বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের লড়াই: আসল জয়ী ভারত!
- Details
- by ভিন্নমত
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের লড়াইয়ে আসল ফায়দা তুলে নিচ্ছে ভারত। নিজের সম্পদ ব্যবহার না করেই দুই পরাশক্তিকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে বাংলাদেশে কার্যসিদ্ধি করছে প্রতিবেশী দেশটি। দ্য ডিপ্লোমেট সাময়িকীতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ কথা বলেছেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটের ফেলো অনু আনওয়ার। পাঠকদের জন্য নিবন্ধটির উল্লেখযোগ্য অংশ ভাষান্তর করা হলো।
নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘরোয়া রাজনীতির উত্তাপ এবং পরস্পরের প্রভাব খর্ব ও নিজ এজেন্ডা এগিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের প্রায় একই সময়ে সফরের বরাতে বাংলাদেশ আবারও বৈশ্বিক ভূরাজনীতির পাদপ্রদীপে উপনীত হয়েছে।
গত ১০ জানুয়ারি চীনের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গাং নিজের প্রথম বিদেশ সফরে বাংলাদেশে নজিরবিহীন যাত্রাবিরতি করেছেন। ক্যালেন্ডার বর্ষের প্রথম বিদেশ সফরে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আফ্রিকার কোনো দেশে যাবার ৩২ বছরের রেকর্ড ভেঙে ঢাকায় আসেন ছিন গাং। আনুষ্ঠানিক সরকারি সফর না হলেও ঢাকায় তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল কালাম আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এটা ঘটেছে এমন সময় যখন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক দপ্তরের উপ-প্রধান শেন ঝৌর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে তিনদিনের সফরে ছিল।
চীনের উচ্চ পর্যায়ের সফরগুলোর সময়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল তুঙ্গে। হোয়াইট হাউসের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ডিরেক্টর এইলিন লবেকার ৭ জানুয়ারি চারদিনের সফরে ঢাকা আসেন। ৯ জানুয়ারি তিনি মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, ছিন গাংয়ের ঢাকা বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতির মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। এরপর দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকায় একটি হাই-ভোল্টেজ সফর শেষ করলেন।
উচ্চ মাত্রার এসব কূটনৈতিক তৎপরতা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বঙ্গোপসাগরের মুখে অবস্থিত কৌশলগত বিচারে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র বাংলাদেশকে কাছে টানতে দুই দেশের প্রয়াসের প্রতিফলন। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ই এ প্রতিযোগিতায় জিততে চায়, যদিও চূড়ান্তভাবে তাদের কেউ নয়, বরং বিজয়ী হচ্ছে ভারত। ভূরাজনৈতিক লড়াইয়ে নিজের সম্পদ ক্ষয় না করে নয়াদিল্লি নীরবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে বেশিরভাগ সময় ভারত দেশটিকে নিজের প্রভাব বলয়ে রেখেছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে চীনের প্রবেশ নতুন ঘটনা বলা যায়। বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বাইরে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করার তেমন গুরুত্ব হাতিয়ার এখনও চীনের নেই। এরপরও বাংলাদেশে চীনের সীমিত অর্জনকে ভারত তার নিজের ক্ষতি মনে করে। বাংলাদেশে চীনের অগ্রসর ঠেকাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে ভারত। তবে নিজের সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং বাংলাদেশের ভেতরে ক্রমবর্ধমান ভারত বিদ্বেষী মনোভাবের কারণে দেশটি ধনী চীনের কার্যকর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি।
এ অবস্থায় চীনের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ এগিয়ে নিতে ভারত চীনকে ঠেকানোর অধিকতর কার্যকর একটি উপায় বের করেছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। পাশাপাশি তারা চীনের পাল্টা পক্ষ হিসেবে জাপান ও রাশিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কেও মাঠে নামিয়েছে, যারা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন ও চীনের বিরোধিতা করে।
ভারতের এ কৌশলের সবচেয়ে জলজ্যান্ত প্রমাণ হলো বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সাম্প্রতিক বাকযুদ্ধ। দুই জায়ান্ট যখন পরস্পরের বিরুদ্ধে শক্তিক্ষয় করছিল, ভারত তখন মাঠের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
ভারত দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমাবিরোধী ও রাশিয়াপন্থী দেশ। চীনের প্রভাব ঠেকাতে পাশ্চাত্যের কোলে ঘেঁষলেও ভারত রাশিয়াকে ছেড়ে দেয়নি। বরং রাশিয়ার সঙ্গে, বিশেষত ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে জ্বালানি সহযোগিতা বাড়িয়েছে দেশটি।
ভারত বাংলাদেশে মার্কিন সংশ্লিষ্টতার বিরোধী। এ অবস্থায় বাংলাদেশে রাশিয়াকে প্রভাব বিস্তার করতে দেওয়া ভারতের স্বার্থের পক্ষেই যায়। ভারতের ওপর বাংলাদেশের অতি-নির্ভরতা এবং বাংলাদেশে ভারতের ভূরাজনৈতিক ফায়দার বিষয়টি বিদ্যুত খাতের দিকে তাকালে বুঝা যায়। বিদ্যুৎ ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। ১২০০ কোটি ডলারের প্রকল্পটির ৯০ শতাংশ অর্থায়ন করছে রাশিয়া। বাংলাদেশ ও রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতে রুশ কোম্পানি রসঅ্যাটম প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও ভারতকে এ প্রকল্পের কারিগরি দেখভালে অভাবনীয় প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র প্রস্তুত করবে না এ মর্মে ভারতকে আশ্বস্ত করতে প্রকল্পে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের প্রকল্পে প্রবেশ নিশ্চিত হওয়ায় ভারত বাংলাদেশের তরফ থেকে যে কোনোরকম পারমাণবিক হুমকি অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে পারবে, যদিও এজন্য তাদের কোনো অর্থ ব্যয় করতে হবে না।
বাংলাদেশের বিদ্যুত খাতে ব্যবসার ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপানসহ যে কোনো দেশকে মুনাফায় ছাড়িয়ে গেছে ভারত। ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের আদানি গ্রুপকে বাংলাদেশ অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করছে যাতে আওয়ামী লীগের শাসন অব্যাহত রাখতে বিজেপির সমর্থন পাওয়া যায়। রাজনৈতিকভাবে কানেক্টেড কোম্পানিগুলোকে কুইক রেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্রের কাজ দিয়েছে বাংলাদেশ।
জাপানকেও বাংলাদেশে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে ভারত। চীনের আগমনের আগে বাংলাদেশে বড় ধরনের অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর বাজারে জাপানি কোম্পানির আধিপত্য ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন কিছু অবকাঠামো চুক্তি করায় নার্ভাস বোধ করছে ভারত। অবকাঠামো খাতে চীনের বিকল্প হিসেবে দাঁড়ানোর মতো টাকাপয়সা ও কারিগরি সক্ষমতা ভারতের নেই। এজন্য তারা চীনের দৌড় ঠেকাতে জাপানের পকেটের ওপর নির্ভর করছে।
বহুদিন ধরে গভীর সমুদ্র বন্দর করতে চায় বাংলাদেশ। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দরের কাজ পেতে চেয়েছিল চীন। কিন্তু ভারতের চাপে বাংলাদেশকে ওই প্রকল্প বাদ দিতে হয়েছে। প্রায় এক দশক দেরির পর বাংলাদেশ জাপানকে মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দরের কাজ দিয়েছে। এর সঙ্গে কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্র, সড়ক যোগাযোগসহ বেশকিছু আমব্রেলা প্রকল্প রয়েছে যেগুলো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে সংযুক্ত করবে।
চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য সামরিক সংঘাতে ভারতের সাফল্য নির্ভর করবে তারা কত দ্রুত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সৈন্য সমাবেশ করতে পারে তার ওপর। ভারত দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গ ও বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর সংযোগের জন্য বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সড়ক নির্মাণ করতে চেয়েছে। নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ থেকে বাংলাদেশ তাতে সম্মত হয়নি। এখন জাপান বিগ-বি প্রকল্পের অধীনে নিজের অর্থে সে সড়ক নির্মাণ করে ভারতের কৌশলগত লক্ষ্যপূরণে সহায়তা করছে।
অনু আনওয়ার: হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেসের ফেলো ও জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অব অ্যাডাভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পিএইচডি ক্যান্ডিডেট।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর