নিহাদের অস্ত্র ধৈর্য ও পরিশ্রম

কল বেজে ওঠার অল্প সময়ের মধ্যে রিসিভ করে সালাম দিলেন। সালামের জবাব দেওয়ার পর পরিচয় পর্ব। চিনতেই হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছেন? কুশলাদি শেষ হওয়ার পর সাক্ষাৎকারের কথা বলা হয়। জবাবে ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসল 'মাগরিবের নামাজের সময় হয়েছে ভাই। কিছু মনে করবেন না। মাগরিবের নামাজ শেষ হওয়ার পর আপনাকে সাক্ষাৎকার দিব।' এরপর যথারীতি নামাজ শেষে ফের কল করা হয়।

সুযোগের অপেক্ষায় বাঁহাতি স্পিনার

ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটার নাম নিহাদুজ্জামান। সদ্য শেষ হওয়া বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ, বিপিএলে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে বল হাতে আলো ছড়িয়েছেন রাজশাহীর এই ক্রিকেটার। কথাবার্তায় যথেষ্ট বিনয়ী ২৪ বছর বয়সী নিহাদ। ব্যবহারে বিনয়ী হলেও বাইশ গজে প্রতিপক্ষকে ছেড়ে কথা বলেন না তিনি। প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের জন্য তিনি বল হাতে ত্রাস ছড়ান।

বিপিএলের নবম আসরের প্লেয়ার্স ড্রাফটে নিহাদের ওপর আগ্রহ দেখায়নি কোনো দল। টুর্নামেন্ট শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে তাকে দলে টানে চট্টগ্রাম। নিহাদও কুড়িয়ে পাওয়া সুযোগের শতভাগ ব্যবহার করেছেন। বলতে গেলে উপেক্ষাকে পাশ কাটিয়ে কিভাবে লাইম লাইটে আসা যায় ঠিক সেটাই করে দেখিয়েছেন পদ্মা পাড়ে দুরন্ত শৈশব পার করা এই ক্রিকেটার।

প্রিয় গুরুর সাথে একফ্রেমে নিহাদ। বিপিএলের ভাল করার কৃতিত্ব দিয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ককে

চট্টগ্রামের জার্সিতে সব ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি নিহাদ। সব মিলিয়ে মাঠে নেমেছেন ৯ ম্যাচ। বাঁহাতি স্পিনে শিকার করেছেন ১২ উইকেট। উইকেট শিকারের তালিকায় যা নবম। গত ২৭ জানুয়ারি ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে ১৭ রানের বিনিময়ে প্যাভিলিয়নে ফিরিয়েছেন সাকিব আল হাসান, ইফতিখার আহমেদ, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, চতুরঙ্গ ডি সিলভাকে। বিপিএলে সেটাই তার সেরা বোলিং ফিগার।

অথচ নিহাদের পথচলা মোটেও মসৃণ নয়। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের হয়ে যুব বিশ্বকাপ খেলেছেন। তার পরের বছর সড়ক দুর্ঘটনায় কবলে পড়েন। প্রাণে বেঁচে ফেরেন অল্পের জন্য। সে দুঃস্মৃতি সামাল দিয়ে না ওঠতেই এক বছর পর হাত ভেঙে যায়। এসব কারণে নিজের ফর্ম ধরে রাখতে পারেননি। ধাক্কা সামলে নিহাদ যখন ক্রিকেটে নিয়মিত হওয়ার লড়াই করছিলেন ততোদিনে দেশের জার্সিতে অভিষেক হয়ে গেছে যুবদলের বন্ধু মোস্তাফিজুর রহমান, লিটন কুমার দাস, মেহেদি হাসান মিরাজদের।

সতীর্থের সাথে প্রতিভাবান স্পিনারের উইকেট উদযাপন

এসব বিষয় অনুমিতভাবেই বেশ পোড়ায় নিহাদকে। যদিও মুষড়ে পড়ার পাত্র নন তিনি। কপালের ওপর কারও হাত নেই সেটা ভালভাবেই বিশ্বাস করেন। যদিও সবশেষ বিপিএলের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর ফের আশায় বুক বেঁধেছেন। এবার লক্ষ্য একটাই, সামনে এগিয়ে যাওয়া। বলতে গেলে অনেকটা নতুন শুরু নিহাদের সামনে। সম্প্রতি বেশকিছু বিষয় নিয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপারের সাথে কথা বলেছেন নিহাদ। এর চুম্বক অংশগুলো তুলে ধরা হলো।

