আপনি পড়ছেন

ফেসবুকের হোমপেজ ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ চোখ আটকে গেল একটি ছবিতে। দেখলাম লিকলিকে গড়নের এক বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের জুতার ফিতা বেঁধে দিচ্ছেন ইংলিশ অধিনায়ক অ্যালিস্টার কুক। ক্রিকেটের জন্মস্থান ইংল্যান্ডের অধিনায়ক, দেশটির হয়ে টেস্টে দশ হাজার রান করা এক মাত্র ক্রিকেটার এই কুকের চেহারায় নেই কোন অহমিকা, যেনো একমনে ফিতাই বেঁধে দিচ্ছেন। প্রশ্ন জাগলো, আসলে তিনি কি ফিতা বাঁধছেন নাকি বাংলাদেশকে ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধছেন। হয়তো ভালবাসার বাঁধনেই। এজন্যই বোধ হয় ইংলিশরা অ্যালিস্টার কুককে সম্মান জানিয়ে স্যার বলে থাকেন।

alastair cook with miraz and dhoni clash with mustafizur rahman

ছবিটি আবার ভালো করে দেখলাম। এবার বোঝার চেষ্টা করলাম ছবির ব্যাটসম্যানটি কে? হ্যাঁ ব্যাটসম্যানটি ইংলিশদের ঘাতক সদ্যই জাতীয় দলে নাম লেখানো মেহেদি হাসান মিরাজ। শক্তিশালী ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপকে এই ১৯ বছরের টাইগার একাই ধসিয়ে দিয়েছেন। সিরিজে ১৯টি উইকেট নিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছেন ক্রিকেট ইতিহাসের ১২৯ বছরের রেকর্ড।

alastair cook with miraz

এত সুন্দর একটা ছবি দেখার পর ভাবনাগুলো হয়তো এখানে থেমে থাকলেই ভালো হতো। কিন্তু স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠলো ২০১৫ সালের ১৮ জুনের কথা। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে প্রথম ওয়ানডেতে মুখোমুখি ভারত-বাংলাদেশ। প্রথমে ব্যাট করা বাংলাদেশের ৩০৭ রানে জবাবে ধুঁকছে ভারত। ভারতের ইনিংসের ২৫তম ওভারের দ্বিতীয় বলটি করছিলেন মুস্তাফিজ আর অপর প্রান্তে ব্যাট করছিলেন ভারতের ক্যাপ্টেন 'কুল' খ্যাত ধোনী। মুস্তাফিজের ওই ওভারের দ্বিতীয় বলটি কোনরকম ঠেকিয়েই রান নেয়ার জন্য দৌড় দিলেন ধোনী। পিচে ধোনীর রান নেয়ার পথে দাঁড়িয়ে ছিলেন মুস্তাফিজ। তখনই কনুই দিয়ে হয়তো ইচ্ছেকৃতভাবে মারলেন সজোরে ধাক্কা।

সেদিন ধোনীর পেশিবহুল শরীরের ধাক্কা খেয়ে ছিটকে যান মুস্তাফিজ। এরপর ব্যাথা পেয়ে ওই ওভারটি শেষ না করে কিছু সময়ের জন্য মাঠের বাইরেও যান। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। খেলা শেষে যদিও মুস্তাফিজ বলেছিলেন, তিনি ধোনীর রান নেয়ার পথে ছিলেন। কিন্তু গোটা বিশ্ব দেখেছে কীভাবে ধাক্কা দেওয়া হয়েছিলো মুস্তাফিজকে। একশত কোটি মানুষের দেশ ভারতের প্রতিনিধিত্ব করা অধিনায়ক কি সেদিন পারতেন না একটু উদারতা দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে? এমন পাশ কাটিয়ে রান নেওয়ার ঘটনাতো রোজ রোজ ক্রিকেটে ঘটে। ধোনী-মুস্তাফিজের সেই ধাক্কাটি জনপ্রিয় ক্রিকেট ওয়েবসাইট উইজডেন ইন্ডিয়া প্রকাশিত ক্রিকেট মাঠের সেরা দশটি অক্রিকেটীয় ঘটনার তালিকায় স্থান পেয়ে যায়।

