মাহাথিরকে হটিয়ে, সৌদির কথা বলেও পার পেলেন না নাজিব রাজাক

শেষরক্ষা হলো না। জেলে যেতে হচ্ছে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাককে। দুর্নীতির অভিযোগে নিম্ন আদালতের দেওয়া দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে নাজিবের আপিল খারিজ করে দিয়েছেন মালয়েশিয়ার সুপ্রিম কোর্ট। সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আদালত থেকে আজ বিকেলে কুয়ালালামপুরের অদূরে কাজাং জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

দুর্নীতির দায়ে সাজা এড়াতে পারলেন না মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক

বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম বড় আর্থিক দুর্নীতির মামলায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন মালয়েশিয়ার সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী। ওয়ান মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বারহাদ বা ওয়ান এমডিবি নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পাওয়া এ মামলায় আত্মসাৎ হয়েছে প্রায় ৪৫০ কোটি ডলার।

মালয়েশিয়ার সার্বভৌম বিনিয়োগ তহবিল থেকে লুটপাট করা অর্থে নাজিবের স্ত্রী রোজমাহ মনসুরের পুত্র রেজা আজিজ হলিউডে লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওকে দিয়ে উলফ অব ওয়াল স্ট্রিট নামে ছবি বানান। রেজা আজিজ ও তার বন্ধু ঝৌ লৌ বিলাশবহুল ইয়ট, প্রাইভেট জেট, পাবলো পিকাসোর বহুমূল্য পেইন্টিংসহ নানা অ্যান্টিক কিনেন। অন্যরা কেনেন হোটেল, রিসর্ট, রত্নালঙ্কার আরও অনেক কিছু।

ওয়ান এমডিবি থেকে নাজিবের নিজের ব্যাংক হিসাবেও সরানো হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এর মধ্যে ওয়ান এমডিবির সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআরসি ইন্টারন্যাশনাল থেকে নিজের ব্যক্তিগত হিসাবে ৪ কোটি ৫০ লাখ ডলারের একটি অ্যাকাউন্ট ট্রান্সফারের সত্যতা আড়াল করতে নাজিব সৌদি রাজপরিবারের নামও ভাঙিয়েছেন।

নির্বাচন পরিচালনার ব্যয় হিসেবে সৌদি রাজপরিবার ওই অর্থ দিয়েছে বলে দাবি করেন নাজিব। সৌদি রাজপরিবার বিষয়টি অস্বীকার করে। মালয়েশিয়ার আদালতে নাজিব নিজেও তার দাবির স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি। অবশেষে ওই ৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার আত্মসাতের অপরাধে প্রাপ্ত সাজা মাথায় নিয়েই তাকে ১২ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হচ্ছে। পাশাপাশি দিতে হবে ৪ কোটি ৬৫ লাখ ডলার জরিমানা।

২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হবার পরপর পার্লামেন্টকে পাশ কাটিয়ে ওয়ান এমডিবি নামে সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় ফান্ড গঠন করেন নাজিব রাজাক। শুরু থেকেই তিনি, তার স্ত্রীর আগের সংসারের সদস্য ও ঘনিষ্টজনরা ওই তহবিল থেকে অর্থ লোপাট করতে থাকেন। লুটপাটের এ মচ্ছবে যোগ দেন নাজিবের কিছু সহযোগী, আমেরিকা, সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুরের কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও ব্যাংকার।

ওয়ান এমডিবির তহবিল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল ওয়াল স্ট্রিটের নামজাদা ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস। ওয়ান এমডিবির হয়ে বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ ও অর্থ স্থানান্তওে বড় ভূমিকা রাখেন ঝৌ লৌ নামে পরিচিত এক রহস্যজনক বিনিয়োগকারী যিনি রেজা আজিজের ঘনিষ্ট এবং ওয়ান এমডিবি নিয়ে তদন্তু শুরুর পর থেকে খুব সম্ভবত চীনে পালিয়ে আছেন।

শুরুতে মালয়েশিয়া সরকারের এক হাজার কোটি ডলার তহবিল নিয়ে যাত্রা করা ওয়ান এমডিবি ২০১৫ সালের শুরুতেই ১ হাজার ১৭৩ কোটি ডলার দেনার মুখে পড়ে। এরপর খোঁজ নিয়ে দেখা যায় তহবিলটি প্রায় শূন্য করে রেখেছে সংশ্লিষ্টরা। চাঞ্চল্যকর এ উদঘাটনে নড়েচড়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের বিচার বিভাগ। চাকরি হারান কয়েকজন নামী ব্যাংকার।

মালয়েশিয়ার পার্লামেন্টে তদন্তের দাবি উঠলে উপ-প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন প্রধানমন্ত্রী নাজিবকে এ নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার আহ্বান জানান। নাজিব তখন উপ-প্রধানমন্ত্রীসহ পাঁচ মন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল গনি পাটালি তদন্তের উদ্যোগ নিলে রাতারাতি তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করলেও দেশের বাইরে ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ নাজিবের ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ডসহ কমপক্ষে ছয়টি দেশে ওয়ান এমডিবি থেকে পাচারকৃত অর্থের সন্ধানে তদন্ত শুরু হয়। মার্কিন বিচার বিভাগ ওয়ান এমডিবিকে ‘বিশ্বের ইতিহাসে স্বজনপ্রীতি ও গোষ্ঠবদ্ধ লুটের সবচেয়ে বড় ঘটনা’ বলে অভিহিত করে। তদন্তে বেরিয়ে আসে আর্থিক অসততা, যৌন অসদাচরণসহ নাজিবের চরিত্রের স্খলনের আরও নানা কাহিনী।

ওয়ান এমডিবিকে ঘিরে নাজিবের বিরুদ্ধে সৃষ্ট জনরোষের সমর্থনে ও তদন্তের দাবিতে মাঠে নামেন মালয়েশিয়ার অশীতিপর রাজনীতিক মাহাথির মোহাম্মদ। তার নেতৃত্বে ২০১৮ সালে নাজিবকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ২০২০ সালে মালয়েশিয়ার আদালত নাজিবকে অর্থ আত্মসাৎ, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, বিচারে বাধাদানসহ আটটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেন। নাজিব ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন।

এরইমধ্যে নাজিব আবার নানা ষড়যন্ত্র আর কূটচালে মাহাথিরের নেতৃত্বাধীন জোটে ভাঙন ধরিয়ে নিজেকে ক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে আসেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। প্রধান বিচারপতি টেংকু মাইমুন তুয়ান মাতের নেতৃত্বে মালয়েশিয়ার সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ আজ নিম্ন আদালতের দেওয়া সাজা বহাল রেখে সর্বসম্মত রায় দিয়েছেন।