পশ্চিমাদের হটিয়ে আফ্রিকায় প্রভাব বাড়াচ্ছে রাশিয়া

ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বৈরথে যখন বিশ্ববাসীর দৃষ্টি নিবদ্ধ, সে সময় একের পর এক আফ্রিকান দেশ থেকে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের হটিয়ে নিজের জায়গা তৈরি করে নিচ্ছে রাশিয়া। মস্কোর সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধির জেরে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের পর এবার মালি থেকেও নিজেদের সৈন্য সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো ফ্রান্স।

রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনী ছাড়াও প্যারামিলিটারি ওয়াগনার গ্রুপ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছে

গত বছরের ৫ আগস্ট আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে যুক্তরাষ্ট্র। এর ঠিক এক বছরের মাথায় সাবেক উপনিবেশ মালি থেকে নিজেদের সৈন্য প্রত্যাহার করেছে ফ্রান্স। দুটি ঘটনার মধ্যকার মিল চোখে পড়ার মতো। যুক্তরাষ্ট্র যে কারণ দেখিয়ে ২০ বছর আগে আফগানিস্তান আক্রমণ ও দখল করেছিল, ঠিক একই কারণ দেখিয়ে ৯ বছর আগে মালিতে সৈন্য পাঠায় ফ্রান্স।

২০১৩ সালে সন্ত্রাসবাদ দমনের কথা বলে মালিতে সৈন্য পাঠায় ফ্রান্স। ২০১৯ সালে মালিতে অভ্যুত্থানের পর নতুন সরকারের সঙ্গে একটি সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে রাশিয়া। এরপর তিন বছর না পেরোতেই মালি থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো ফ্রান্স। ফরাসি সৈন্যরা বিদায়ের পরদিনই রাশিয়ার সঙ্গে আরেকটি সামরিক চুক্তির ঘোষণা দেয় মালি।

সবশেষ, গত সোমবার ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সহযোগিতার অভিযোগ তুলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছে মালি। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহি দিউপ বলেছেন, আমাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে যে ফ্রান্স স্পষ্টত মালির আকাশসীমা লঙ্ঘন করে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করছে এবং সাহেল এলাকার সন্ত্রাসী গোষ্টীগুলোকে সে সব তথ্য সরবরাহ করছে। ফরাসি সৈন্যরা আকাশ থেকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিতরণ করছে।

এর আগে একই কায়দায় মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র (সিএআর) থেকে ফ্রান্সকে পাততাড়ি গুটাতে বাধ্য করে রাশিয়া। রুশ ধনকুবের দিমিত্রি প্রিগোজিনের মালিকানাধীন প্যারামিলিটারি বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের দাপটে একপর্যায়ে ওই দেশ ছেড়ে যায় ফরাসি বাহিনী।

মালি ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র শুধু নয়, আফ্রিকার অন্তত এক ডজন দেশের সঙ্গে রাশিয়ার সামরিক বন্ধন ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো ফ্রান্সের এক গুচ্ছ সাবেক উপনিবেশ। ফরাসি ভাষাভাষী এসব দেশের সঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফ্রান্সের সম্পর্কের ক্রমশ অবনতি হচ্ছে।

চলতি সপ্তাহে মস্কোর উপকন্ঠে কুবিঙ্কায় অনুষ্ঠিত আর্মি গেমসে অংশ নিয়েছে আলজেরিয়া, কঙ্গো, সুদান, নাইজেরিয়া, মিশর, জিম্বাবুয়ে, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, মালিসহ আফ্রিকার বেশকিছু দেশ। আর্মি গেমসের সমান্তরালে অনুষ্ঠিত মস্কো কনফারেন্স অন ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি শীর্ষক সামরিক সংলাপে রুশ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের মতবিনিময়ে অংশ নিয়েছেন এসব দেশের কর্মকর্তারা।

সামরিক সংলাপের পাশাপাশি আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে অস্ত্র বিক্রির চুক্তি সম্পন্ন করেছে রাশিয়া। নাইজার, সুদানের কাছে অত্যাধুনিক সামরিক হেলকপ্টার বিক্রি করছে দেশটি। আফ্রিকার জ্বালানি পরাশক্তি হিসেবে আলজেরিয়ায় স্থানীয় বাহিনীর সঙ্গে আগামী মাসে যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নেবে রুশ সৈন্যরা। রাশিয়া থেকে জঙ্গিবিমান, অ্যান্টি-শিপ মিসাইল, ট্রান্সপোর্ট হেলিকপ্টারসহ বেশকিছু যুদ্ধাস্ত্র কিনছে আলজেরিয়া।

সামরিক সহযোগিতার পাশাপাশি আফ্রিকার দেশগুলোয় মস্কোর কূটনৈতিক প্রভাবও ক্রমশ বাড়ছে। গত মাসে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সফরের একদিনের মাথায় ইউক্রেনের সঙ্গে গম কেনার চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেয় মিশর। নীল নদের তীরবর্তী দেশটিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু করেছে রাশিয়া।

কুবিঙ্কায় আর্মি ২০২২ ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি অ্যান্ড টেকনিক্যাল ফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকাসহ সব অঞ্চলে ঐতিহাসিকভাবে জোরালো, বন্ধুত্বপূর্ণ ও আস্থার সম্পর্কগুলো রাশিয়া প্রকৃত অর্থে উপভোগ করে। আমরা এসব দেশে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সরবরাহ করতে চাই।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে আফ্রিকার দেশগুলোর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দূরত্ব দিনকে দিন বাড়ছে। এ দূরত্বের পূর্ণ সদ্ব্যবহারে তৎপর রয়েছে রাশিয়া। পশ্চিমা দেশগুলোর ক্ষীয়মান প্রভাবের পাশাপাশি রাশিয়া বাড়তে থাকা উদ্যম আগামী দিনগুলোতে আফ্রিকাকে ভূরাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দ্বৈরথের নতুন দিগন্তে রূপান্তর করবে।