কারও সার্টিফিকেট জাল, কেউ অদক্ষ, আবার কেউ ব্যর্থ হয়েছেন পরীক্ষায়। এমন একদল পাইলটের পেছনে এক বছর ধরে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে রাষ্ট্রায়ত্ব উড়োজাহাজ সংস্থা বিমান। অযোগ্য এসব পাইলট নিয়োগের পেছনে স্পষ্ট অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি চোখে পড়েছে। ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে এ কথা জানা গেছে। 

biman bangladesh airlines logoচুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত অযোগ্য পাইলটদের পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে বিমান

বিমান পেয়িং ফর হায়ারিং আনকোয়ালিফাইড বোয়িং পাইলটস শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা যায়, পাইলট স্বল্পতার কারণে জরুরি ভিত্তিতে নিয়োগ দরকার এমন অজুহাতে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১৪ জনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় বিমান। এক বছর পর দেখা যাচ্ছে, এদের মধ্যে কেবল পাঁচজন বিমান নিয়ে আকাশে উড়েছেন। অথচ তাদের বেতন-ভাতা ও প্রশিক্ষণে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা গুনে চলেছে বিমান।

বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর চালানোর কথা বলে ১৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিমানের নিজস্ব অপারেশন ম্যানুয়ালেই বলা আছে যে, বোয়িং ৭৭৭ ওড়াতে হলে ফার্স্ট অফিসারকে পূর্ববর্তী দুই বছরে কমপক্ষে ৩০০ ঘণ্টা বিমান চালানোর রেকর্ডধারী হতে হবে। ১৪ জনের কেউই এ শর্ত পুরণ করতে পারেননি।

পুরো বিষয়টিতে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স পাইলটস এসোসিয়েশন প্রশ্ন তুলেছে- যোগ্য পাইলটদের পদোন্নতির সুযোগ থাকতে কেন অযোগ্য পাইলটদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হলো?

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিষয়টিকে ‘নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের বিষয়’ বলে অভিহিত করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকেও বিমানকে বিষয়টি তদন্ত করতে বলা হয়েছে।

বিমানের গত ১৩ ফেব্রুয়ারি তারিখের এক নথিতে দেখা যায়, নিয়োগপ্রাপ্ত ১৪ জনের মধ্যে কেবল চারজন পাইলট ও একজন ফার্স্ট অফিসার প্লেন ওড়ানোর সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।

তবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারা নয় পাইলটকে বাঁচাতে বিমান সবরকমের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য সংস্থাটি একের পর এক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে চলেছে। 

নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে কয়েকজনের নামোল্লেখ করে তাদের জালিয়াতি, অদক্ষতার কথা তুলে ধরেছে ডেইলি স্টার। এর মধ্যে ফার্স্ট অফিসার সাদিয়া আহমেদের কথাই ধরা যাক। সাম্প্রতিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, নিয়োগের সময় তিনি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাশ করেছেন দাবি করে একটি জাল সার্টিফিকেট জমা দিয়েছেন।

তবে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সাদিয়া আহমেদ শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। বাংলা, ইংরেজি, পৌরনীতি, মনোবিজ্ঞান ও গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে এইচএসসি পাশ করেছেন।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের বিধি অনুযায়ী, বাণিজ্যিক উড়োজাহাজের পাইলট হতে হলে পদার্থ বিজ্ঞান ও গণিতসহ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যক।

প্রতিবেদনে জানা যায়, সাদিয়া আহমেদ বিমানের প্রশিক্ষণ বিভাগের প্রধান ক্যাপ্টেন সাজিদ আহমেদের স্ত্রী। তবে তিনি জাল সনদ জমা দিয়ে নিয়োগ পাওয়া একমাত্র ব্যক্তি নন।

ফার্স্ট অফিসার আল মেহেদি ইসলাম নিয়োগের সময় যে এয়ারলাইন ট্রান্সপোর্ট পাইলট লাইসেন্স (এটিপিএল) জমা দিয়েছেন, সেটা ভুয়া। কমান্ডিং পাইলট হতে হলে এটিপিএল জমা দিতে হয়। মেহেদি যে এটিপিএল দিয়েছেন তাতে বেবিচকের ফ্লাইট সেফটি বিভাগের সাবেক সহকারী পরিচালক শিরিন সুলতানার স্বাক্ষরটি নকল করা হয়েছে।

এটিপিএল লাইসেন্সের জন্য ১৪টি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। ২০২০ সালের অক্টোবরে নেওয়া এটিপিএল টেস্টের ফলাফলে দেখা যায়, এর মধ্যে ১১টি পরীক্ষায় মেহেদি অংশই নেননি। যে তিনটি পরীক্ষায় তিনি অংশ নেন, তার মধ্যে দুটিতেই ফেল করেছেন।

বিমানের ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখের এক নথির বরাতে ডেইলি স্টার জানিয়েছে, সংস্থাটি গত বছরের শেষদিকে মেহেদির নিয়োগ বাতিল করেছে। তবে অন্যরা এখনও টিকে আছেন বহাল তবিয়তে।

শর্ত অনুযায়ী, দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সন্তোষজনক মূল্যায়নের ভিত্তিতে বিমানের সঙ্গে নিয়োগপ্রাপ্তদের চুক্তি এক বছর নবায়ন হবার কথা। এই সন্তোষজনক মূল্যায়নের বিভিন্ন শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো টাইপ রেটিং, যার ভিত্তিতে প্রার্থীর ককপিট সামলানোর যোগ্যতা নিরূপণ হয়। টাইপ রেটিং পেতে হলে ইনিশিয়াল রুট চেক (আইআরসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। যে প্রার্থীরা আইআরসিতে ব্যর্থ হয়েছেন, তাদের টেস্ট রেকর্ডে বেরিয়ে এসেছে উদ্বেগজনক কিছু অনিয়ম।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়ম অনুযায়ী রুট ট্রেনিং শুরুর ১৫০ দিনের মধ্যে প্রার্থীকে আইআরসি টেস্ট সম্পন্ন করতে হয়। সাদিয়া আহমেদের রুট ট্রেনিং শুরু হয় ২০২২ সালের ২৬ মে। একই বছরের ২৪ অক্টোবর বিমানের ট্রেনিং ডিপার্টমেন্ট থেকে বেবিচকের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, সাদিয়া তার ১৫০ দিনের সময়সীমা অতিক্রম করেছেন এবং তার ট্রেনিংয়ের মেয়াদ যেন বৃদ্ধি করা হয়।

বেবিচক ওই অনুরোধে সাড়া দিয়েছে কিনা জানা যায়নি উল্লেখ করে ডেইলি স্টার বলেছে, সাদিয়া আহমেদ গত  ২৭ জানুয়ারি আইআরসি টেস্টে অংশ নিয়ে ফেল করেছেন। আইআরসিতে ব্যর্থ হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী ৫ ফেব্রুয়ারি সাদিয়ার সঙ্গে বিমানের নিয়োগ চুক্তির মেয়াদ শেষ হবার কথা থাকলেও বিমানের ট্রেনিং ডিপার্টমেন্ট তাকে আবারও আইআরসি টেস্টে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে ৭ ফেব্রুয়ারি ইমেইল পাঠিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

একটি সূত্র জানিয়েছে, সাদিয়া এর আগে রিজেন্ট এয়ারওয়েজে ছিলেন। সেখানে ল্যান্ডিং বিপত্তির একটি ঘটনাকে ঘিরে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

সাদিয়ার মতোই চাকরির রেকর্ড খারাপ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া ক্যাপ্টেন নাসিমুলের। ১৩ বছর ধরে ইতিহাদ এয়ারওয়েজে ফার্স্ট অফিসার থাকলেও তিনি ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি পেতে ব্যর্থ হন। যদিও ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো বলছে, যোগ্যতা থাকলে যে কোনো পাইলট আড়াই বছরেই ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি পেতে পারেন। ২০২০ সালে নাসিমুলকে চাকরিচ্যুত করে ইতিহাদ। এরপর বিমানে নিয়োগ পেয়ে গত বছরের ২২ ডিসেম্বর তিনিও আইআরসি টেস্টে অংশ নেন এবং ফেল করেন।

গত ১৫ জানুয়ারি আরেক পাইলট ইরফান উল হকের আইআরসি টেস্ট ফ্লাইট জেদ্দা থেকে ঢাকা আসার পথে বিমানের এক আরোহী হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। ওই ফ্লাইটে থাকা একজন ডাক্তার জানিয়েছেন, বিমান অবতরণে চার ঘণ্টা সময় লাগায় যাত্রীর মৃত্যু হয়।

বিমানের নথি থেকে জানা যায়, নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে আটজনের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যাংককে থাই ফ্লাইট সিমুলেটরে ৪৪ লাখ টাকা ব্যয় করেছে সংস্থাটি। এর সঙ্গে রয়েছে আটজনকে সেখানে আনা-নেওয়ার খরচ ও তাদের ব্যাংককে রাখার ব্যয়।

অযোগ্য, অদক্ষ পাইলটদের কয়েকজনকে প্রতি মাসে সাত অঙ্কের মোটা মাইনে দিয়ে চলেছে বিমান। এরা যদি চূড়ান্তভাবে বোয়িং ৭৭৭ পাইলট হতে ব্যর্থ হন, তাহলে এই পুরো টাকায় জলে গেছে বলে ধরে নিতে হবে।

বিমানের এমডি জাহিদ হুসাইন ও কয়েকজন পরিচালকের স্বাক্ষরিত একটি নথির বরাতে ইংরেজি দৈনিকটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথম প্রশিক্ষণ ফ্লাইটের সময় থেকে সাদিয়া আহমেদসহ আটজন পূর্ণ বেতন পাচ্ছেন। সাদিয়া আহমেদের গত বছরের জুলাই মাসের পে স্লিপে দেখা যায়, তিনি ওই মাসে মোট ১২ লাখ ৬৩ হাজার টাকা পেয়েছেন।

নিয়ম অনুযায়ী প্রশিক্ষণ ফ্লাইট থেকে পাইলটদের বেতন পাবার কথা নয়। তারপরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তদের এ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি অন্যান্য ভাতার ক্ষেত্রেও তারা ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২১ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত পাইলটদের তুলনায় বেশি সুবিধা পাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.