আপনি পড়ছেন

বাংলাদেশের এক ক্ষণজন্মা সন্তানকে শ্রদ্ধা জানাতে নিজের ব্যস্ত সফরসূচি থেকে সময় বের করে কোলকাতার ডোভার লেনের একটি বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন জাপানের সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। যার স্মৃতি ছুঁতে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন, সে মানুষটিকে সস্মাননা দিয়েছিলেন তার পিতামহ ও সাবেক জাপানি প্রধানমন্ত্রী নোবুসুকি কিশি।

abe kol twsd কোলকাতায় রাধা বিনোদের পুত্র প্রশান্ত পালের সঙ্গে শিনজো আবে

গল্পের শুরু কুষ্টিয়া জেলায়। ১৮৮৬ সালে কুষ্টিয়ার সলিমপুরের হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয় এক পুত্র সন্তান। কয়েক বছর পরই পিতৃহারা হন তিনি। নিজের ও শিশু সন্তানের মুখে খাবার জোগাতে চুয়াডাঙ্গার এক ধনী পরিবারে গৃহ পরিচারিকার কাজ নেন ছেলেটির মা।

তিন বেলা খাবার ও আশ্রয়ের বিনিময়ে গেরস্থালি সামলাতেন মা, আর ছেলেটি করত রাখালের কাজ। গোয়ালঘর থেকে গরু বের করে মাঠে নিয়ে যেত ঘাষ খাওয়াতে। রোদেলা দুপুরে গরুগুলো মাঠে চরে বেড়াত, ছেলেটি তখন আশ্রয় নিত মাঠের এক প্রান্তে প্রাইমারি স্কুলের ছাউনিতে। ধনী পরিবারের ছেলেরা কি করে সেটা দেখতে মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে ক্লাসরুমে উঁকি দিত। এভাবেই চলছিল।

একদিন স্কুলে ইন্সপেক্টর আসেন। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার অবস্থা যাচাইয়ে তিনি ক্লাসরুমে ঢুকেন। ক্লাসের কোনো শিক্ষার্থী বিলেতি সাহেবের ইন্সপেক্টরের প্রশ্নের জবাব দিতে পারছিল না। এমন সময় জানালার বাইরে দাঁড়ানো রাখাল ছেলটি বলে ওঠে, ‘আমি এর সব উত্তর পারি।’ ইন্সপেক্টর তখন ছেলেটিকে ভেতরে আসতে বলেন।

রাখাল ছেলেটিকে একে একে নানা প্রশ্ন করা হয়। সব প্রশ্নেরই সঠিক জবাব দেয় সে। বিষ্মিত সাহেব তখন শিক্ষা বিভাগের নির্দেশ দেন, যাতে ছেলেটির আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। একইসঙ্গে তাকে বৃত্তি প্রদানের নির্দেশ দেন তিনি। এই হলেন রাধা বিনোদ পাল।

রাধা বিনোদের কথা বললে খোদ কুষ্টিয়ার অনেকেও হয়তো চিনবেন না। কিন্তু জাপান সরকার ও দেশটির রাজপরিবার তাকে ঠিকই মনে রেখেছে। এর কারণ হলো, জাপানের সবচেয়ে খারাপ সময়টিতে কিন্তু ওই দেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বলে জাপানিরা বিশ্বাস করে।

ছেলেবেলায় স্কুলের জানালায় উঁকি দিয়ে শোনা পাঠ থেকে বিলেতি সাহেবকে চমকে দিয়ে পড়াশোনা শুরু। এরপর স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে রাধা বিনোদ ভর্তি হন কোলকাতার সেরা প্রেসিডেন্সি কলেজে। তারপর ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির আওতাধীন ল কলেজে পড়ার সময় গণিতের সঙ্গে সাংবিধানিক আইনের এক অদ্ভূত সাযুজ্য তার মাথায় আসে। পরবর্তী জীবনে গণিতের নির্মোহ যুক্তিকে আইনি বিতর্কে প্রয়োগ করে নিজেকে স্মরণীয় করে রাখেন তিনি।

শিক্ষাজীবন শেষে আইন পেশায় অবর্তীর্ণ হন রাধা বিনোদ। ওই যে গাণিতিক চিন্তার ঝোঁক, সে জন্য কারও সঙ্গে কাজ করতেই তার বাধত না। অল্পদিনেই ব্রিটিশ প্রশাসনের নজর কাড়তে সমর্থ হন তিনি। ১৯২২ সালে ইন্ডিয়ান ইনকাম ট্যাক্স্রের খসড়া প্রণয়নে তাকে নিয়োগ দেয় ব্রিটিশ প্রশাসন। ১৯২৭ সালে তাকে সরকারের আইন উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়।

সেকালের বেশিরভাগ আইনজ্ঞের মতো রাধা বিনোদেরও একাডেমিক সংযোগ ছিল। ১৯২৩ সাল থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত ক্যালকাটা ল কলেজে শিক্ষাদান করেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৪৪ সালে তিনি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন। তবে তার আগে ১৯৪১ সালে নেতাজি সুভাষ বসু যখন বন্দীদশা থেকে ব্রিটিশদের চোখ ফাঁকি দিয়ে জাপানে যান, রাধা বিনোদ তখন হাইকোর্টের জজ হিসেবে নিয়োগ পান। আরও পরের দিকে সুভাষ বসুকে সহযোগিতা জোগানে জেনারেলদের বিচারেও পৌরহিত্যের আমন্ত্রণ পান তিনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর মিত্রশক্তির দেশগুলো জাপানের ইম্পেরিয়াল আর্মির অফিসার ও প্রধানমন্ত্রী তোজোর মতো রাজনীতিকদের বিচারের জন্য ন্যুরেমবার্গের আদলে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রয়োজন বোধ করেন। ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ফার ইস্ট (আইএমটিএফই) নামের এ ট্রাইব্যুনালের বেঞ্চ গঠনে জাপানি সম্প্রসারণবাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো, যেমন রাশিয়া, চীন, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ভারত থেকে বিচারক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে পশ্চিমা জোট।

টোকিও ট্রায়াল হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এ ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেব রাধা বিনোদ পালকে মনোনীত করে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট। ব্রিটিশ কর্মকর্তারা কি ঘুণাক্ষরেও জানতেন এ বাঙালি ভদ্রলোকের তীক্ষ্ণ যুক্তি তাদের এত পরিশ্রম ও আয়োজনের বিচারযজ্ঞকে কি নিদারুণ প্রশ্নের মুখে নিপতিত করবে!

আদতে রাধা বিনোদকে যখন বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়, ততদিনে টোকিও ট্রায়াল শুরু হয়ে গেছে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য যা-ই হোক, স্রেফ নাম-কা-ওয়াস্তে শোপিস হিসেবে ট্রাইব্যুনালের অংশ হবেন না তিনি। একজন বিচারকের যে কাজ, ঠিক তা-ই করবেন তিনি। নির্মোহ দৃষ্টিতে পুরো যুদ্ধ ও পূর্বাপর বিবেচনা করে নিজের সিদ্ধান্ত নিবেন তিনি।

টোকিও ট্রায়াল শুরু হয় ১৯৪৬ সালের ২৯ এপ্রিল। ৯৩২-দিনব্যাপী বিচারকাজ শেষে ১৯৪৮ সালের ১২ই নভেম্বর অস্ট্রেলিয়ার বিচারক উইলিয়াম ওয়েব জনাকীর্ণ আদালতে রায় পাঠ শুরু করেন। ট্রাইব্যুনালের চুড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয় ১৯৪৮ সালের ৪-১২ ডিসেম্বর।

রায় পাঠের সময় উইলিয়াম ওয়েব রায়ের সঙ্গে একজন বিচারকের ভিন্নমতের কথা বললেও ওই বিচারকের অভিমত ও মন্তব্য চেপে যান। এমনকি সে সময় জাপানের হর্তাকর্তা মার্কিন জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থার রায়ের ভিন্নমতের অংশটুকু (ডিসেন্টিং নোট) প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। বলাবাহুল্য, ডিসেন্টিং নোটটি ছিল বিচারক রাধা বিনোদ পালের।

রাধা বিনোদ পাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে সে সময়কার আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে নারাজ ছিলেন। তিনি লেখেন, ‘পার্ল হারবারের ঘটনার সময় মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট জাপান সরকারকে যে ভাষায় বার্তা পাঠিয়েছিল, তেমন বার্তা পাঠালে আজকের মোনাকো ও লুক্সেমবার্গের মতো রাজ্যও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াত।’

তিনি আরও লেখেন, ‘আইনের প্রশ্নগুলো এমন কোনও বুদ্ধিবৃত্তিক কোয়ারেন্টিনে মিমাংসা হয় না যেখানে কেবলমাত্র আইনি বিধান ও স্থানীয় ইতিহাস বিবেচনায় রেখে অন্য সবকিছুকে জোরপূর্বক বাদ দেওয়া হয়। যে পৃথিবীতে বিরোধের সূচনা হচ্ছে আমরা তার বিষয়ে অজ্ঞ থাকতে পারি না।’

যুদ্ধে পরাজিত দেশগুলোর কোনও বিচারককে ট্রাইব্যুনালে না রাখায় আপত্তি জানান রাধা বিনোদ। পশ্চিমা উপনিবেশবাদ এবং আমেরিকার পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন কিনা, তা নিয়ে তদন্ত না হওয়ায় তিনি আপত্তি জানান। টোকিও ট্রায়ালকে ‘প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থে আইনি প্রক্রিয়ার লজ্জাজনক নিয়োগ’ অভিহিত করে তিনি লেখেন, বিজয়ী দেশগুলোর ‘দেখে নেওয়ার সাধ পূরণ ছাড়া’ এ ট্রাইব্যুনাল আর কিছু দিতে পারেনি।’ ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের কনফারেন্সে তার ক্ষুরধার যুক্তিতে সহমত হয়ে পৃথক পৃথক ডিসেন্টিং নোট যোগ করেছিলেন ফরাসি ও ডাচ বিচারকরা।

১৯৫২ সালে জাপানে মার্কিন দখলের অবসান হলে টোকিও ট্রাইব্যুনালের ডিসেন্টিং নোট প্রকাশের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়। ১ হাজার ২৩৫ পৃষ্ঠার ওই নোট পড়ে সবাই বুঝতে পারেন কি গভীর প্রজ্ঞা আর নির্মোহ দৃষ্টিতে পুরো যুদ্ধকে বিবেচনায় নিয়ে নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন রাধা বিনোদ পাল। জাপানের মানুষেরা উপলদ্ধি করেন উপনিবেশের মধ্যে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা এক বিচারক কী গভীর অন্তদৃষ্টি নিয়ে একটি গর্বিত ও পরাজিত জাতির মর্যাদা ও আত্মসম্মান অনুধাবন করেছিলেন।

জাপানের বিদ্বজ্জনের মনে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছেন রাধা বিনোদ পাল। তাকে নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন জাপানের গবেষকরা। হোক্কাইডো ইউনিভার্সিটির পাবলিক পলিসির অধ্যাপক তাকেশি নাকাজিমা তার ২০০৭ সালে প্রকাশিত বই ‘জাজ পাল’-এ লিখেছেন, সব ঔপনিবেশিক শক্তিকে এক দল হিসেবে বিবেচনা করতেন তিনি। এ বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল স্থিত ও অনড়।

১৯৫৮-৫৯ সময়কালে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের সদস্য ছিলেন রাধা বিনোদ পাল। ১৯৫৯ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্ম বিভূষণ সম্মাননা দেয়। ১৯৬৬ সালে জাপান সফরে গেলে সম্রাট হিরোহিতো তাকে ‘ফার্স্ট ক্লাস অর্ডার অব দ্য স্যাক্রেড ট্রেজার’ সম্মাননায় ভূষিত করেন। ১৯৬৭ সালে রাধা বিনোদের মৃত্যু হলে টোকিও ইম্পেরিয়াল প্যালেসের অদূরে অবস্থিত ইয়াসুকুনি সমাধিক্ষেত্রে তার সম্মানে একটি স্মৃতিফলক উন্মোচন করা হয়।

জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নোবুসুকি কিশির সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল রাধা বিনোদ পালের। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হওয়ায় বিষয়টি পারিবারিক সূত্রে জানতে পেরেছিলেন নোবুসুকির দৌহিত্র শিনজো আবে। তিনি জেনেছিলেন, জাপানের ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ ও দুর্বল সময়টিতে কোন মানুষটি তাদের হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ও কথা বলেছিলেন। এজন্যই প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ভারত সফরকালে ২০০৭ সালে তিনি দিল্লিতে ব্যস্ত সফরসূচি থেকে সময় বের করে ছুটে গিয়েছিলেন কোলকাতার ডোভার লেনে।

রাধা বিনোদ পাল জীবিত ছিলেন না। তার ছেলে প্রশান্ত পালেরও বয়স তখন ৮১। বয়সের ভারে ন্যুব্জ মানুষটি তখন কোথাও যেতেন না, কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেও ভালো লাগত না। কিন্তু জাপানি দূতাবাসের কর্মকর্তারা বাড়িতে যে অতিথির আগমনের আগাম বার্তা দিয়েছে, তার তাগিদটি তিনি বুঝতে পারেন। এজন্যই অতিথির জন্য একটি উপহার তিনি প্রস্তুত রেখেছিলেন।

শিনজো আবে প্রশান্ত পালকে বলেন, ‘আপনার বাবাকে এখনও জাপানের অনেক মানুষ শ্রদ্ধা করেন।’ প্রশান্ত পাল শিনজো আবের কুশল জানতে চান এবং সফরের জন্য তাকে ধন্যবাদ জানান। একইসঙ্গে অতিথিকে তিনি একটি ছবি উপহার দেন। ছবিতে রাধা বিনোদ পাল ও নোবুসুকি কিশি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। উপহার পেয়ে খুব খুশি হন শিনজো আবে। প্রশান্ত পালকে তিনি পাল্টা ধন্যবাদ জানান।

সেবারের সফরে ভারতের পার্লামেন্টে বক্তৃতাকালে শিনজো আবে দুই দেশের মধ্যকার গভীর সম্পর্ক ও হৃদ্যতার কথা বলতে গিয়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করেন বাঙালির কথা, জাপানের সঙ্গে কয়েকজন খ্যাতিমান বাঙালির সংযোগের কথা।

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.