তেল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-সৌদির ‘দাম্পত্য কলহ’

বিশ্ব জানে, বিশেষ স্বার্থের কারণে একে অন্যকে ‘তেল’ দিয়েই চলে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব। তবে এবার আসল তেল নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে দেশ দুটির। সৌদি নেতৃত্বাধীন ওপেক প্লাস তেল উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণায় দেশটির ওপর ক্ষেপেছে যুক্তরাষ্ট্র। সেজন্য সৌদিকে ‘ফল ভোগের’ও হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাইডেন যতই হুমকি দিন না কেন, এটি যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদির ‘দাম্পত্য কলহ’ মাত্র। দেশ দুটির মৌলিক সম্পর্কে কোনো ফাটল ধরবে না তাতে, কোনোরকম ‘ডিভোর্সের’ আশংকা নেই।

তেল উৎপাদন বাড়ানোর আর্জি নিয়েই সৌদিতে যুবরাজের কাছে গিয়েছিলেন বাইডেন

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক ‘কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপন্সিবল স্টেটক্রাফ্ট’র ফেলো গবেষক অ্যানেল শেলাইন বলেন, ‘আমি মনে করি না যে দেশ দুটির এই দাম্পত্য কলহ বিচ্ছেদে গড়াবে। কিন্তু আমি কল্পনা করি, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি উভয়ের মধ্যে অসন্তোষটুকুই বাড়তে দেখবো আমরা। আর উভয়ের মনে একটিই প্রশ্ন ঘুরপাক খাবে, যাকে মিত্র-অংশীদার ভেবে চলছি, তার কাছ থেকে এই পাচ্ছি?’

তবে শেলাইন বলেন, ওয়াশিংটনে যতই উত্তেজনা দেখা দিক, সেটি কেবল চায়ের কাপে ঝড়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র জানে জ্বালানি তেলের জন্য সৌদির ওপর পুরোপুরিই নির্ভরশীল তারা। সে কারণেই দেশটির সঙ্গে কয়েক দশক ধরে সম্পর্ক বহমান যুক্তরাষ্ট্রের।

দীর্ঘদিনের মিত্র সৌদির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চলমান মনোমালিন্যের মূলে তেল।

বিশ্বের তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ওপেক প্লাস সম্প্রতি তেল উৎপাদন কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। ওপেক প্লাসের অন্যতম সদস্য হচ্ছে রাশিয়া, অন্যদিকে জোটের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার বড় মাথা হচ্ছে সৌদি।

একে তো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে জ্বালানি সঙ্কট, খাদ্য সরবরাহ ভেঙে তৈরি হয়েছে চরম মূল্যস্ফীতি। বড় দেশগুলোও হাবুডুবু খাচ্ছে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায়। এ থেকে গা বাঁচাতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারাও।

এরইমধ্যে ওপেক প্লাসের তেল সরবরাহ কমানো ঘোষণাকে ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র।

একে তো চলছে জ্বালানি সঙ্কট, তার ওপর উৎপাদন হ্রাস হলে সরবরাহ কমে তেলের দাম আকাশচুম্বি হওয়ার আশঙ্কায় পড়েছে দেশটি। বাইডেনের সামনে আবার মধ্যবর্তী নির্বাচন। এমন সময়ে তেলের দাম বাড়লে ভোট কমে যাবে বাইডেনের।

ইউক্রেনে সামরিক হামলা চালানোর কারণে এই মুহূর্তে রাশিয়ার সঙ্গে চরম বৈরিতা চলছে যুক্তরাষ্ট্রের। সেই শত্রুর সঙ্গে গলাগলি ধরে তেলের উৎপাদন ও সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় ওপেক প্লাসের প্রধান নিয়ন্ত্রণ সৌদির ওপর ক্ষেপেছেন বাইডেন। তিনি বলেছেন, সৌদি আরবকে ফল ভুগতে হবে।

যদিও বিশ্বের অন্যতম তেল উৎপাদক রাষ্ট্র সৌদির দাবি, ওপেক প্লাসের তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত পুরোপুরি অর্থনৈতিক। তাদের ভাষ্য, ওপেক প্লাস ভোক্তা ও উৎপাদক উভয়েরই স্বার্থরক্ষার মাধ্যমে কাজ করে।

সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য বিবেচনায় এবং বাজারের অস্থিরতা কমাতেই সদস্যদেশগুলোর সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওপেক প্লাস।

এদিকে তেল উৎপাদন কমানোর শাস্তি হিসেবে সৌদির কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ এবং দেশটির সঙ্গে সহযোগিতার সব পথ বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তুলেছেন মার্কিন আইনপ্রণেতারা।

সিনেটে বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির চেয়ারম্যান বব মেনেনডেজ দাবি তুলেন, সৌদির সঙ্গে মার্কিন সহযোগিতার ‘সমস্ত দিক’ ফ্রিজ করে দেওয়া হোক।

তবে এ বিষয়ে আরেক থিংক ট্যাঙ্ক ‘মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের’ আরব পেনিনসুলা অ্যাফেয়ার্স প্রোগ্রামের পরিচালক সাবেক মার্কিন কূটনীতিক জেরাল্ড ফিয়েরস্টেইন বলেন, বর্তমান উত্তেজনা যে মৈত্রিতায় কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটাবে, সেই সম্ভাবনা কম।

তিনি বলেন, এখনও সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রয়েছে। আমরা এখনও আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতাসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থকে ভাগাভাগি করে চলছি।

ফিয়েরস্টেইন আরও বলেন, সৌদির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক লেনদেনমূলক। এটি কোনো গভীর সম্পর্ক নয়। তবে পারস্পরিক স্বার্থই ওই সম্পর্ককে ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট।

মার্কিন সিনেটে যতই সৌদিকে শাস্তির দাবি উঠুক, গত রোববারই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান তো বলেই দিয়েছেন, তেল ইস্যুতে রিয়াদের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের কোনো পদক্ষেপই অত্যাসন্ন নয়।

আল-জাজিরা অবলম্বনে।