dhoni clash with mustafizur rahman

রোববার ইংল্যান্ডের ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সফরে দ্বিতীয় টেস্টের তৃতীয় দিনেই সফরকারীদের হারিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ যখন বিজয় উল্লাস করছে তখন কলকাতার অন্যতম জনপ্রিয় বাংলা গণমাধ্যম 'আজকাল' পত্রিকা এই জয়ের সংবাদ প্রকাশে শিরোনাম করেছে, ‌'অটো চালকের ছেলের হাতে ইংল্যান্ড হেরে গেল!' শিরোনামটা পড়েই মনে একটা ধাক্কা খেলাম। এরপর খুব মনোযোগ দিয়ে সংবাদটা পড়লাম। ভাবলাম মিরাজের উঠে আসার কোন রোমাঞ্চকর গল্পই হয়তো লেখা হয়েছে। কিন্তু কোথাও মিরাজের বাবার পরিচয় নিয়ে কোন কথা নেই। শুধুমাত্র মিরাজের অর্জনকে খাটো করার জন্য কৌশলে তাকে হেয় করা হয়েছে বলে মনে হলো। এটা কেমন ধরনের নীতিহীন সাংবাদিকতা সেটা আমার জানা নেই। সংবাদে একটি লাইনে লেখা হয়েছে 'শেষ পর্যন্ত পা পিছলে প্রথম হেরে বসল ইংল্যান্ড, বাংলাদেশের কাছে।' আসলেই কি ইংল্যান্ড পা পিছলে হেরেছে বাংলাদেশের কাছে। মিরাজের পরপর দুই ইনিংসে ৬ উইকেট পাওয়া কি নেহায়েতই কোন দুর্ঘটনা? সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো অনেকবার হাত ঘুরিয়ে দেবেন মিরাজ নিজেই।

এবার আবার আসি একজন জেন্টলম্যান কুকের কথায়। গুলাশান হামলার পর বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে কম পানি ঘোলা হয়নি। নিরাপত্তার অজুহাতে বাংলাদেশ সফরে প্রথম সারির কোন দলই আসতে চাচ্ছিল না। অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ সফরের কথা ছিল কিন্তু তারা আসেনি। ইংল্যান্ডের মরগানসহ অনেক ক্রিকেটারই আসতে চায়নি, আসেনি। কিন্তু কুক বললেন, তিনি আসবেন। তিনি এসেছেন। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের আবার আসার ইচ্ছাও পোষণ করে গেছেন।

২০১৫ সালে বিরল এক রেকর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার মারকুটে ব্যাটসম্যান তৎকালিন সময়ে সাউথ আফ্রিকার অধিনায়ক এবিডি ভিলিয়ার্স। সে সময় বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের ম্যাচ দুটি খেললেই তিনি হয়ে যেতেন অভিষেকের পর টানা ১০০টি টেস্ট ম্যাচ খেলার অধিকারী ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান। কিন্তু সেই রেকর্ডের মোহ বাদ দিয়ে তিনি সময় দিয়েছেন তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে। কিন্তু অ্যালিস্টার কুক কি করলেন? সবাই যখন নিরাপত্তার অজুহাতে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ডও যখন বলছে, কেউ চাইলে বাংলাদেশ সফরে যাবে আর কেউ না চাইলে চাপ দেয়া হবে না। তখন কুক চাইলেই নিরাপত্তা আর বাবা হওয়ার স্বাদ নিতে থেকে যেতে পারতেন নিজ দেশে। কিন্তু উপমহাদেশের মতো কঠিন কন্ডিশনে তার দলকে তিনি একা ঠেলে দেননি। কুক বলেছেন, সন্তান পৃথিবীতে আসার ১৮ ঘণ্টা পর স্ত্রী-সন্তানকে ফেলে আসা নিশ্চয় আমাকে একজন ভালো বাবা বা আদর্শ স্বামী হিসাবে প্রমাণ করেনি।

জানিয়ে দেয়া ভালো, এই বিনয়ী ব্যাটসম্যানটি কিন্তু ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ টেস্ট খেলার মালিক। তিনি ইংল্যান্ডের প্রথম এবং ইতিহাসের ১২তম ব্যাটসমান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ১০ হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করেছেন। সবচেয়ে কম বয়সে ১০ হাজার রান সংগ্রহ করে পেছনে ফেলেছেন ব্যাটিং মায়োস্ত্রো শচীন টেন্ডুলকারকে। আরো অনেক অনেক রেকর্ডের মালিক এই বাম হাতি ব্যাটসম্যান। ইতিহাস হয়তো অ্যালিস্টার কুককে বিবেচনা করবে তার পরিসংখ্যান দেখে। কিন্তু বাঙালির প্রতি তিনি যে ভালবাসা আর উদারতা দেখিয়েছেন সেজন্য তিনি থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে চিরদিন।