বিপিএলে দারুণ বোলিংয়ের পেছনে নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমের পাশাপাশি প্রিয় গুরু খালেদ মাহমুদ সুজনের ভূমিকার কথা বলতেও ভুল করেননি নিহাদ। তিনি বলেন, ‘বিপিএলের আগে আমি ভাল প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কি গত দুই বছরে আমি অনেক পরিশ্রম করেছি। এরপরও আড়ালেই ছিলাম। তবে একটা সুযোগের অপেক্ষায় থাকতাম সব সময়। যখন যেখানে সুযোগ পাব সেখানেই যেন নিজেকে মেলে ধরতে পারি। শেষ এনসিএলের পর যখন সময় পেলাম তখন সাদা বলে ফোকাস করি।’

বরিশালের বিপক্ষে নিয়েছিলেন চার উইকেট

‘আমি জানতাম যে আমার অনেক কিছু দেওয়ার আছে। তো আল্লাহ’র রহমতে আমি বাংলা ট্র্যাক ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে সুজন স্যারের অধীনে প্র্যাক্টিস করেছি। আমার সাথে আরও কয়েকজন ছিল। তিনি আমাদের সেন্টার উইকেটে খুব ভাল প্র্যাক্টিস করিয়েছিলেন। পাওয়ার প্লে, মিডল ওভার, স্লগ ওভারসহ বিভিন্ন রকমের ম্যাচ পরিস্থিতি তৈরি করে স্যার আমাদের প্র্যাক্টিস করিয়েছেন। এসব বিপিএলে অনেক কাজে দিয়েছে।’

লক্ষ্য যথন জাতীয় দল তখনও পরিশ্রমকে প্রাধান্য দিচ্ছেন নিহাদ। সেই সাথে ধৈর্য ধরছেন তিনি, ‘প্রত্যেকটা ক্রিকেটারের স্বপ্ন থাকে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা। আমি তো যুবদলের হয়ে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছি। তাই আমার অনেক স্বপ্ন যে জাতীয় দলের হয়ে খেলব। এজন্য আমি একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি। চেষ্টা করছি দিন দিন নিজের উন্নতি করার। আমার যেখানে দুর্বলতা আছে সেসব জায়গায় উন্নতি করার চেষ্টা করছি। আমি বিশ্বাস করি যখন ভাল করতে থাকব তখন সুযোগ আসবে। এটার জন্য একটু ধৈর্য রাখতে হবে এবং কষ্ট করতে হবে। তাই আমি চেষ্টা করছি ধৈর্য ধরে এবং পরিশ্রম করে যত সামনে যাওয়া যায়। ইনশাআল্লাহ সুযোগ আসবে।’

নিজের বাজে সময়গুলো নিয়ে নিহাদ বলেন, ‘ক্যারিয়ারে আমার দুইটা ধাক্কা গেছে। ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছি। এরপর ২০১৭ সালে আমার হাত ভেঙে যায়। এজন্য বোলিং অ্যাকশন পরিবর্তন করতে হয়েছে। সব মিলিয়ে বলতে পারেন ওই দিনগুলো আমার জন্য খুবই খারাপ ছিল। আলহামদুলিল্লাহ ওই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি।’

লিটন-মোস্তাফিজদের মতো কেন দেশের জার্সি গায়ে জড়াতে পারেননি সেটাও পরিষ্কার করেছেন এই স্পিনার। তিনি বলেছেন, ‘অনেক ভাল করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। এজন্য খারাপ তো লাগেই। তবে এটাও সত্য যে আমি ওই সময় নিজেকে প্রমাণ করতে পারিনি। আমি সব সময় নিজের কাজে লক্ষ্য ঠিক রাখতে চাই। যুবদলের হয়ে অনেক ভাল বোলিং করেছি, এইচপিতেই ভাল সময় গেছে। তারপর আমি বিপিএল (২০১৫ সালে রাজশাহীর হয়ে বিপিএল খেলেছেন নিহাদ) খেলেছি। ওই বিপিএলে যদি ভাল করতে পারতাম তাহলে আমারও সুযোগ চলে আসত। আমিও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতাম। তবে নিজেকে তখন প্রমাণ করতে পারিনি।’

‘এটাও ঠিক যে সবার সময় এক যায় না। আমার সময় হয়ত একটু দেরিতে আসবে। চেষ্টা করছি যে সে সময়টা যখনই আসুক সেটাকে ধরে রাখার এবং উন্নতি করার। আমি একটা প্রসেসের মধ্যে আছি। প্রতিদিন উন্নতি করার চেষ্টায় আছি। বিশ্বাস করি প্রতিদিন যদি উন্নতি করতে থাকি তাহলে সাফল্য আসবেই। কিন্তু ধৈর্য ধরতে হবে।’ যোগ করেন নিহাদ।