দাবদাহে পুড়ছে পৃথিবী, হাঁসফাঁস করছে মানুষ

গরমে অতিষ্ঠ জীবন। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, এশিয়া- পৃথিবীর বেশিরভাগ জায়গাজুড়ে একই অবস্থা। তীব্র দাবদাহের কারণে দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে ফ্রান্স, পর্তুগাল ও স্পেনে। একের পর এক শহরে তাপমাত্রার নতুন রেকর্ডে দিশেহারা মানুষ।

তীব্র গরমে স্পেনের কার্তেয়া শহরে পথচারীদের জন্য শামিয়ানা টাঙিয়েছেন স্থানীয় অধিবাসীরা

যুক্তরাজ্যের কয়েক ডজন শহরে গতকাল তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। লন্ডনের হিথ্রোতে দিনের তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। এর আগে লন্ডনে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ছিল ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ৩৮ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। লিঙ্কনশায়ারের কনিংসবিতে থার্মোমিটারের পারদ চড়েছে ৪০ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। আরও অন্তত ৩৩টি শহরে ২০১৯ সালের রেকর্ড ভেঙেছে গতকালের তাপমাত্রা।

ওয়েলসে গতকালের তাপমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এর আগে সেখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ১৯৯০ সালে, ৩৫ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জার্সি শহরের জন্যও মঙ্গলবার ছিল ইতিহাসের উষ্ণতম দিন। গতকালে সেখানে তাপমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ১৮৯৪ সালে তাপমাত্রা রেকর্ড শুরুর পর থেকে সর্বোচ্চ।

আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনেও গতকাল ছিল রেকর্ড সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। ডাবলিনের ফিনিক্স পার্ক এলাকায় তাপমাত্রা ছিল ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ১৮৮৭ সালে রেকর্ড শুরুর পর থেকে সর্বোচ্চ। স্কটল্যান্ডের আবিওনে তাপমাত্রা ছিল ৩০ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এর আগে ওই শহরে সর্বোচ্চ ৩৩ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল ২০১৮ সালে।

চরম ভাবাপন্ন তাপমাত্রা রেকর্ডকারী সংগঠন এক্সট্রিম টেম্পসের তথ্যে দেখা যায়, ফ্রান্সের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রায় একশটি এলাকায় গতকাল তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। ব্রেস্ত শহরের কথাই বলা যাক। মঙ্গলবার শহরটিতে তাপমাত্রা ছিল ৩৯ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে সেখানে সর্বোচ্চ ৩৫ দশমিক ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল ১৯৪৯ সালে।

পশ্চিম ইউরোপের কয়েক কোটি মানুষের জন্য গতকালের রাতটিও ছিল স্মরণকালের উষ্ণতম। রাত্রিকালীন তাপমাত্রার এই তারতম্যে অনভ্যস্ত অগনন মানুষ কাটিয়েছে বিনিদ্র সময়।

বিএনও নিউজ জানিয়েছে, চলতি দাবদাহে কমপক্ষে ১ হাজার ৭৫০ জনের প্রাণহানি হয়েছে আইবেরিয়ান উপদ্বীপে। এরমধ্যে সোমবার পর্যন্ত পর্তুগালে মারা গেছেন ৬৫৯ জন, স্পেনে ৩৬৮ জন।

স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে শুক্রবার বিকেলে কর্মরত অবস্থায় মারা যাওয়া এক ব্যক্তির দেহের তাপমাত্রা মেপে জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ৪১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস অর্থাৎ ১০৬ দশমিক ৮৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা বহন করছিলেন তিনি, যেখানে মানুষের দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইটের আশেপাশে থাকে।

অসহনীয় গরমে ভোগান্তি, অসুস্থতা ও প্রাণহানিই শেষ কথা নয়। অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে পশ্চিম ইউরোপের কিছু দেশে এরইমধ্যে খরা দেখা দিয়েছে। সমুদ্রবক্ষের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসের ঝুঁকিতে পড়বে অনেক দেশ। তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই চক্রের জেরে খরা ও বন্যায় ফসলহানি হবে, আরও দুর্ভোগে পড়বে মানুষ।

নাসা আর্থ অবজারভেটরি জানিয়েছে, পর্তুগালের লেইরিয়া শহরে দিনের তাপমাত্রা এরইমধ্যে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে। দাবানলের কারণে রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে পর্তুগালের অর্ধেকের বেশি এলাকায়। অন্তত ১৪টি সক্রিয় দাবানলে এরইমধ্যে সেদেশের ৩ হাজার হেক্টর জমির ফসল ও অন্যান্য উদ্ভিদ পুড়ে গেছে। পর্তুগালের কাছের দেশ স্পেনে দাবানলে পুড়েছে কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি।

রেকর্ড তাপমাত্রার কারণে ইতালির মার্মালোদা হিমবাহের একাংশ গলে পড়ায় কিছুদিন আগে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। যুক্তরাজ্যে তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে, ৪৪ ডিগ্রি পর্যন্ত যেতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দপ্তর।

উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়ায় দাবদাহে পুড়ে গেছে দিগন্তবিস্তৃত ফসলের ক্ষেত। রাজধানী তিউনিসে গত বুধবারের তাপমাত্রা ছিল ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ৪০ বছরে সর্বোচ্চ।

ইরানের কোনে কোনো শহরে তাপমাত্রা জুন মাসেই ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। চলতি মাসে তাপমাত্রা কিছুটা কমলেও সহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেনি এখনও। রাজধানী তেহরানে মঙ্গলবারের তাপমাত্রা ছিল ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা সচরাচর আরও কম থাকে। প্রতিবেশি দেশ ইরাকের রাজধানী বাগদাদে গতকাল মঙ্গলবারের তাপমাত্রা ছিল ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

চীনের সাংহাই শহরে গত মঙ্গলবারের তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ১৮৭৩ সালে তাপমাত্রা রেকর্ড শুরুর পর থেকে সর্বোচ্চ। সাংহাইয়ে চলতি সপ্তাহে তাপমাত্রা খানিকটা কমলেও রাজধানী বেইজিংয়ে মঙ্গলবারও ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি উত্তাপ বিরাজ করছিল।

চলতি গ্রীষ্মে উপর্যুপরি তিন দফা দাবদাহে চীনের অনেক শহরেই রাস্তার পিচ গলে দুর্ঘটনা ঘটেছে। কোথাও কোথাও ফেটে গেছে ঘরের ছাদের ও দেয়ালের টালি। রাশিয়ায় তীব্র গরমে রেল লাইনের স্লিপার বেঁকে অন্তত একটি মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হবার খবর পাওয়া গেছে।

গতকালের অত্যধিক তাপমাত্রায় রেল লাইন বেঁকে যাওয়ায় দুর্ঘটনা এড়াতে আজ বুধবার রেল ভ্রমণ না করতে যাত্রীদের পরামর্শ দিয়েছে ব্রিটেনের নেটওয়ার্ক রেল।