২০০৯ সালে পাকিস্তানে সফরকারী শ্রীলঙ্কা দলকে বহনকারী বাসের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। সেই ন্যাক্কারজনক ঘটনায় গাড়িচালকসহ নিহত হয় পাকিস্তানের ছয়জন পুলিশ। গুরুতর আহত হন ৫ জন ক্রিকেটার। কোনমতে প্রাণে বেঁচে যান সাঙ্গাকারা জয়বর্ধনেরা। এরপর থেকেই নিরাপত্তার কারণে পাকিস্তান সফরে যায়নি কোন টেস্ট খেলুড়ে দেশ। খুব নিকটে সেই সম্ভাবনাও নেই। গুলশান হামলার পর বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেরকম পরিস্থিতি হতে যাচ্ছিল। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ইংল্যান্ড সফর ছিল বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ। যদি এই কুক এবং তার বাহিনী আসতে রাজি না হতেন তাহলে হয়তো বাংলাদেশও হতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিবাসিত কোন রাষ্ট্র। পিছিয়ে যেত বাংলাদেশ, পিছিয়ে যেত ক্রিকেট। নিরাপত্তা পরিস্থিতি সন্তোষজনক হওয়ার পরও মুখ ফিরেয়ে নিয়েছিল অনেক ক্রিকেটার তারপরও ক্রিকেটের জন্য বাংলাদেশ সফরে আসতে রাজি হন ইংলিশ অধিনায়ক। তৃতীয় দিনে দ্বিতীয় টেস্টটি হারার পরও তিনি বলেছেন, ইংল্যান্ড দলকে বাংলাদেশে নেতৃত্ব দিতে পিরে আমি খুব আনন্দিত। বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খুব সন্তোষজনক। আমি মনে করি অন্য দেশেরও এখানে খেলতে আসা উচিত। এটা বাংলাদেশের জন্য একটা শুধুমাত্র সিরিজ নয় তারচেয়েও বড় কিছু।

বিনয়ী কুক এবং ইংল্যান্ড দলের প্রতি বাংলাদেশে কোটি কোটি মানুষ কৃতজ্ঞ। কিন্তু ইংল্যান্ড দল নিয়ে আলোচনায় কী করে বাদ যাবেন বেন স্টোকস? মাঠে তামিমের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, ফতুল্লায় প্রস্তুতি ম্যাচে হ্যান্ডশেক নিয়ে নানা কাণ্ড, শেষ টেস্টে সাব্বিরকে অতিমাত্রায় স্লেজিং করা। মাঠে এবং মাঠের বাইরে এই স্টোকসই সবচাইতে বেশি ভুগিয়েছে বাংলাদেশকে। তারপর খেলা শেষে বাংলাদেশ ত্যাগ করার আগে ফেসবুকে নিজের ভেরিফাইড পেজে দারুণ একটি সিরিজের জন্য বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে তার সন্তুষ্টির কথা জানান। বাংলাদেশের মানুষ এবং বিশেষ করে সাকিব আল হাসানকে স্যাল্যুটও জানান ইংল্যান্ড দলের এই তারকা অলরাউন্ডার। অতিথি পরায়ন বাংলাদেশ কী করে এমন কৃতজ্ঞ অতিথির প্রতি ক্ষোভ জমিয়ে রাখবে? তাইতো সাকিবের টুইট বার্তার মতো করো বলতে চাই, 'বাংলাদেশে খেলতে আসার জন্য ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড এবং ইংল্যান্ড দলকে ধন্যবাদ। বিশেষ করে আমাদের বিশ্বাস করার জন্য ইংল্যান্ডকে স্যালুট।'

আপনি আরো পড়তে পারেন

ইইউ থেকে ব্রিটেনের বের হওয়ায় বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি

সমস্যা কোথায়, জিপিএ-ফাইভে নাকি পদ্ধতিতে?

প্রিয় পাঠক, ভিন্নমতে প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু, রচনারীতি ও ভাবনার দায় একান্ত লেখকের। এ বিষয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার কোনোভাবে দায়বদ্ধ নয়। ধন্যবাদ।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর