মেসিরা ভুলে গেছেন, ভোলেননি পেলে

অপেক্ষা যতো দীর্ঘই হোক না কেন এর শেষ আছে। প্রতীক্ষার ফল যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মিষ্টি হয়! অবশেষে সেই স্বাদ পেয়েছে আর্জেন্টিনা। লিওনেল মেসি নামক জাদুকরের সুবাদে অবসান হয়েছে ল্যাটিন আমেরিকান ৩৬ বছরের অপেক্ষার। কাতার বিশ্বকাপের আগে আকাশি-নীল জার্সিধারীদের সবশেষ ও দ্বিতীয় ট্রফিটা এসেছিল ১৯৮৬ সালে।

ফুটবল ইতিহাসের সেরা দুই কিংবদন্তি পেলে ও ডিয়েগো ম্যারাডোনা

ডিয়েগো ম্যারাডোনার ভেলায় চড়ে শিরোপা জেতে আর্জেন্টিনা। পরের আসরেও দলকে ফাইনালে নিয়ে যান তিনি। সেবার ফাইনালে রেফারির বিতর্কিত এক সিদ্ধান্তের বলি হয় আর্জেন্টিনার তৃতীয় ট্রফি জয়ের স্বপ্নের। ম্যারাডোনা খেলেছেন ১৯৯৪ বিশ্বকাপেও। কিন্তু মাঠে মনে রাখার মতো কিছু করতে পারেননি। বরং নিষিদ্ধ ড্রাগ নেওয়ায় নির্বাসিত হয়েছেন আন্তর্জাতিক ফুটবলের মঞ্চ থেকে। আর্জেন্টিনার জার্সিতেও শেষ হয়ে গেছে ম্যারাডোনা অধ্যায়। দেশটির ফুটবল ইতিহাসে এতোদিন তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বড় তারকা।

মারিও কেম্পেস ১৯৭৮ সালে প্রথমবার আর্জেন্টিনার স্বপ্নপূরণ করলেও ম্যারাডোনার আলোয় অনেকটাই ছিলেন ছায়াতলে। লুসাইলের ঐতিহাসিক ফাইনালে গ্যালারিতে কেম্পেসের উপস্থিতি মেসিদের অনেকটাই অনুপ্রাণিত করেছে। ব্রাজিলের কিংবদন্তিরা যেমন গ্যালারিতে ছিলেন তেমনি কেম্পেসের সঙ্গে থাকতে পারতেন ম্যারাডোনাও। বিশ্বকাপজুড়ে গোটা ফুটবল দুনিয়া মিস করেছে ছিয়াশির বিশ্ব জয়ের নায়ককে। কিন্তু এমন সাফল্যের পর পূর্বসুরির কথা স্মরণ করতেই যেন ভুলে গেছেন মেসিরা!

স্বপ্নের বিশ্বকাপ হাতে আর্জেন্টিনার উল্লাস

পেশাদার ফুটবলের শুরু থেকে ২০১৮ বিশ্বকাপ পর্যন্ত প্রতিটি আসরেই আর্জেন্টিনার সঙ্গে ছিলেন ম্যারাডোনা। কখনো খেলোয়াড় হিসেবে, কখনো কোচ হিসেবে কিংবা একজন ভক্ত হিসেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, জীবদ্দশায় উত্তরসূরিদের হাতে স্বপ্নের ট্রফিটা দেখে যেতে পারলেন না ছিয়াশির নায়ক। অথচ তৃতীয় শিরোপা জয়ের পর আর্জেন্টিনা দলের কোনো খেলোয়াড় কিংবা কোচকে এই মহানায়ককে স্মরণ করতে দেখা যায়নি।

মেসিরা হয়তো ভুল করেছেন; আনন্দে আত্মহারা হয়ে আবেগের বাধ ভেঙেছেন। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম সেরা নায়ক পেলে মেসিদের মতো ভুলটা করেননি। আর্জেন্টিনাকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে ঠিকই প্রয়াত বন্ধুর কথা স্মরণ করেছেন তিনি। রোববার রাতেই ইন্সটাগ্রামে এক পোস্টে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল সম্রাট পেলে বলেছেন, ‘আর্জেন্টিনাকে অভিনন্দন। নিশ্চয়ই ডিয়েগো (ম্যারাডোনা) এখন হাসছেন।’

লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে যে স্নায়ুক্ষয়ী যে ফাইনালটা হলো তাকে কীভাবে বিশেষায়িত করা যায়? মহাকাব্য, মহানাটক নাকি অন্যকিছু। বিশেষণ যেমনই হোক না কেন ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে এটাই যে সেরা ফাইনাল এনিয়ে দ্বিমত পোষণ করার লোক খুঁজে পাওয়াই দুঃস্কর। লিওনেল মেসির দুর্দান্ত নৈপুণ্য ও কিলিয়ান এমবাপ্পের অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের পর শেষে নায়ক হয়ে গেলেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। তার বীরত্বেই তো শেষ হাসি জুটেছে আর্জেন্টিনার ভাগ্যে। তাতেই শাপমোচন হলো মেসির।

সাড়ে আট বছর আগের বিশ্বকাপে শিরোপা হাতছোঁয়া দূরত্বে রেখে এসেছিলেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক। দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হওয়ায় মেসি তো বটেই, বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষই খুশি। এই শিরোপাটা তারই প্রাপ্য ছিল। মহানাটকীয় ফাইনাল শেষে মেসির হাতে ট্রফি তুলে দিয়ে দায় মিটিয়েছে ফুটবলও। পেলে যথার্থই বলেছেন, ‘আজ (রোববার রাতে) ফুটবল তার নিজের গল্প বলছে। আর এটা সব সময়ের মতোই আকর্ষণীয়। মেসি ওর প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছে। এটা ওরই প্রাপ্য ছিল।’

অবশ্য মেসিকে শুভেচ্ছা বার্তা জানালেও ফাইনালের ‘ট্রাজিক হিরো’ কিলিয়ান এমবাপ্পের কথা ভুলে যাননি পেলে। ‘হ্যাটট্রিকম্যান’ ফরাসি সেনসেশনকে তার প্রাপ্য প্রশংসাটাই দিয়েছেন তিনবারের বিশ্বজয়ী খেলোয়াড়। পেলে বলেছেন, ‘বন্ধু এমবাপ্পে ফাইনালে চার গোল করেছে (পেনাল্টি শ্যুট আউটের এক গোলসহ) এটা সত্যি দারুণ। ও আমাদের খেলার (ফুটবলের) ভবিষ্যতের জন্য এক উপহার।’