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ইরফান। রাজ্য সরকার কর্তৃক প্রদত্ত পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সবচেয়ে বড় চমক হলো ২০১০ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভারত সফরে আসেন তখন কয়েকজন ভারতীয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে ইরফানও ছিলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে ওবামা বলেছিলেন, ‘আপনি আমার চেয়ে কঠিন কাজ করেছেন।’ এ ছাড়াও ওয়াল্ড ব্যাংক ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড, টেড ইন্ডিয়ান ফিলোশিপ, নির্বাচিত হয়েছিলেন অশোক ফিলোশিপেও। তাছাড়া সিএনবিসি’র ইয়ং তুর্ক এবং সিএএন’র ইয়ং ইন্ডিয়ান অ্যাওয়ার্ড পান তিনি।

প্রায় পাঁচ লাখ রিকশাচালককে অর্থ ও খাবার সহায়তা দিচ্ছে তার সম্মান ফাউন্ডেশন। এ ছাড়া অনেক তরুণকে উদ্যোক্তা ও জাতি গঠনের জন্য পরামর্শ দিয়ে আসছেন ইরফান। অনেক প্রশংসা কুঁড়ানো ছাড়াও, ইরফানের সাফল্য এবং তার উদ্ভাবনী ব্যবসায়িক মডেল কেরালা সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে ‘তিন চাকার বিপ্লব’ শিরোনামে স্থান পেয়েছে। তবে সেখানেই থেমে নেই বরং ইরফানের তিন চাকার সফল বিপ্লব এখনো অব্যাহত রয়েছে।

দিলশাদ নূর, ফ্রিল্যান্স কন্ট্রিবিউটর

প্রিয় পাঠক, ভিন্নমতে প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু, রচনারীতি ও ভাবনার দায় একান্ত লেখকের। এ বিষয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার কোনোভাবে দায়বদ্ধ নয়। ধন্যবাদ।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর